বঙ্গবন্ধু যেভাবে গ্রেফতার হলেন

সাইদুল ইসলাম, মিসিসাগা ।।
৩ কমান্ডো ব্যাটালিয়নের সিও লেঃ কর্ণেল জহিরুল আলম খান (জেড এ খান) ভাগ্য খানিকটা মানেন। সব কাজ সবসময় পছন্দ হবেনা এটা তিনি জানেন। তবে সব অপছন্দ কাজগুলি কেন তাঁর কপালে জোটে সেটা তিনি বুঝতে পারছিলেন না। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর কথাবার্তা তার ভালো লাগেনা, অথচ ২৪ মার্চ সকাল এগারোটা থেকে তাঁর অফিসে বসে তাঁর লেকচার শুনতে হচ্ছে। লোকটা টিপিক্যাল আর্টিলারী অফিসার। অভিজ্ঞতা কম নেই জেনারেল সাহেবের, স্পেশাল ফোর্স কমান্ড করেছেন, প্রভোস্ট মার্শাল ছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক সরকারের রাজনৈতিক উপদেষ্টার কাজ করছেন কিন্ত দিলদরাজ হতে পারেননি।
জেড এ খান ১৯৬৫ সাল থেকে আর্টিলারির উপর বিরক্ত। পাক-ভারত যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন তিনি। ফেরার পর ২৩ ক্যাভালরিতে পোস্টিং হল তার। সেখানেই শুনলেন ঠিকমত আর্টিলারি সাপোর্টের অভাবে অনেক অপারেশনই সফল হয়নি পয়ষট্টির যুদ্ধে। গোলা ফুরিয়ে যাবার কারণে আর্টিলারি সাপোর্ট পাওয়া যায়নি। পাকিস্তানের পরাজয়ের সেটি একটি বড় কারণ। সেই থেকে আর্টিলারি কোরটাকেই অপছন্দ করা শুরু করেছেন তিনি।
প্রথমে হেসে হেসে কথা বললেও আস্তে ধীরে সিরিয়াস হতে থাকলেন রাও ফরমান আলী। বাতচিত আর একটু এগোনোর পর “মুজিবকো পাকাড়না হোগা” বলে যেভাবে খানের  দিকে তাকালেন, তার মনে হলো রাও যেন তাকে বাজিয়ে দেখতে চাচ্ছেন। তিনি সে পরীক্ষার সুযোগ না দিয়ে “রাইট স্যার” বলে স্যালুট দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিলেন। জেনারেল বললেন, “ডোন্ট ইউ ওয়ান্ট টু নো হাউ ইউ শুড ডু ইট?”
জেড এ খানের মনে হলো বড় বেশি স্পুন ফিডিং হয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটা। বাইশ বছর ধরে ইউনিফর্ম পরছেন তিনি। স্পেশাল সাপোর্ট গ্রুপের (এসএসজি) প্রথম তিনটি কোম্পানির একটি তার হাতে গড়া।গত বছর যখন তাকে ৩ কমান্ডো ব্যাটালিয়নের দায়িত্ব দেওয়া হল, চট্টগ্রামে সিভিলিয়ানদের সাথে ঝামেলায় জড়িয়ে ইউনিট তখন হতদ্যম। কাপ্তাইয়ে একটি মানুষ খুনের ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে যা তা অবস্থা। সেখান থেকে তিনি থ্রি কমান্ডোকে টেনে তুলেছেন। মাত্র দুই কোম্পানি সৈন্য দিয়ে অসাধ্য সাধন করছেন। কুমিল্লা বিমান বন্দরের নিরাপত্তা, আইন শৃংখলা রক্ষার দায়িত্ব, এমন কি ঢাকাতেও তাকে লোক পাঠাতে হয়েছে ৫৭ ব্রিগেডকে সহায়তা করতে। আর তাকেই কীনা বলা হচ্ছে, “ডোন্ট ইউ ওয়ান্ট টু নো হাউ শুড ইউ ডু ইট?” মেজাজ অনেক কষ্টে  ঠান্ডা রেখে তিনি বললেন, “এতদিন তো জানতাম অর্ডার দেওয়া কমান্ডারের কাজ, আর এক্সিকিউশন কী ভাবে হবে সেটি আন্ডারকমান্ডের ব্যাপার। ঠিক আছে স্যার, ইফ ইউ হ্যাভ এনি ডাইরেক্টিভ প্লিজ টেল।” 
রাও ফরমান আলী যা বললেন তাতে তার মেজাজ আরও খারাপ হয়ে গেলো।
“এভাবে করা অসম্ভব, আপনি যাকে ইচ্ছা তাকে দিয়ে করান, আমি পারবোনা বলে স্যালুট দিয়ে তিনি অফিস থেকে বেরিয়ে এলেন।”
৩ কমান্ডো ব্যাটালিয়নের জঙ্গু কোম্পানী কমান্ডার মেজর বিলাল অফিসের কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। সিওকে চোখ মুখ লাল করে বেরিয়ে আসতে দেখে কাছে যাবেন কি যাবেন না ভাবছিলেন। জেড এ খান তাকে বললেন,
“হুকুম সোনা তুম?”
