ডা. এস এ মালেক,
২৩ বছরের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম ও ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণ তাদের তৎকালীন আবাসভূমি পূর্ববাংলা পাকিস্তান থেকে চিরদিনের জন্য আলাদা করতে সক্ষম হয়েছিল। যে মহান নেতার একক নেতৃত্বে এ মহান কাজটি সুুসম্পন্ন করা হয়েছিল, তিনি হচ্ছেন- বাংলার রাখাল রাজা, অবিসংবাদিত একক নেতা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এখন নিশ্চিত বলা যায় যে, ১৯২০ সালে ব্রিটিশরা যখন এই অঞ্চল শাসন করেছিল, তখন এই বিপ্লবী নেতা ছোট্ট খোকা হিসেবে বেড়ে উঠেছিলেন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া নামক নিভৃত এক পল্লীতে। সেই খোকা যে মহীরুহ আকার ধারণ করে তার পরাধীন জাতিসত্তাকে স্বাধীন করতে সক্ষম হবেন, তা কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি। কথাবার্তা, চাল-চলন, চিন্তা-চেতনা, অনুভ‚তি-আবেগ মিশ্রিত এত বড় মহাপুরুষ বাংলার মাটিতে এর আগে আর কেউ জন্মগ্রহণ করেননি।
বাঙালির ভালোবাসার কাঙাল এ নেতা মহাবাঙালি ছিলেন, একজন আত্মপ্রত্যয়দীপ্ত বিশ্বাসী, স্বাধীন চেতনা সমৃদ্ধ একজন ব্যাঘ্র মানব। তাঁর গলার স্বরের সঙ্গে অন্য কোনো বাঙালির স্বরের মিল ছিল না। কণ্ঠস্বর দিয়ে যদি কোনো ব্যক্তির পরিচিতি ঘটাতে হয়, তাহলে শেখ মুজিব ছিলেন এর অদ্বিতীয়। তাঁর কণ্ঠ থেকে মাঝে মাঝে অগ্নিবীণা নিঃসৃত হতো। সাধারণ মানুষ তাই তাঁর কণ্ঠকে বজ্রকণ্ঠ বলে অভিহিত করেছে। ব্যাঘ্রের গর্জন যেমন ছোটখাটো বন্য জন্তুকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে ফেলে, তেমনি শেখ মুজিবের কণ্ঠও পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তাদের একইভাবে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলত। তাঁর এক একটা শব্দ ও এক একটা বাক্যে পাকিস্তানি শাসকদের অন্তর কেঁপে উঠত। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’Ñ তাঁর এই ঘোষণা রমনা রেসকোর্স মাঠে পাকিস্তানের অস্তিত্বকে প্রকম্পিত করেছিল। প্রতিপক্ষ বুঝতে পেরেছিল, শেখ মুজিব ও বাংলার জনগণ আর পাকিস্তানি হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতে রাজি নয়। পরিচয় পরিবর্তন করে তিনি বাংলাদেশের জনগণকে বাঙালি হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন। তিনি ছিলেন, ওই সব বিশ্বের মহান নেতাদের একজন, যারা জীবদ্দশায় তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে গেছেন। স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েই তিনি ক্ষান্ত হননি, বাস্তবে স্বাধীনতাকে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। স্বাধীন বাংলা তো তাঁরই কৃতিত্ব। তাই তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। বাঙালির সম্পর্কে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের আক্ষেপের সার্থক রূপায়ণ ঘটিয়েছিলেন তিনি। এর আগে বাঙালি এরূপ বিজয় আর কখনো উপভোগ করেনি। একটা বিজয়ী স্লোগান, একটা স্বাধীন পতাকা, স্বাধীন জাতীয় সঙ্গীত অর্থাৎ স্বাধীন বাঙালি জাতিসত্তা এমনভাবে ইতোপূর্বে কেউ প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। তাই বলা যায়, তিনি একজন সার্থক জাতির জনক।
