খুব ধীরে ধীরে তিনি সিঁড়ির প্রান্তে এসে দাঁড়ালেন।
মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে তখনো প্রতিধ্বনিত হয়নি বন্দনাগান
নিদ্রানগ্ন কাকেরা জেগে উঠে উন্মাতাল করে তোলেনি আকাশকে
শিশিরভেজা ঘাসগুলো সূর্যের আলোর প্রত্যাশায়
আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠবার আয়োজন করেনি তখনো;
অন্ধকার সরে গিয়ে আলোর পর্দায় প্রতিফলিত হয়নি
পৃথিবীকে স্বচ্ছ করে তোলার প্রস্তুতি।
চরাচরকে এতো শান্ত, এতো কোলাহলহীন মনে হয়নি আর কখনো;
যেন পৃথিবীতে এরকম শান্তি কখনো ছিলো না।
এ সময় আকাশের পর্দা ফাটিয়ে ভয়াবহ বেগে
গর্জন করে উঠলো মৃত্যু;
তারই শব্দে কেঁপে উঠলো পৃথিবী।
আর্তনাদ আর কোলাহল জড়াজড়ি করে এমন প্রবল হয়ে উঠলো যে,
তিনি আর ভেতরে স্থির থাকতে পারলেন না।
রাত্রির পোশাকেই ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে
সিঁড়ির প্রান্তে এসে দাঁড়ালেন।
হাতে তখনো তাঁর প্রিয় পাইপ,
চোখের চশমায় প্রতিফলিত বিস্ময়কর আলো,
একবার ঝলসে উঠেই পিছলে পড়ে হারিয়ে গেলো অন্ধকারে।
হাওয়ার ভেতর তাঁর বজ্রকণ্ঠ আছড়ে পড়লো কে?
তখন জলপাই রঙের পোশাকে আবৃত
বিপথগামী সৈনিকেরা অস্ত্র হাতে চিৎকার করে উঠলো- ঐ তো,
ঐ তো সেই বিশ্বাসঘাতক, হত্যা করো ওকে।
একটি পাতা বৃক্ষ থেকে উড়ে এসে ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে
উপুড় হয়ে পড়ে রইলো তাঁর পায়ের কাছে।
কেউ তাঁর চোখের দিকে তাকালো না,
তাঁর চোখের দ্যুতির আড়ালে ঢাকা পড়লো তাদের কুৎসিত চিৎকার;
একঝলক বাতাস এসে তাঁর চুলের ওপর আছড়ে পড়ল
তিনি হাত দিয়ে তা পেছনে সরিয়ে দিয়ে
বজ্রগম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন কী চাই তোদের?
সঙ্গে-সঙ্গে একটি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র গর্জন করে উঠলো।
রক্তাক্ত-ক্ষতবিক্ষত দেহে তিনি লুটিয়ে পড়লেন সিঁড়ির ওপরে।
দিগন্ত থেকে দিগন্তে যাদের উন্মত্ত ক্রোধ বিকীর্ণ হয়ে ছড়িয়ে পড়লো,
তারা সেই বিশালকায় দেহকে সেখানে ফেলে রেখে
ভোরের আলোয় অতি দ্রুত সরে গেলো দৃশ্যের আড়ালে;
আর অস্ত্রের ভয়ানক গর্জনে নিদ্রামগ্ন কাকেরা তোলপাড় করলো মহাদিগন্ত।
হিমেল হাওয়ার চাপা গোঙানি ভারাক্রান্ত করে তুললো ভোরের বাতাস;
একপাল কুকুরের আকস্মিক চিৎকারে ভেঙে খানখান হয়ে গেলো নৈঃশব্দ;
দীঘির জলে স্তব্ধ মাছেরা তাদের লেজের ঝাপ্টায়
শূন্যতাকে ভেঙে টুকরো-টুকরো করে
চিরকালের জন্য মিলিয়ে গেলো পাতালে;
আর আকাশের নক্ষত্রেরা শোকাহত আত্মীয়ের মতো
অসহায় তাকিয়ে রইলো মহাকাশের দিকে।
নিথর দেহের ভারে তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই ছোট্ট নদী
যার উত্তাল জলে লাফিয়ে পড়া ছোট্ট কিশোরের আনন্দিত অনুভবে
একদিন হেসে উছেছিলো দু’পাড়ের মাটি।
আজ তাঁর বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে-কাঁদতে অবশ হয়ে এলো দেহ।
মনে হলো- আহা, তাঁর কতো আকাঙ্ক্ষাই পূর্ণ হলো না,
জীবন আর যৌবনের যে-দিনগুলো
লোহার খাঁচায় বন্দিত্ব বরণ করতে-করতে শূন্যতায় ডুবে গেলো,
রবীন্দ্রনাথের একটি গানকে চিরকালের করে তুলতে যে-জীবন
মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে-করতেও থেমে গেলো মধ্যপথে;
যারা এক অর্ফিয়ূসের বীণার অনুরণন থামিয়ে দিতে
রক্তপাতকেই নির্দিষ্ট নিয়তি বলে ঘোষণা করে দিলো,
তিনি শেষবারের হাত তুলে তাদেরকে ক্ষমা করে দিলেন।
যে হ্যামিলনের বাঁশির শব্দে মানুষ, পাখি বৃক্ষ ও উদ্ভিদ
একদিন তাঁর পিছে-পিছে উন্মাদের মতো ছুটে গিয়েছিলো,
আজ তাঁর বাঁশির সুর ঝংকৃত হবার আগেই তারা পালিয়ে গেলো দূরে।
শুধু ভূমিপুত্র ও কন্যারা স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো ধানের ক্ষেতে;
মাথার মাথাল ফেলে দিয়ে তারা বুক চাপড়াতে-চাপড়াতে
বিলাপ করতে লাগলো;
ধানের শীষের ভয়ার্ত কাঁপনে তাদের সেই বিলাপ
ভাসিয়ে নিয়ে গেলো দক্ষিণের হাওয়া;
একাত্তরের মতো আর একবার বুটের শব্দে
কেঁপে উঠলো স্বদেশের মাটি।
অবশেষে যেই নগরীতে তাঁর জীবন বয়ে গেছে বিদ্যুতের বেগে,
সেই প্রিয়তম নগরী তাঁকে বিদায় জানালো চিরকালের জন্য।
কিন্তু যেই নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে দুরন্ত কিশোর
জানিয়ে দিয়েছিলো স্রোতস্বিনীকে সে বয়ে যাবে
পৃথিবীর সর্বশেষ সীমান্ত অবধি,
সেই মধুমতী কেঁদে কেঁদে আকুল হলো;
কেবল সে-ই তাঁকে পরম আদরে টেনে নিলো তার বুকে
যেন এক ক্ষুধার্ত মাতৃহৃদয় ফিরে পেলো তার হারানো সন্তানকে।
ঢেউয়ের তালে-তালে লক্ষ-লক্ষ মানুষের করুণ বিলাপে
ঝুরঝুর করে ঝরে পড়তে লাগলো দু’পাড়ের মাটি,
তরঙ্গের শীর্ষদেশে একটি স্বাধীন স্বদেশ তার দেহ ও আত্মাসহ
একা-একা ভেসে যেতে লাগলো তাঁর জন্মভূমির দিকে;
আর মধুমতীর দুই তীর কান্নায় ভাসিয়ে দিয়ে
মৃত্যু তাঁকে পৌঁছে দিলো তাঁর নিজস্ব গন্তব্যে।