একটি স্বরচিত বঙ্গবন্ধু রচনা

সাইদুল ইসলাম, উইনিপেগ থেকে ।। 
শেখ মুজিবের নাম প্রথম যখন শুনি তখন আমি ক্লাশ ওয়ানের ছাত্র। মিছিল মিছিল আমাদের প্রিয় খেলা। যশোরের একটি প্রধান সড়কের পাশে আমাদের বাড়ি। যে কোন মিছিল রাস্তায় এলেই আমরা দৌড়ে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াই। কখনও গায়ে জামা থাকে কখনও থাকেনা। মিছিলের স্লোগান মনযোগ দিয়ে শুনি। মিছিল চলে যাবার পর আমরা বাড়ির উঠোনে মিছিল বের করি। সেই মিছিলে থাকে সাধারণত চারজন, আমরা দুইভাই আর আমাদের নিচতলার কাননরা দুই বোন। কাননরা কখনও থাকে কখনও থাকেনা। আমরা দুই ভাই গলা ফাটিয়ে স্লোগান দেই, শেখ মুজিবের মার্কা নৌকা নৌকা, রওশন আলির মার্কা নৌকা নৌকা। সেই দুই অথবা চার অথবা কোন দিন ছোটাপা যোগ দিলে পাঁচের মিছিল, উঠোন ঘুরে দোতলার বারান্দায় চলে আসে। এর মধ্যে কখন ভোট হল, কখন আওয়ামী লীগ জিতলো আমরা বুঝতে পারিনা। আমাদের বেহিসেবি এলোমেলো দিন হঠাৎ করে হিসাবের মধ্যে চলে আসে ২৫শ মার্চ মধ্য রাতে। প্রচন্ড গোলাগুলির শব্দে আমাদের ঘুম ভেঙ্গে যায়। সকালে কার্ফুর মধ্যে খালারা আমাদের বাসায় চলে আসেন। তাদের অগ্রদূত হয়ে  ফুটু মামা আসেন তাঁদের হাতল ভাঙ্গা একটি স্যুটকেস নিয়ে। খালা বাড়ির পাশে টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবনে পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটি। সেখান থেকে গুলি করে আমাদের বাড়ির পেছনে লালদিঘীর পাড়ে একজন মানুষকে  মেরে ফেলা হয়েছে। কেউ ভয়ে লাশের কাছে যাচ্ছে না। আমাদের দোতলার পশ্চিমদিকের নির্মীয়মাণ ঘরের দেয়ালের ফকোড় দিয়ে তাকিয়ে লাশটাকে পড়ে থাকতে দেখেছি। উপরের ঘর থেকে নেমে গিয়ে সবাই নিচের সদর ঘর (ড্রইং রুম) ঠাঁই নিয়েছে। কাননদের দুই ঘর আর আমাদের সদর ঘর মিলে তিনটি রুমে তিনটি পরিবার গাদাগাদি করে কয়েকদিন থেকে, একটা বাস ভাড়া করে আমরা গ্রামে পালিয়ে গেছি।
যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। শ্যাখ সাহেব অথবা মজিবার বড়দের আলোচনায় আসছেন, গভীর শ্রদ্ধার সাথে। আমরা লোকটাকে চিনিনা। কিন্তু বড়দের কথাবার্তায় মনে হয়, মজিবারের জন্যে তারা যে কোন কিছু করতে প্রস্তুত। মজিবার বললে সব কিছু সম্ভব। মাঝে একবার হিজরতের পর, আমরা ডিসেম্বরের শেষের দিকে  পুরোপুরি বাসায় ফিরে এলাম। জানুয়ারিতে কোন পরীক্ষা ছাড়াই আমরা ক্লাশ টু তে উঠে গেলাম।
কয়েকদিন পর হঠাৎ করে ঠিক আগের বছরের মত গোলাগুলির শব্দে আমাদের ঘুম ভেঙে গেল। আমি আর বাবুল মা’র দুই পাশে ঘুমাতাম। ভয়ে আমাদের চিৎকার দিতে ইচ্ছে করলেও আগের বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে হাত দিয়ে মুখ চাপা দিয়েছি। শব্দ যেন না হয়। তখন বাসায় টেলিফোন নেই। আব্বাও জানতে পারছেন না কোথায় কী হচ্ছে। দাদা ভাই, মেজ ভাই ঘুম থেকে উঠেছে। কিন্তু কেউ বুঝতে পারছে না গোলাগুলির কারণ। কখনও থেমে থেমে কখনও একটানা গুলি হচ্ছে।
সকালে জানা গেল মজিবার দেশে ফিরছেন। মুক্তিযোদ্ধারা তাই রাতভর ফাঁকা গুলি করে তাঁর উল্লাস করেছেন। আতশ বাজীর পরিবর্তে মারণাস্ত্রের আস্ফালন। এক অর্থে সেই বাংলাদেশের প্রথম ফায়ার ওয়ার্ক্স। ট্রেসার বুলেটের আলোর নাচন।
এর ক’দিন পর যশোরে বঙ্গবন্ধু এলেন। সত্যি বলতে কি বঙ্গবন্ধু নামটা তখনও খুব প্রচলিত হয়নি। মজিবার, মুজিব ভাই অথবা শ্যাখ সাহেব নামেই তিনি বাঙালির প্রাণের মানুষ। তাঁকে দেখতে দূর দূরান্ত থেকে মানুষ এসেছে। চর কোটাকোল থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার রাস্তার অর্ধেক বাসে, অর্ধেক পায়ে হেঁটে আমার চাচাতো ভাই জাফর এসে হাজির হলেও মজিবারকে প্রাণ ভরে দেখতে পারেন নি। মজিবারের সভাস্থল যশোর স্টেডিয়াম, স্টেডিয়ামের পাশের বাড়ি ঘরের ছাদ, গাছ পালার ডাল সহ উঁচু প্রতিটি স্থাপনায় মানুষ দখল নিয়েছে, শ্যাখ সায়েবকে একনজর দেখার জন্যে। জাফর ভাই গাছে উঠেছিলেন কিন্তু মিটিং দেখতে পাননি। এক ঝলক দেখতে পায়েছেন উনি সভা শেষে গাড়িতে করে ফিরে যাবার সময়।