যে সব দেশ সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করে বিজয়ের পরে আসে, তাদের জন্য বিপর্যয়। কোনো দেশে শতভাগ লোক স্বাধীনতার দাবিদার হতে পারে না। কিছু বিরোধিতা থেকেই যায়। আর ওই বিরোধিতাই চেষ্টা করে বিপর্যয় ঘটানোর, বঙ্গবন্ধুর বেলায় তাই ঘটেছিল। বঙ্গবন্ধু ভালো করে জানতেন, বিজয়কে সার্থক ও সুসংহত করতে হলে, শত্রুদের সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করতে হবে। বিজয়ের পর অন্যান্য দেশে বিরোধীদের নিধন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিজয়কে সুসংহত করার চেষ্টা করা হয়। মানবতাবাদী শেখ মুজিবুর রহমান ওই শত্রু নিধন প্রক্রিয়ায় বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি অনেক শত্রুদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। চরম অপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন সংসদীয় গণতান্ত্রিক ধারায়। একটা সশস্ত্র বিপ্লবের পরেও তিনি দেশ পরিচালনা করতে চেষ্টা করেছিলেন। স্বাধীনতার শত্রু জামায়াত-শিবির চক্র ও উগ্র বামপন্থিরা তাঁর এই মহান প্রচেষ্টাকে দুর্বলতা বলে মনে করেছিল। বঙ্গবন্ধুর কারণেই সেই অস্ত্র তারা হাতে পেয়ে, তা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধেই ব্যবহার করা শুরু করল। দেশ সম্মুখীন হলো এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের। বিজয়কে সুসংহত করার প্রয়োজনেই সবকিছু কঠোর হস্তে দমন করে তিনি যখন আসল কাজটি শুরু করার জন্য পদক্ষেপ নিলেন, তখনই তাঁকে হত্যা করা হলো। পরিচালনা করা হলো দেশকে প্রতিক্রিয়ার ধারায়। স্বাধীনতার শত্রুরা রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিপক্ষ বনে গেলেন। তার পর ২১ বছর যা হওয়ার তাই হয়েছে! উল্টো পথের যাত্রী সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রে স্বাধীন বাংলাদেশের রূপান্তর ঘটানোর অপচেষ্টা। প্রত্যেক দেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে বিজয়ের পর স্বাধীনতাকে সুসংহত করার চেষ্টাই হয়। এর বিরুদ্ধে প্রতিবিপ্লবীরা প্রতিনিয়ত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির চেষ্টা করে থাকেন। বাংলাদেশেও তাই ঘটেছে। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে বিশেষ করে, মুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ রেখে প্রতিবিপ্লবীদের আমরা সঠিকভাবে মোকাবেলা করতে পারিনি। হয়তো আমাদের অনেক সিদ্ধান্তে ভুল ছিল। স্বাধীনতার মর্মবাণীকে হৃদয় দিয়ে আমরা সবাই উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম বলে মনে হয় না।
তাই তাঁর অনেক সিদ্ধান্তকে সাধারণ জনগণ ভ্রান্ত বলে মনে করেছিলেন এবং প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করতে সঠিকভাবে তারা তৎপর হয়ে ওঠেনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি যেভাবে আত্মসচেতন হওয়ার কথা, তা হতে পারেনি। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, চেতনাই রয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন তাঁর সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা গ্রহণের ব্যাপারে তাঁর দূরদর্শিতা তাঁর অনুসারীরা অনেকেই সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারেনি। তাই তিনি জনগণের মুক্তির লক্ষ্যে যে ঐতিহাসিক ২য় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন, সে সম্পর্কে এখনো তাঁর দলের সিনিয়র নেতারা বিরূপ মন্তব্য করে থাকেন। তিনি ২য় বিপ্লবের কর্মসূচি সফল করে যেতে পারলে, সমালোচকদের সমালোচনা করার সুযোগ পেত না। তাঁর অকাল মৃত্যুর কারণেই স্বাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়কে এখন কালো অধ্যায় বলে অনেকে বিবেচনা করে থাকেন। