মাহমুদুল বাসার
ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতি ছিল প্রত্যাশিত। আমরা বিশ্বাস করতাম, একদিন না একদিন এই ভাষণ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাবে। ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতি আমাদের সেই বিশ্বাসকেই বাস্তবে রূপ দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হলো ৭ মার্চের ভাষণ পৃথিবীর প্রত্যাশিত ভাষণ।
ফুটপাতে ফুলের গল্প
জাতিসংঘের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা ইউনেস্কো ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে’ অন্তর্ভুক্ত করেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ। এই ঐতিহাসিক ভাষণটি দিয়েছিলেন তিনি ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ, বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। পৃথিবীর নানা দেশের ৪২৭টি অতি গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টের সঙ্গে যুক্ত হলো ৭ মার্চের ভাষণ। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের ভূমিধস পরাজয় ও বিপর্যয়ের মুহূর্তে বিবিসি স্বীকৃতি দিয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে ‘শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালি’ হিসেবে। আজ ইউনেস্কো অর্থাৎ জাতিসংঘ স্বীকৃতি দিল বঙ্গবন্ধুর সেই কালোত্তীর্ণ ভাষণটিকে। অথচ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে তার মতো মহামানবকে সপরিবারে নিধন করেই ক্ষান্ত হয়নি, তাকে ইতিহাস থেকে পত্রপাঠ বিদায় দেয়ার অনেক চেষ্টা হয়েছে। সামনে বিএনপি ক্ষমতায় এলে আবার এই চেষ্টা শুরু হবে।
তিনি নাকি ৭ মার্চের ভাষণ শেষে জয়বাংলা বলার পর জয় পাকিস্তানও বলেছিলেন। এমন কুতর্ক উঠেছে বাংলাদেশে। আমাদের জনপ্রিয় কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ তার ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ নামক মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসের ভূমিকায় বলেছেন, ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের বিখ্যাত ভাষণ প্রসঙ্গেও একই ব্যাপার। জাস্টিস মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সাহেবের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘বাংলাদেশের তারিখ’ প্রথম সংস্করণে তিনি উল্লেখ করেছেন ভাষণের শেষে শেখ মুজিবুর রহমান বললেন, জয়বাংলা, জিয়ে পাকিস্তান। দ্বিতীয় সংস্করণে তিনি জিয়ে পাকিস্তান অংশটি বাদ দিলেন। কবি শামসুর রাহমানের লেখা আত্মজীবনী যা দৈনিক জনকণ্ঠে ‘কালের ধূলায় লেখা’ শিরোনামে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে, সেখানেও তিনি বলেছেন শেখ মুজিবুর রহমানের শেষ কথা ছিল জিয়ে পাকিস্তান। আরো অনেকের কাছে আমি এ ধরনের কথা শুনেছি, যারা আওয়ামী ভাবধারার মানুষ। সমস্যা হলো আমি নিজে ৮ এবং ৯ মার্চের সমস্ত পত্রিকা খুঁজে এরকম কোনো তথ্য পাইনি। তাহলে একটি ভুল ধারণা কেন প্রবাহিত হচ্ছে?’