“নেহি স্যার”
“হি হ্যাজ অর্ডার্ড মি টু এরেস্ট শেখ মুজিব”
“এক্সকিউজ মি স্যার, আমি যত দূর জানি দ্যাটস দ্য রিজন ইউ কেইম টু ঢাকা। কর্নেল আহমেদ তো কাল সে কথাই বললেন। তারপর আমরা মুজিবের বাড়ির আসে পাশে রেকি করলাম।“
“ইউ আর নট গেটিং দ্য পয়েন্ট।”
সিওর কথা বুঝতে না পেরে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন বিলাল। জেড এ খান বললেন, “ইউ আর নট রং। আমি তো ফর্মাল অর্ডার নিতেই ওনার কাছে গিয়েছিলাম। উনি বললেন, ইট শুডন’ট লুক লাইক এ মিলিটারি অপারেশন। আমি একটা সিভিল ট্রান্সপোর্টে শেখ সাহেবকে উঠিয়ে নিয়ে আসবো।”
অবাক হলেন বিলাল। “স্যার, কাল রেকির সময় যা দেখেছি, মনে হচ্ছে এভাবে এরেস্ট করা সম্ভব হবেনা”
“ইউ আর রাইট। আমি সেকথাই ওনাকে বলেছি, উনি বলেছেন আমি ডরপোক আছি। আই ডোন্ট ডিজার্ভ টু কমান্ড এ কমান্ডো ব্যাটালিয়ান।”
“স্যার উনি ৩২ নম্বরে গেলে বুঝতে পারতেন। একদিকে লেক, আর দুই দিকে বড় দু’টো রাস্তা। রাস্তায় তো সারাদিনই বাঙালিরা গিজ গিজ করছে। মুজিবের বাড়িতেই তো বিশ পচিশ জন লোক থাকে, পুলিশ থাকে পাহারায়, এর মধ্যে….”
“আমি তো সেটাই ওনাকে বুঝাতে চাইলাম। ইউ হ্যাভ গিভন মি টাস্ক, মাই জব ইজ টু একমপ্লিশ ইট। কিভাবে করবো, সেটা আমার ব্যাপার। আমি খালি ভাবছি উনি এত বছর ধরে এদেশে আসা যাওয়া করছেন, বাঙালিদের মতলব বুঝতে পারছেন না কেন?”
কথা ঘুরাতে চাইলেন বেলাল। জেড এ খানের সাথে তাঁর জানাশোনা নতুন নয়।সিওর সাত  সাতটা ভাই ডিফেন্সে। কেউ আর্মি, কেউ নেভী আর কেউ এয়ারফোর্সে। কনভেণ্টে লেখা পড়া করা আর্মার্ড কোরের এই অফিসারের সাথে কেউ সচরাচার পাঙ্গা নেয় না। কিন্তু তিনি কাউকে ছেড়ে কথা বলার পাত্র নন। বেলাল বললেন, “স্যার, প্রায় লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে চলেন মেসে যাই।”
মুচকি হাসলেন জহিরুল আলম। “ইউ হ্যাভ রিয়েলি বিকাম স্মার্ট। আমি জেনারেলকে বলে এসেছি, আই এম নট ডুয়িং ইট।”
সিওর ভবিষ্যতের কথা ভেবে শংকিত হয়ে পড়লেন বিলাল। সিওর এধরণের ঘাওড়ামির কথা আগেও শুনেছেন বেলাল। কিন্তু তাই বলে রাও ফরমান আলীর মত জাঁদরেল জেনারেলের সাথে!
বিলালের চিন্তাটা মনে হয় পড়তে পারলেন জেড এ খান। বললেন,
“গত বছর মে মাসে আমি যখন আসি তখনকার বাঙালিদের সাথে এখনকার বাঙালিদের অনেক পার্থক্য। ভোটের পর কি হয়েছে দ্যাখো। বাঙালিদের কথা কী বলবো, বাসায় আমার আড়াই বছরের মেয়েটা পর্যন্ত জয় বাংলা বলতে বলতে ঘরময় ছোটাছুটি করে। আর কাল কী হয়েছে দ্যাখো, আমি তো খবর পেলাম কুমিল্লায় সি ১৩০ নামার পর। তাড়াহুড়ো করে এয়ারপোর্টে আসছি, পাঁচ ছ’বছরের এক ন্যাংটো ছেলে ওর মায়ের সাথে যাচ্ছিল। আমার গাড়ি দেখেই ছোঁড়া দাঁড়িয়ে স্লোগান দিতে থাকলো জয় বাংলা বলে। সিচুয়েশন কতখানি বদলেছে স্যার বুঝতে পারছেন না।”
বিলাল শুধু চুপ চাপ শুনতে লাগলেন। তাঁর কোন সাড়া না পেয়ে খান বললেন,
“তুমি চিন্তা করোনা। আমার কিছুই করতে পারবেনা বুড়া মিয়া।”
কিন্তু জেড এ খানকে খুব কনফিডেন্ট মনে হলো না। যেন ঝোঁকের মাথায় জেনারেলের সাথে বেয়াদবি করে ফেলে এখন বাস্তবতা বুঝতে পারছেন। বিলাল বললেন,
“স্যার কিউএমজি তো আপনার সিও ছিলেন এসএসজিতে, আজ ওনার আসার কথা, একবার কথা বলবেন নাকি?”