যুদ্ধ পরবর্তী অভাব, অব্যবস্থাজনিত হতাশা, আর সাধারণ মানুষের চাওয়া পাওয়ার পার্থক্যের জন্যে মজিবের জনপ্রিয়তা ভাটা পড়তে থাকে। শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে যারা নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত ছিলেন, অথবা যারা নিজেদের প্রতিপত্তিকে শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তার সমানুপাতিক মনে করতেন, তাঁরা নিজেদের স্বার্থে শেখ মুজিবকে দেবতা বানাতে থাকলেন, আর হতাশা থেকে একদল শেখ মুজিবের ত্রুটি খুঁজে বের করতে থাকলেন। তাঁর বঙ্গবন্ধু উপাধি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়া হল। সাধারন মানুষের অনেকেই মজিবারের কাছ থেকে অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। অতিভক্তি আর অভিমানের দোলাচালে আসল মুজিব ঢাকা পড়লেন। অতিভক্তরা যত বেশি করে মুজিব বন্দনা শুরু করলেন, সেই উদ্যোগ ভুল প্রমাণের জন্যে প্রতিপক্ষরা নতুন নতুন ত্রুটি খুঁজতে লাগলেন। অনুযোগ শুরু হল মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব নিয়ে, সেটি গড়ালো বাকশাল প্রতিষ্ঠা, ভারতের তাবেদারি, পাকিস্তান প্রীতি পর্যন্ত।
আমার কাছে মনে হয়, এর প্রতিটিই খন্ডিত উপস্থাপন, অথবা অসম্পূর্ণ উপসংহার। যারা মুক্তিযুদ্ধে শেখ মুজিবের নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তাঁদের জন্যে দু’টি প্রশ্নঃ
১। মুজিবের নেতৃত্ব না মানলে জিয়া কি অন বিহাফ অব আওয়ার গ্রেট ন্যাশনাল লিডার কথাটি বলতেন?
২। শেখ মুজিবের নির্দেশের দোহাই না দিয়ে তাজউদ্দিন কি একা একা মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করতে পারতেন?
যারা ভারতের তাবেদারির কথা বলেন তাঁদের কাছে প্রশ্ন, তাবেদারি করলে কি তিনি ১৯৭২ সালের মার্চ মাসের মধ্যে ভারতীয় সৈন্য ফেরত পাঠাতে পারতেন?
যারা পাকিস্তান প্রীতির কথা বলেন, তাঁরা বঙ্গবন্ধু্র কূটনৈতিক প্রজ্ঞা চোখে দেখেন না। অনুভবও করেন না। পাকিস্তানে ওআইসি সম্মেলনে যোগ দিয়ে তিনি আরব দেশগুলির আস্থা অর্জন করতে পেরেছিলেন এবং একই সঙ্গে পাকিস্তানে বাংলদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সঙ্গীত সম্মানের সাথে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
আমার মনে হয় বাকশাল তিনিই অসময়ে গঠন করেছিলেন। বিজয় অর্জনের অব্যবহিত পরেই যদি তিনি সর্বদলীয় সরকার গঠন করতে পারতেন তাহলে তিন বছর শাসনের পর, তাঁকে অকস্মাৎ এ ধরণের সিদ্ধান্ত নিতে হত না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন মানুষ ছিলেন। নেতা হিসাবে মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা তিনি বুঝতে পারতেন। তিনি দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে একটি জাতিকে স্বাধীনতার জন্যে তৈরি করেছিলেন। কোন রাখ ঢাক না করে যিনি দেশের জন্যে রক্ত চাইবার সাহস রাখতেন (মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো; ৭ই মার্চের ভাষণ) মাত্র ৫২ বছর বয়সে যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি নবীন রাষ্ট্রের দায়িত্ব তাকে নিতে হয়েছিল।
মানবিক দোষ ত্রুটি সত্ত্বেও তাঁর থেকে বড় কোন নেতা বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেননি।
আমার এই লেখা যারা পছন্দ করছেন এবং যারা পছন্দ করছেন না। তাঁদের সবাইকে শেখ মুজিবের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের শুভেচ্ছা।
লেখক: কানাডা প্রবাসী সাবেক সেনা কর্মকর্তা

SUMMARY

2008-1.jpg