আবুল মনসুর আহমদও বলেছেন তিনি শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণে জয় পাকিস্তান শোনেননি। পত্রিকায়ও দেখেননি। বঙ্গবন্ধুর অত্যুচ্চ মহিমা খণ্ডিত করার মতলবে যারা অষ্টপ্রহর ব্যস্ত তারাই বলতে পারেন বঙ্গবন্ধু জয় পাকিস্তান বলেছেন। জয় পাকিস্তান স্লোগান এই মহান ভাষণের সঙ্গে কিছুতেই খাপ খায় না।
এই ভাষণটিকে জননন্দিত কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ ১৮৬৩ সালের ১৯ নভেম্বর গেটিসবার্গে আব্রাহাম লিংকনের ভাষণের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। এর কারণ আছে। লিংকন একটি শোকাহত-সুস্থ পরিবেশে তার ভাষণটি দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু একটি অস্থির, সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে, পাকিস্তানি সামরিক জান্তার কামান-বন্দুক ও সাঁজোয়া বাহিনীর সামনে দাঁড়িয়ে ভাষণটি দিয়েছিলেন, তখন তার মাথার ওপর পাকিস্তানি প্লেন উড়ছিল। এর মধ্যেও তার ওপর ছাত্রনেতাদের চাপ ছিল সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়ার। হয়তো জনগণও তা আশা করছিল নানা কারণে। কিন্তু দূরদর্শী বঙ্গবন্ধু সরাসরি বলেননি, ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।’ কৌশলে শব্দ চয়ন করে বলেছেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এতে স্বাধীনতা ঘোষণা বাকি থাকেনি, স্বাধীনতার লক্ষ্যে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন।
অত্যন্ত তাৎপর্যের সঙ্গে ‘মুক্তি’ ও ‘স্বাধীনতা’ শব্দ দুটি তিনি ব্যবহার করেছেন। পাকিস্তানি শোষণ থেকে ‘মুক্তি’ চেয়েছেন আর বাঙালির আত্মবিকাশের জন্য, আত্মমর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার জন্য রাজনৈতিক স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। এই ভাষণে তিনি দাবি করেছেন, ‘আমি শুধু বাংলার নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা।’ এই দাবির পেছনে ঐতিহাসিক তাৎপর্য আছে। বিশ্বকে তিনি দেখাতে চেয়েছেন, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান মেজরিটি পার্টির কথা না শুনে মাইনরিটি পার্টির মতো চলে পাকিস্তানকে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, বাঙালিদের নিজেদের পথে অগ্রসর হতে বাধ্য করছেন।
এই ভাষণে তিনি নির্ধারিত আবেগ ব্যবহার করেছেন। গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। রাজনৈতিক সৌজন্য ও শিষ্টাচারের পরিচয় দিয়েছেন। তিনি শ্রেণিসংগ্রামের নেতা নন, তিনি আন্ডার গ্রাউন্ডের রাজনীতি করতেন না, তিনি জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা; সে দিকগুলো ভেবে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতিভ‚ হিসেবে ভাষণটি দিয়েছেন। তাই তিনি জল্লাদ ইয়াহিয়া খানের কাছেও বিচার চেয়েছিলেন, তার সঙ্গে দেখা করেছিলেন, তার সঙ্গে টেলিফোনে কথাও বলেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর এ সব পিছু হটার পদক্ষেপ ছিল না, ছিল সামনে অগ্রসর হওয়ার কৌশল। তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা নন, তিনি ভুট্টোর মতো অপরিণামদর্শী, হঠকারী নন, তার প্রমাণও রেখেছেন এই ভাষণে। অথচ এই ভাষণে তিনি গেরিলা যুদ্ধের কৌশল বর্ণনা করেছেন, বাঙালিদের বলেছেন যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে। শত্রু? কারা শত্রু? পাকিস্তানের আব্বা হুজুরদেরই শত্রু বলে ঘোষণা দিয়েছেন এই ভাষণে। কম কথা নয়। প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা ৭ মার্চের ভাষণকে সরাসরি ‘যুদ্ধ ঘোষণা’ বলেছেন। না হলে বঙ্গবন্ধু ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার কথা বলবেন কেন? এই ভাষণের মাধ্যমে তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে চ‚ড়ান্ত সম্পর্ক ছেদের ঘোষণা দিয়েছেন। বাঙালিদের সঙ্গে পাকিস্তানের যবনিকাপাত পাকিস্তানি শাসকরাই করেছেন, তার জন্য ভুট্টোর নোংরামিই দায়ী, তা এই ভাষণে যুক্তির পরম্পরায় বুঝিয়ে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। এই ভাষণে তিনি কোনো ছিদ্র রাখেননি, তা যুক্তির গাঁথুনিতে ঠাসা।