বিলালের কথাটা মনে ধরলো তার। আজকাল জুনিয়ার অফিসাররা কতদিকে যে খেয়াল রাখে! একটিই সমস্যা, কিউএমজি আসবেন বিকেল পাঁচটার দিকে। এই দুই তিন ঘন্টা রাও ফরমান আলীর নাগালের বাইরে থাকতে হবে।
প্রতীক্ষার অবসান ঘটলো এক সময়। PIA ফ্লাইট থেকে নেমে এসএসজির পুরনো অফিসার জহিরুল আলমকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাঁর দিকে এগিয়ে গেলেন মেজর জেনারেল আবু বক্কর ওসমান মিঠা। হাত মেলাতে মেলাতেই জেডএখান কিউএমজিকে বললেন তাঁর সমস্যার কথা। মিঠা তাঁকে গাড়িতে উঠিয়ে নিলেন। পথেই আলাপ সালাপ হয়ে গেলো। তিনি নেমে যাবার সময় বললেন, “মিট মি টুমরো অ্যাট নাইন, অ্যাট ইস্টার্ণ কমান্ড হেডকোয়ার্টারস।“
সকালে মিঠার সাথে দেখা করতে ইস্টার্ণ কমান্ডের কর্ণেল জিএস কর্ণেল আকবরের রুমে ঢুকে তিনি আবার ঝামেলায় পড়ে গেলেন। সেখানে রাও ফরমান আলী বসে ছিলেন। জেডএ খানকে দেখেই তিনি আকবরকে বললেন,
“আর্মি এভিয়েশনের কাছে একটা এয়ারক্রাফট চাও, পনর মিনিট পর আমি আর জেড এ খানকে ঢাকায় দেখতে চাইনা।” 
দুই 
২৫ শে মার্চ সকাল সাড়ে এগারো। লেঃ কর্ণেল জহির আলম চীফ অব স্টাফের ওয়েটিং রুমে বসে বার বার ঘড়ি দেখছিলেন। কিউএমজি তাঁকে ওয়েটিং রুমে বসতে বলে ভিতরে ঢুকেছেন অনেকক্ষণ আগে। সেনাপ্রধানের সাথে এর আগে দু’একবার দেখা হয়েছে তাঁর কিন্তু সেটা না হবার মত। হয়তো তিনি কোন ভিজিটে এসেছেন, সেখানে শ’খানেক অফিসারের মধ্যে জেড এ খানও ছিলেন। তিনি সেনাপ্রধানকে কি বলবেন মনে মনে সে সব গুছিয়ে নিচ্ছিলেন। তার মধ্যেও ফাক ফোকর দিয়ে ঢুকে পড়ছিলো রাও ফরমান আলীর চিন্তা। গতকাল রাও ফরমান আলীর খানের সাথে তিনি যা করেছেন ভালো করে লক্ষ্য করলে সেটা ইন সাবঅর্ডিনেশনের পর্যায়ে পড়ে। একেবারে কোর্ট মার্শাল যোগ্য অপরাধ। রাও যে কত খানি ক্ষেপে আছেন তা বোঝা গেছে আজ সকালের আচরণে। সময়মত হেলিকপ্টার পাওয়া গেলে তিনি এতক্ষণ থাকতেন কুমিল্লায়। কর্ণেল আকবর যখন রাওকে বললেন, স্যার, ঘন্টা খানেকের আগে হেলিকপ্টার পাওয়া যাবেনা, তখন তাঁর চেহারা হয়েছিলো দেখার মত। মনে হচ্ছিলো রাও জহিরকে দৃষ্টি দিয়ে ভষ্ম করে দেবেন।বাঁচতে হলে মিঠার সাথে দেখা করতেই হবে। তিনি নতুন গভর্ণর জেনারেল টিক্কা খানের অফিসে। জহির টিক্কা খানের অফিসের দরজার দিকে তাকিয়ে বসে রইলেন। রাও ফরমান আলী আর তার মধ্যের তিক্ততা দু’জনের মধ্যে পর্দার মত ঝুলে রইলো।
মিনিট পনর পর মিঠা বের হওয়ার সাথে সাথে প্রায় লাফিয়ে ঘর থেকে বেরুলেন জহির। তারপর মিঠা তাকে গাড়িতে উঠিয়ে সেনা প্রধানের কাছে নিয়ে এসেছেন তাও প্রায় ঘন্টাখানেক।