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সুসংহত করার প্রয়োজনেই তিনি ২য় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। ওই কর্মসূচি ছিল : আর্থ-সামাজিক মুক্তির দিক নির্দেশক। তিনি দেশে এমন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, যাতে সাধারণ মানুষ অংশগ্রহণ করতে পারে, অর্থনৈতিক বৈষম্যের অবসান ঘটে। শোষিত-বঞ্চিত মানুষও যেন মুক্তির স্বাদ পায়। প্রতিটি মানুষ যাতে তার মানবিক অধিকার উপভোগ করতে পারে, স্বাধীন বাংলাদেশকে তিনি কখনো শোষকদের বাংলাদেশে রূপান্তরিত করতে চাননি। তিনি চেয়েছিলেন, শোষিত-বঞ্চিত মানুষের অধিকার সংরক্ষিত একটি বাংলাদেশ। তিনি তো ঘোষণাই দিয়েছিলেন, তিনি শোষিতের পক্ষে, শোষকের পক্ষে নন। আজ স্বাধীন বাংলাদেশ প্রকৃত অর্থে শোষণ করছে, সুবিধাবাদী শোষক শ্রেণি। আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, কিন্তু স্বাধীনতার অধিকার ভোগ করার সুফল পাইনি। গুণগতভাবে জাতিসত্তায় যে প্রগতিশীল উন্নয়নের ধারা প্রতিষ্ঠিত করা আমাদের লক্ষ্য ছিল, তা অর্জিত হয়নি। তাই ১০ জানুয়ারি বিশেষ করে, বঙ্গবন্ধুর কথা মনে পড়ে। ওই দিন দেশে ফিরে এসে তিনি স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের সুসংহত করার লক্ষ্যে মূল ভীত রচনা করেন। তাঁর অকাল মৃত্যুর কারণে আমাদের চরম ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সুফল সবার কাছে পৌঁছে দেয়ার কাজ অসমাপ্ত থেকে গেছে। তাঁর অসমাপ্ত কাজ তাঁরই সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা সমাপ্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে তা ভিন্ন হওয়ায় জননেত্রী শেখ হাসিনাকে অত্যন্ত সুকৌশলে অগ্রসর হতে হচ্ছে। বিশ্ব বাস্তবতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হচ্ছে। যে আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু তাঁর ২য় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন, বর্তমান সময়ে তা আক্ষরিক অর্থে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। বস্তুনিষ্ঠ বর্তমান বাস্তবতা যে দিকনির্দেশনা দেয়, জননেত্রী শেখ হাসিনা তাই অনুসরণ করার চেষ্টা করছেন। অনেকের অভিযোগ পিতার আদর্শ থেকে কন্যা বেশ কিছুটা সরে দাঁড়িয়েছেন, এটা সঠিক নয়। কেননা, বর্তমান বাস্তবতায় জনগণের সংকট সমাধান করে যেভাবে তিনি দেশকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, জননেত্রী শেখ হাসিনা সেই পথেই অগ্রসর হচ্ছেন। তিনি ‘ইউটোপিয়ন’ নন। তাই শেখ হাসিনা কর্তৃক গৃহীত প্রতিটি পদক্ষেপ বাস্তবসম্মত মনে হচ্ছে এবং জনগণ তার সুফল পেতে শুরু করেছে। এখন শুধু প্রয়োজন বর্তমান ধারাকে অব্যাহত রাখা এবং সে কারণেই স্বাধীনতার সপক্ষের সব শক্তির উচিত জননেত্রী শেখ হাসিনাকে পুনরায় ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন করা।
ডা. এস এ মালেক, বিশিষ্ট রাজনীতিক ও কলামিস্ট।