বাঙালিকে তিনি চ‚ড়ান্তভাবে প্রস্তুত হতে বলেছেন। আবার শত্রু পক্ষকে জানিয়ে দিয়েছেন, ‘আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না।’ বাঙালিদের বলেছেন, ‘আপনারা বুঝেসুঝে কাজ করবেন।’ আন্দোলনের শৃঙ্খলা বজায় রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। বক্তৃতার প্রারম্ভেই বলেছেন, ‘আপনারা সবই জানেন ও বোঝন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি।’ অর্থাৎ আর পাকিস্তারে সঙ্গে থাকা যায় না। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ হক তার এক লেখায় বিশ্লেষণ করেছেন কতবার এবং কেন তিনি ‘রক্ত’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। ভাষণের শুরুতে বলেছেন, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে।’ এখানে তিনি অনুপ্রাস অলঙ্কার ব্যবহার করেছেন বক্তব্যকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়ার জন্য। ভাষণের শেষেও বলেছেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ।’ এই আত্মপ্রত্যয় বাঙালি জাতির রক্তের শিরায় শিরায় পৌঁছে গিয়েছিল। বাঙালিরা ৭ মার্চ থেকেই মানসিকভাবে সশস্ত্র হয়ে গিয়েছিল। তারা ২৫ মার্চের আগেই ভেতরে ভেতরে অস্ত্র সংগ্রহ শুরু করেছিল। মেজর রফিকুল ইসলাম বীরউত্তমরা চট্টগ্রামে ৭ মার্চের ভাষণের আলোকে ২৫ মার্চের আগেই পাকিস্তানি আর্মির বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন, ‘ওফেন্স ইজ দ্য বেস্ট ডিফেন্স’- এই রীতি কার্যকর করেছিলেন। এই প্রস্তুতির বিপক্ষে ছিলেন জিয়াউর রহমান। অনেকে বলে থাকেন, ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়া উচিত ছিল। বঙ্গবন্ধুর দোষ ধরার জন্যই এসব কথা হয়। এসব কথা বলা আরম্ভ হয়েছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর, তার অবদান মুছে ফেলার অপচেষ্টা থেকে। এ কথা সবাই সহজ কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে বুঝতে পারেন, বঙ্গবন্ধু হঠকারিতার অভিযোগ থেকে মুক্ত থাকার জন্য ৭ মার্চের ভাষণে এমন শব্দ ব্যবহার করেননি যা বিশ্বের সহানুভ‚তি থেকে বঞ্চিত করবে। কোনো একটি ভুল শব্দ তিনি চয়ন করেননি, কয়েকটি আঞ্চলিক শব্দ ব্যহার করেছেন, কয়েকটি ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেছেন। এই ভাষণটি লন্ডনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থান পেয়েছে। বাংলা গদ্যেরও একটি উৎকৃষ্ট স্তর হিসেবে স্বীকৃত ভাষণটি।
মার্কিন গুরুত্বপূর্ণ সাপ্তাহিক ‘নিউজউইক’ বঙ্গবন্ধুকে বলেছেন রাজনীতির কবি। ৭ মার্চের ভাষণের পর এই অভিধা তিনি পেয়েছেন। বাঙালি কবি নির্মলেন্দু গুণও এই মহাভাষণকে কবিতা বলেছেন। বঙ্গবন্ধুকে কবি বলেছেন। বলেছেন, ৭ মার্চে গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে পড়ে শোনালেন তার অমর কবিতাখানি।
১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের নায়ক তোফায়েল আহমেদের বক্তব্য দিয়ে লেখাটি শেষ করি। ইউনেস্কোর স্বীকৃতিকে সাধুবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতি ছিল প্রত্যাশিত। আমরা বিশ্বাস করতাম, একদিন না একদিন এই ভাষণ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাবে। ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতি আমাদের সেই বিশ্বাসকেই বাস্তবে রূপ দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হলো ৭ মার্চের ভাষণ পৃথিবীর প্রত্যাশিত ভাষণ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ ‘অলিখিত ছিল’। বঙ্গবন্ধু এই ভাষণ একটি নিরস্ত্র জাতিকে স্বাধীনতার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিল। ১৮ মিনিটের ওই ভাষণ ছিল অলিখিত। বঙ্গবন্ধু সারা জীবন যা বিশ্বাস করতেন, সেই বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করেই ওই ভাষণ দিয়েছিলেন।
মাহমুদুল বাসার : কলাম লেখক।