অবশেষে ডাক এলো লেফটেন্যান্ট জেনারেল আব্দুল হামিদ খানের কাছ থেকে। কার্যত তিনি সেনাপ্রধান হলেও তার অফিসিয়াল এপয়েন্টমেন্ট পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ভাইস চীফ। দু’বছর আগে আইয়ুব খানকে সরিয়ে যেদিন ইয়াহিয়া মসনদে বসলেন সেই একইদিনে আব্দুল হামিদ খান নিয়োগ পেলেন ভাইস চীফ হিসেবে।ইয়াহিয়া একাধারে কমান্ডার ইন চীফ, সেনা প্রধান ও রাষ্ট্রপতি । তিনি স্বেচ্ছায় সরে না দাঁড়ালে হামিদ সাহেবকে ভাইস হিসেবেই থাকতে হবে।
জহির এতক্ষণ সেনা প্রধানের সাথে কথা বলার জন্যে মনে মনে যে সব প্রস্তুতি নিয়েছিলেন তেমন কাজে লাগলো না। সেনাপ্রধান প্রথমে তাঁকে আগ্রহ নিয়ে দেখলেন। সরাসরি দু’একটা কথাও বললেন। তারপর তিনি ভাব বাচ্য ধরলেন। বেশির ভাগ কথা হলো সেনা প্রধান আর কিউএমজির মধ্যে।
জহিরের মনে হলো, মিঠা আগেই হামিদ খানকে ব্রিফ করেছেন। গাড়িতে আসার পথে তিনি মিঠাকে অপারেশন প্ল্যানসহ যা যা বলেছিলেন দেখা গেলো, ভাইস চীফ তার অনেক কিছুই জানেন। একটু পর হামিদ বললেন, গো এন্ড মিট জেনারেল রাও ফরমান আলী, আস্ক হিম হোয়াট ইউ ওয়ান্ট। বাট ক্যাচ হিম এলাইভ।
জহির বুঝলেন শেষের বাক্যাটা মুজিবের জন্যে বলা। তিনি বেড়িয়ে যাবার সময় সেনাপ্রধান তাঁকে নাম ধরে ডাকলেন, জহির! রিমাইন্ডিং য়ু এগেইন, ইফ মুজিব গেটস কিল্ড, য়ু’ল বি হেল্ড রেস্পন্সিবল।
এবার রাও ফরমান আলী প্রায় নির্লিপ্ত আচরণ করলেন। জেড এ খান বললেন, স্যার ইউনইটেড ব্যাংকের দু’টি কার নিয়ে আমরা ২৩ তারিখে রেকি করে দেখেছি, কমপক্ষে তিন প্লাটুন ট্রুপস ছাড়া এই অপারেশন সফল হবে বলে মনে হয়না।
মুজিবের বাড়ির চারদিকের ক্রাউড কন্ট্রোল করা ছাড়াও ইম্পর্ট্যান্ট একটা ব্যাপার হচ্ছে ওনার বাসার পাশের জাপানি ডিপ্লোম্যাটের বাসায় সার্ভিলেন্স বসানো। যদি মুজিব দেয়াল টপকে ওই বাসায় ঢুকে যান, তাহলে অপারেশন ওখানেই শেষ। ওই দিকটায় স্পেশাল নজরদারি করতে হবে। রোড ব্লক, কর্ডন, সার্চ এসবের জন্যে লোক লাগবে। সো মিনিমাম রিকয়রমেন্ট ৩ প্লাটুন। সেই সাথে ৩টি ট্রুপ্স ক্যারিং ট্রান্সপোর্ট।
রাও বললেন, এগুলো কোন সমস্যা নয়। বাট হাউ আর ইউ গোয়িং টু এক্সিকিঊট দ্যা প্ল্যান?
জেড এ খান দেখলেন সেই একই প্রশ্ন। গতকালের ঝামেলার সূত্রপাত হয়েছিলো এই প্রশ্ন দিয়েই। জহির আজ আর মাথা গরম করলেন না। বললেন, আমি একটা প্ল্যান করেছি, মে আই ডিস্কাস দ্যাট?
রাও কোন উত্তর দিলেন, ‘না’।
জহির বললেন, দু’টো রোডব্লক হবে, মিরপুর রোড দিয়ে ধানমন্ডিতে ঢোকার মুখে মানে ধানমন্ডি – মোহাম্মাদপুর রোডের মাথায় একটি, আর এই রোডেরই আরও সামনে গিয়ে সেকেন্ড টার্নিং-এ একটি। মুজিবের বাড়ি যারা কর্ডন করবে তারা জাপানি ডিপ্লোমাটের বাড়ির সাথে মুজিবের বাড়ির যে ওয়াল সেটার দিকে খেয়াল রাখবে। শেখ যেন দেয়াল টপকে এদিকে আসতে না পারে। আর এক প্লাটুন টর্চ নিয়ে বাড়ির উপর তলা নিচতলা ভালোভাবে সার্চ করবে।
এতক্ষণে মুখ খুললেন রাও, আর তোমরা এসেম্বল হচ্ছো কোথায়?
– স্যার, এয়ার ফিল্ডের আউটার পেরিমিটারে এমএনএ হোস্টেলের দিকে এয়ার পোর্টের যে গেট আছে তার কাছে।
– দেন?
