‘স্তম্ভিত সময়ের কথা’-মোসলেহ উদ্দিন বাবুল

ঘুম থেকে জেগেছি মাইকিংয়ের শব্দে। থানা সদরের ছোট্ট এই বাজারের সবকিছু সবার পরিচিত। কিন্তু এই এনাউন্সারের কন্ঠটা আমার পরিচিত না। কি বলছে, পরিস্কার বোঝাও যাচ্ছেনা। আব্বা বাজার থেকে ফিরেছেন। আমি উঠেছি কিনা জানতে চাইলেন।
‘আজ বাজারে না বেরোনোই ভালো। শেখ মুজিবকে মেরে ফেলেছে তার দলের লোকেরা। বাজারে মাইকিং করছে থানার লোকে।’
আমি ততোক্ষনে বাজারের উদ্দেশ্যে ছুটছি!
এটা কি করে হলো! নির্বাক হয়ে গেছে লোকজন! বাজারের রেস্টুরেন্টগুলোর অন্যসময়ের সরব রাজনৈতিক আলোচনাও আজ নেই! দেশটা দমবন্ধ হয়েছিল , আওয়ামী লীগের লোকজন আর সর্বহারা, গণবাহিনীর দন্ধে মানুষ বিভ্রান্ত। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে এভাবে মেরে ফেলতে পারে তারই দলের খন্দকার না কি নামের একজন, এটা অবিশ্বাস্য! আমরা যারা বিরোধী দলের সাপোর্টার, তাদের জন্যও এটা বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো।
মানুষ আসলে কিছু চিন্তাই করেনি। ঐ বোধটাই বোধহয় আমাদের ঘুমিয়ে গিয়েছিলো! রেডিওতে খান আতার নতুন গান ‘আমরা এদেশকে স্বাধীন করেছিলাম কাহাদের জন্য’ বার বার রিপিট করে করে আর আমরা শুনতে শুনতে মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। বোধহয় সেই প্রথম বাঙ্গালীরা দেশের ক্রান্তিকালে নিস্পৃহ হতে শিখেছিলো! শিখেছিলো পরিস্থিতির স্রোতে হাত পা ছেড়ে দিয়ে ভেসে যেতে !
অবস্থাটা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। পাকিস্থান এবং পাকিস্থান পন্থীদের বাড়াবাড়ি রকমের আচরন, কাদের সিদ্দিকী, চিত্রনায়ক খসরুর মতো মানুষেরা সসস্ত্র প্রতিবাদ করার খবর জানার পরে মানুষের সম্বিৎ ফিরতে শুরু করলো। তিনমাসের মাথায় ঢাকার রাস্তায় বঙ্গবন্ধুর ছবি নিয়ে মিছিল, তেসরা নভেম্বরের সামরিক প্রতিবাদ, জেলে চার নেতাকে হত্যা করে সাতই নভেম্বরের প্রতি অভ্যূথ্থান মানুষকে নাড়া দিয়ে জাগিয়ে দিল! হায় হায়, কি ঘটে গেছে!
এর প্রতিক্রিয়া আর প্রায়শ্চিত্ত করতে হচ্ছে দীর্ঘ সময় ধরে, আজও!
অবাক লাগে, লজ্জাও লাগে, আমি এবং আমরা তখন বিরোধী দলের সমর্থক ছিলাম। সরকারী দলের ক্ষতিতে, বিপদে স্বস্তি পেতাম, উল্লসিত হতাম। চারু মজুমদার, সর্বহারা পার্টি আর গণবাহিনীর হঠকারী কার্যকলাপে অন্ততঃ মৌন সমর্থন থাকতো কিন্তু বঙ্গবন্ধু! এটা কল্পনায়ই ছিলনা মানুষের! অথচ এই সুযোগটাই নিয়েছে ‘ওরা’! এবং বিনামেঘের এই বজ্রাঘাতে স্তম্ভিত, স্থবির হয়ে গিয়েছিল মানুষ, বাঙালীরা!
তাইতো সময়ের ঐ অংশটা নিয়ে লিখতে চাইনা। মনে করতেই চাইনা ঐ স্তম্ভিত সময়ের কথা ।

SUMMARY

1971-1.png