– আমরা এখান থেকে ন্যাশনাল এসেম্বলির সামনে দিয়ে আইয়ুব গেইট- মোহাম্মাদপুর হয়ে ধানমন্ডি যাবো।
– সাউন্ডস অল রাইট।
– স্যার, আ’ল ব্রিফ মাই অফিসার্স অন মডেল আফটার ইভনিং মিল। য়ু’ল নট মুভ আউট বিফোর নাইন থার্টি।
রাও কোন কিছুর সাথে দ্বিমত করলেন না।
তিন 
রাত সাড়ে ন’টার দিকে অফিসের বাইরে অস্ত্রের মুখে কাউকে দাঁড় করিয়ে রাখতে দেখে একটু অবাক হলেন ৪৩ লাইট একেক রেজিমেন্টের সিও লেঃ কর্ণেল সাফাত আলী। অপারেশন সার্চলাইট শুরু হতে বেশি দেরি নেই, তিনি এসেছেন শেষবারের মত প্রস্তুতিটা দেখে নিতে। তাঁর ইউনিটকে দেওয়া হয়েছে, এয়ারপোর্টের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব। সার্চলাইটের আলোয় অফিসের সামনেটা একেকবার আলোকিত হচ্ছে। এই মায়াবী আলোয় দূর থেকে মানুষটাকে খানিকটা জেড এ খানের মত মনে হচ্ছে ভেবে তিনি মনে মনে হাসলেন।
আপাত দৃষ্টিতে এয়ারপোর্টের নিরাপত্তা রক্ষা করার মধ্যে কোন চ্যালেঞ্জ নেই। এতো সিভিলিয়ানরাই পারে। তেজগাঁর নিরাপত্তা ব্যবস্থা কোন কালেই ভালো ছিলোনা। শহরের এদিকটায় জনবসতি কম। রাতের বেলা তো প্রায় জনশূণ্য মনে হয়। সমস্যা হচ্ছে এত বড় এয়ারফিল্ডের প্রতিটা ইঞ্চি নজরদারিতে রাখা। নিচু পাঁচিল টপকে এয়ারফিল্ডে ঢুকে পড়া কোন ব্যাপারই না। মার্চের শুরু থেকে বাঙালি বিষ্ফোরণ্মুখ হয়ে আছে, এসব ভাবতে ভাবতে অফিসের সামনে পৌছাবার আগেই  চিৎকার শুনে থেমে যেতে হলো, সাফাত! হোয়াট দ্য হেল!
সাফাত আলী বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন, সত্যিই তো জেড এ খান! মনে মনে প্রমাদ গুনলেন তিনি। ৩ কমান্ডোর সিও লেঃ কর্ণেল জেড এ খানের চেয়ে মেজাজি অফিসার খুব বেশি নেই। কিন্তু কথা হলো তিনি এখানে কী করছেন! আর সান্ত্রীই বা তারদিকে  রাইফেল উচিয়ে রেখেছে কেন? সাফাত প্রায় দৌড়ে গেলেন সান্ত্রীর দিকে, “এই তুমি করছো কী!  অস্ত্র নিচে! আগে অস্ত্র নিচে কর। তুমি স্যার কে চেনোনা? সরি স্যার, ‘য়্যাম এক্সট্রিমলি সরি।“
জহির গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে থাকলেন, সাফাত বুঝলেন সান্ত্রীর সামনে কিছু না বললেও স্যার তাকে পরে ধরবেন। এই উটকো ঝামেলার জন্যে তার রাগ হলো সান্ত্রির উপর। তিনি বললেন, ”কর্ণেল সাবকে চিনোনা বুঝলাম, ওয়ার্দি দেখেও ঢুকতে দাওনি কেন?”
পাঠান সৈনিক বুক টান করে বলল, “স্যার আদেশ হয়েছে, পাস ওয়ার্ড ছাড়া মশা মাছিও যেন ঢুকতে না পারে। স্যার গলত পাস ওয়ার্ড দিয়েছেন”।জেড এ খান বললেন, ”লিভ হিম”। সাফাত জহিরকে নিয়ে অফিসে ঢুকলেন,
 “কি খবর স্যার এত রাতে!”
“তুমিও তো”
“ইউ নো দ্যা রিজন, বাট আপনি যাচ্ছেন কোথায়?”
“দ্যাট’স নান অব য়োর বিজনেস, আই নিডেড টু ক্রস দ্যা এয়ারফিল্ড, বাট দ্যাট গুফ হ্যাজ গুফড ইট আপ”।
“সো… সরি স্যার”
“সরি কা বাত নেহি হ্যায়, আই গেভ দ্য পাস ওয়ার্ড, বাট দ্যা সেন্ট্রি সেইড দ্যাট রং।“
একটু লজ্জিত হলেন সাফাত। পরে দেখা গেলো সাফাতের ইউনিটকে অন্য পাস ওয়ার্ড দেওয়া হয়েছে। জহির বললেন, “তোমার সেন্ট্রিকে কিছু বলোনা। হি ডিড দ্যা রাইট থিং, বরং ওকে শাবাশি দেওয়া উচিত”।
সাফাত হাসলেন, “কিন্তু স্যার দুই রকম পাসওয়ার্ড দেয়ার কারন বুঝলাম  না”। জহির বললেন, “লেট মি একমপ্লিশ মাই টাসক ফার্স্ট, দেন আই উইল আস্ক দেম”।
সাফাত আর তাঁতালেন না জহিরকে। কফি খেতে খেতে একটু আলোচনা হলো দু’জনের। সাফাত বললেন, “সব ঠান্ডা হবে তো স্যার?”
জহির বললেন, “ঠিক মত করতে পারলে হবে। সব ইউনিট তো একসাথে নামছে, ২২ বালুচ পিলখানা কন্ট্রোল করবে, ৩২ পাঞ্জাব রাজারবাগ আর ১৮ পাঞ্জাব মোহাম্মাদপুর, মিরপুর  সোজা করে ফেলবে। ১৫/২০টা চাঁই ধরতে পারলেই তো হয়”।
আর কথা না বাড়িয়ে তিনি রওনা দিলেন গেটের কাছে। সেখানে অন্য সবার জড়ো হবার কথা। তিন প্লাটুন সৈন্যের হিসাব করলেও তিনজন অফিসারসহ তার সৈন্য আসলে ৬৫ জন। রাইফেল এসএমজি ছাড়া ভয় দেখানোর মত অস্ত্র আছে রকেট লাঞ্চার। ১৯ সিগন্যাল রেজিমেন্ট থেকে তিনটি ট্রাক দেওয়া হয়েছে যাওয়া আসার জন্যে।
সন্ধ্যার ব্রিফিঙে খান সাহেব প্রত্যেককে যার যার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।
ক্যাপ্টেন সাইদের কাজ  হচ্ছে পঁচিশ জন লোক নিয়ে শেখের বাড়ির দুইপাশে রোড ব্লক তৈরি করা।
ক্যাপ্টেন হুমায়ুনের দলেও ২৫ জন, তাদের কাজ হচ্ছে শেখ মুজিবের বাসার সামনের দিক থেকে গিয়ে জাপানী ডিপ্লোম্যাটের বাড়ির ভিতর দিকের পাঁচিল টপকে শেখের বাড়ি ঢোকা, মোট কথা বাড়িটাকে ঘেরাও করা।
মেজর বিলালের সাথে যে ১২ জন থাকবে তাদের প্রত্যেকের হাতে টর্চ থাকতে হবে। এই গ্রুপের প্রধান কাজ হচ্ছে পুরো বাড়ি তল্লাসী।
ব্রিফিঙের পরপরই ক্যাপ্টেন হুমায়ুনকে ধানমন্ডি পাঠানো হল টার্গেট এলাকা রেকি করার জন্যে। একটু পরে হুমায়ুন ফিরে এসে জানালেন, রাস্তায় গাড়ি চলাচল কঠিন হয়ে পড়ছে। অনেক রোড ব্লক, ব্যারিকেড…
“কি রকম বারিকেড?” জানতে চাইলেন জহির।
“ব্যারিকেডের নির্দিষ্ট কোন ধরণ নেই। কোন জায়গায় ট্রাক দিয়ে রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, আবার অনেক জায়গায় দেখছি কংক্রিটের ভারি পিলারের মত খাড়া করেদিয়েছে। ইভন দেয়ার আর বার্বড ওয়্যার ইন সাম প্লেসেস।“
“পাব্লিক কেমন রাস্তায়?”
“অনেক, তারাইতো এসব করছে”
কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন জেড এ খান। ব্যারিকেডের ব্যাপারটা তাকে অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে।  অপারেশন সার্চলাইটের এইচ আওয়ার রাত বারোটায়। অতক্ষণ অপেক্ষা করলে ব্যারিকেডের সংখ্যা আরও বেড়ে যেতে পারে। তিনি অফিসারদের ডেকে বললেন, “টু আউট স্মার্ট দ্যা ট্রিকি বেঙ্গালিজ আই হ্যাভ টু চেঞ্জ দ্য এইচ আওয়ার”।
সিও’র কথার উত্তর দিলোনা কেউ। জহির বললেন, “এইচ আওয়ারটা ঘন্টা খানেক এগিয়ে আনলে সম্ভবত  উই উইল ফেইস লেস রেজিট্যান্স”। এবারও কেউ উত্তর দিলো না।
জহির বললেন, “ দ্য নিউ এইচ আওয়ার ইজ  টুয়েন্টি থ্রি হান্ড্রেড আওয়ার্স”।
রাত এগারোটার একটু আগে লেঃ কর্ণেল জহির এয়ারপোর্টের দক্ষিন পশ্চিম দিকের পকেট গেটের কাছে জঙ্গু কোম্পানির দল তিনটির সাথে চুড়ান্ত কথা বার্তা বললেন। কোম্পানির সবগুলি রকেট লাঞ্চার দিয়ে দেয়া হলো ক্যাপ্টেন সাইদের দলের সাথে। তিনি  সাইদের দলকে  বললেন, “রোড ব্লক সামনে পড়লে রকেট লাঞ্চার মাঝে রেখে এক্সটেন্ডেড ফর্মেশনে রাস্তা জুড়ে দাঁড়াবা। প্রথমে রোড ব্লকের মাঝ বরাবর রকেট লাঞ্চার ফায়ার করবা। এর সাথে সাথে অন্য সবাই ফায়ার করতে করতে এগিয়ে যাবা।“
কাটায় কাটায় রাত এগারোটায় রওনা হলো ৩ কমান্ডো ব্যাটালিয়নের জঙ্গু কোম্পানি। নামে কোম্পানি হলেও দলটি ঠিক কোম্পানির মত হলোনা। ৪ জন অফিসারসহ মোট জনবল হলো ৬৭ জন। আধা কোম্পানিরও কম জনবলের এই বহরের নেতৃত্বে রইলেন জহির নিজে।
জনশূন্য এয়ারপোর্টের কোনা থেকে এমএনএ হোস্টেলের ঘর ভর্তি অন্ধকারের সামনে দিয়ে অত্যন্ত ধীর গতিতে চলতে শুর করলো চার গাড়ির কমান্ডো বহর। সবার আগে হেডলাইট জ্বালিয়ে চলছে সিওর জীপ। পেছনের ট্রাক তিনটির হেডলাইট বন্ধ। সিও’র জীপের পিছনে ক্যাপ্টেন সাইদের ট্রাক, তারপর ক্যাপ্টেন হুমায়ুনের দল আর সবশেষে মেজর বিলাল চলেছেন ১২ জন বাঁছাই করা সৈন্য নিয়ে।জীপের আলোয় রাস্তার দু’পাশের বাতিহীন লাইটপোষ্ট গুলোকে  লাগছে বাজে পোড়া তাল গাছের মত। তাদের লম্বা ছায়াগুলো রাস্তার দু’পাশে একেকবার লম্বা দাগের মত ভেসে উঠছে। গাড়ি যাচ্ছে অনেকটা গড়িয়ে চলার মত। মাত্র ২০ মাইল গতিতে। সিও জেড এ খান বলেছেন সবাইকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে। গতি বেশি হলে অনেক কিছু চোখ এড়িয়ে যায়।
আইয়ুব গেট পর্যন্ত পৌঁছে বায়ে মোড় নিয়ে কিছুদূর এগিয়েই আটকে গেল গাড়ির বহর। কতগুলো  ট্রাক, দু’তিনটা কার আর অন্যান্য যান আড়াআড়িভাবে রেখে রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। জহির রাস্তার পাশে জীপ থামিয়ে সাইদকে থামতে বললেন। সাইদের গাড়ি থামতে না থামতেই লাফিয়ে নামলো ট্রাকের যাত্রীরা। মুহুর্তের মধ্যে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে গুলি ছোড়া শুরু করলো।
পেছনের ট্রাকগুলিও ততক্ষণে থেমে গেছে। তারাও গুলিছোঁড়া শুরু করলো সাইদের দলের দেখাদেখি। মিনিট দুই-তিন গোলাগুলির পর জহির গুলি থামাতে বললেন।
তাঁর আদেশ সবার কাছে পৌঁছালোনা। জহির আর অন্য অফিসাররা সৈনিকদের দিকে ছোটাছুটি করে গুলি থামালেন। এই আকষ্মিক আক্রমণে রোডব্লকের আশেপাশের মানুষ ছুটে পালালো। কিন্তু গাড়ি যাবার মত জায়গা ফাঁকা হলোনা।
এতক্ষণে ট্রাকের সাথের উইঞ্চ আর তার সাথের কেবল চোখে চোখে পড়লো জহিরের। রোড ব্লকের গাড়িতে কেবল বেধে উইঞ্চ দিয়ে টেনে সরিয়ে ট্রাক যাবার জায়গা করে, আবার শুরু হলো অগ্রযাত্রা। তবে মাত্র দুইশ’ গজ দূরেই আবার থামতে হলো। এবার বড় বড় কংক্রিটের পাইপ দিয়ে রাস্তা বন্ধ করা হয়েছে। আগের মতই ক্লিয়ার করা হল এবারের ব্লক। আবার দুইশ’ গজ দূরে পাওয়া গেলো আরেকটি ব্লক। গাদা করে ইট রেখে তৈরি করা হয়েছে এবারের ব্লক। জহির কিছু লোককে লাগালেন ইট সরানোর কাজে বাকি লোককে পায়ে হেঁটে সামনে আগাতে বলা হলো।
শেখ মুজিবের বাড়ির কাছে পৌঁছানোর পর, হুমায়ুনের গ্রুপ প্রথমে দৌড়ে পাশের বাড়িতে ঢুকে পড়লো। তারপর তারা বাড়ির পাঁচিল টপকে শেখ মুজিবের বাড়ি ঢুকেই গুলি করা শুরু করলো। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে গেলো মুহুর্তেই, ৩২ নম্বরের বাড়িসহ আশেপাশের বাড়িতেও সাড়াশব্দ পাওয়া যেতে লাগলো। ৩২ নম্বর বাড়ির নিচতলা থেকে অনেকেই ছুটে বেরিয়ে গেলেন। গুলিতে মারা পড়লেন একজন। শেখ মুজিবের বাড়ির বাইরে পাহারারত পুলিশও পালাতে লাগলো। মেজর বিলালের তল্লাশি দল কাজে লেগে গেলো সাথে সাথেই। শেখ মুজিবের বাড়ির একজন প্রহরীকে বাইরে আনার সময় হঠাৎ আত্মরক্ষার্থে দা বের করতে গিয়েছিলেন তাকে পিছন থেকে গুলি করলো বিলালের দলের একজন।
তল্লাশির সময় নিচতলায় আর কাউকে পাওয়া গেলোনা। জহির নিজেও ততক্ষণে পৌঁছে গেছেন, বিলালকে নিয়ে তিনি উপরে উঠলেন। একটি ঘর ভেতর থেকে আটকানো পাওয়া গেলো। বিলালকে দরজা ভাংতে বলে জহির নিচে নেমে এলেন, রাস্তায় জনতার কোন প্রতিরোধ আছে কিনা দেখার জন্যে। নিচে এসে ক্যাপ্টেন সাইদকে পাওয়া গেলো, তিনি জানালেন, ট্রাকগুলো ছোট রাস্তায় ঢুকতে গিয়ে আটকে গেছে। এর মধ্য ককটেলে এবং গ্রেনেড বিষ্ফোরণের শব্দ শোনা গেল। বাসার ভেতর থেকে গোলাগুলির শব্দও শোনা যেতে লাগল। জহির ভয় পেয়ে  গেলেন। শেখ মুজিবকে মেরে ফেলা হয়নিতো। তিনি দৌড়ে ভিতরে এসে শেখ মুজিবকে দেখতে পেলেন।শেখ সাহেব বললেন, “এসবের মানে কী? আমাকে বললেই তো হত”।
জহির বললেন, “আমরা আপনাকে বিশ্বাস করিনা। তাছাড়া আপনাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে দেখালে  আখেরে আপনার লাভও হতে পারে।“
শেখ বললেন, “আমি, পাইপ ফেলে এসেছি, সেটা কি আনতে যেতে পারি? জহির বললেন, “অবশ্যই, আপনি পরিবারের কাছ থেকে বিদায়ও নিয়ে আসতে পারেন”।
শেখ মুজিব ফিরে আসার পর তাঁকে পিছনের একটি ট্রাকে সৈনিকদের সাথে বসানো হল। জহিরের বেতার বার্তা The Big bird has been caged কিছুক্ষণের মধ্যেই ইস্টার্ণ কমান্ড হেড কোয়ার্টারে পৌঁছে গেলো।
জহির শেখ মুজিবকে নিয়ে ন্যাশনাল এসেম্বলি ভবনের সিঁড়িতে বসিয়ে রাস্তার খোঁজ খবর নিতে থাকলেন। ফার্মগেটের দিক থেকে তখন হাজার হাজার মানুষের চিৎকার ভেসে আসছে। রাস্তার দিক থেকে ভেসে আসা জনতার গর্জন একটু পরে ঢাকা পড়ে গেলো ফায়ারিং এর শব্দে, এর মধ্যেই জহির রওনা দিলেন ইস্টার্ণ কমান্ড হেড কোয়ার্টেরে। ব্রিগেডিয়ার গোলাম জিলানী খান ইতমধ্যে ইস্টার্ণ কমান্ডের চীফ অব স্টাফের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। তিনি জেড এ খানকে বললেন গভর্ণর জেনারেল টিক্কা খানের সাথে দেখা করতে।
শেখ মুজিবকে সংসদ ভবনে রাখতে সম্মত হলেন না টিক্কা খান।  ঢাকা শহরে ততক্ষণে নরকে পরিণত হয়েছে। আগুনের শিখায় লাল হয়ে উঠেছে সারা আকাশ। গুলি আর বিষ্ফোরণের শব্দে চেচিয়ে কথা বলতে হচ্ছে এরই মধ্যে শেখ মুজিবকে সেনানিবাসে অফিসার্স  মেসের একটি ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে তালা আটকে দেওয়া হলো।
শেখ মুজিব বুঝলেন দুই বছর আগে গণঅভ্যুত্থানের কারণে ইয়াহিয়া খান যেখান থেকে তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিলেন, আজ আবার তাঁকে সেখানেই বন্দী করা হলো।
তথ্যসূত্র:
১। Z A Khan; The way it was
২। Siddiq Salik; Witness to Surrender
৩ । Rao Forman Ali; How Pakistan Got Divided
৪। মেজর রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম (অবঃ); লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে
৫। মেজর এস এম সাইদুল ইসলাম (অবঃ); বেঙ্গল রেজিমেন্টের যুদ্ধ যাত্রা ১৯৭১
সাইদুল ইসলাম, কানাডায় বসবাসরত বাংলাদেশের সাবেক সেনাকর্মকর্তা

SUMMARY

2007-1.jpg