সৈয়দ রাশেদ রেজা
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে ) জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রদত্ত ঐতিহাসিক ভাষণটিকে ‘ডকুমেন্টারি হেরিটেজ ’ (প্রামাণ্য ঐতিহ্য ) হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তা সংস্থাটির ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার ’ –এ অন্তর্ভুক্ত করেছে। দীর্ঘ ৪৬ বছর পরে হলেও জাতিসংঘের মতো বিশ্বসংস্থার এ সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা।
৭ মার্চ ১৯৭১। সে সময় পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা ছিল মিছিলের শহর। সেদিন কৃষক–শ্রমিক–মজুর–বুদ্ধিজীবী–শিশু –কিশোর –নারী–পুরুষ–যুবক–বৃদ্ধ সবাই রেসকোর্স ময়দানে সমবেত হয়েছিল বাঙালির মহান নেতার কথা শোনার জন্যে। সবার মনে ছিলো আকুলতা। সে আকুলতা ছিলো নেতার কাছে স্বপ্নের কথা শোনার। তাঁর মুখে আশার বাণী শোনার। সবার হাতে ছিলো বাংলার মানচিত্র আঁকা লাল সূর্যের পতাকা। বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে সাদা পাজামা–পাঞ্জাবি আর হাতাকাটা কালো কোট পরে বঙ্গবন্ধু বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্তপায়ে হেঁটে ওঠে আসেন রেসকোর্সের মঞ্চে।
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল/ হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা।
যে বিকেলটি ছিলো বাংলার মানুষের জন্যে শ্রেষ্ঠ বিকেল, সে বিকেলের পড়ন্ত রোদে আপামর জনতার সামনে যিনি এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি বাঙালির বড়ো প্রিয় মানুষ, বাঙালির শিকড় থেকে জেগে ওঠা এক বিদ্রোহী নেতা। যাঁর জন্যে বাঙালির রয়েছে বুক ভরা ভালোবাসা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘নিউজউইক’ পত্রিকায়১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল প্রকাশিত ‘মের্ণ মত মেফর্ধধড্র’ নিবন্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘রাজনীতির কবি’ বলে আখ্যায়িত করে লেখা হয়, তিনি ‘লক্ষ লক্ষ মানুষকে আকর্ষণ করতে পারেন সমাবেশে এবং আবেগময় বাগ্মিতায় তরঙ্গের পর তরঙ্গে তাদের সম্মোহিত করে রাখতে পারেন। তিনি রাজনীতির কবি’।
৭ মার্চের ভাষণ শুধু একটি ভাষণ নয়, একটি অনন্য কবিতা। এ কবিতার মাধ্যমে তিনি ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে স্বীকৃতি পান। তিনি বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার স্বপ্ন ও অনুভূতির রূপকার। তাঁর বাঙালি হৃদয়ের আবেগপ্রবণ প্রকাশকে কবিসুলভই মনে হয়। তিনি কোনো সাধারণ রাজনীতিবিদ নন, তিনি একজন কবি, একজন রাজনীতির কবি। এ দেশের মানুষের ভালোবাসায় গড়া এক মানুষ। বাংলাদেশের জনপ্রিয় কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায় – কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠবাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি :
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,/ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
এ ভাষণ পৃথিবীর ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ ভাষণ। আমাদের সৌভাগ্য বঙ্গবন্ধু আমাদের দেশে জন্মগ্রহণ করেছেন। পৃথিবীতে খুব কম দেশই আছে যেখানে দেশ ও একজন নেতা সমার্থক। আমরা সেই সৌভাগ্যবান জাতি, যেখানে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক। ৭ মার্চের ভাষণ থেকে আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা এসেছে। এ ভাষণ ছিলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ একটি মহাকাব্য। ১৮ মিনিটের ভাষণে কোনো তৎসম শব্দ ছিলো না। বঙ্গবন্ধু চলিত সহজ সরল ভাষায় পুরো বক্তব্য দিয়েছেন। এ ভাষণের তীব্র চুম্বকীয় আবেশে আবিষ্ট হবে যে কেউ। এ ভাষণ যারা বুকে ধারণ করবে, দেশপ্রেমের চেতনায় তারা উজ্জীবিত হবে। জাগ্রত হবে অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধে। অসাধারণ এর বক্তব্য। প্রাণময় মহৎ কবিতার মতো এর আবেদন কখনো ফুরোয় না। এ ভাষণে নিশ্চয়ই কবিতার মতো কোনো যাদুকরী শক্তি আছে যা পাঠক কিংবা শ্রোতাকে বারবার কাছে টানে। যতবারই পড়ি কিংবা শুনি ততবারই নতুন বলে মনে হয়, কখনো পুরনো হয় না। যেমনি সারগর্ভ, ওজস্বী ও যুক্তিযুক্ত, তেমনি তির্যক, তীক্ষ্ব ও দিক–নির্দেশনাপূর্ণ। ভাষণের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য ব্যঞ্জনাপূর্ণ। শব্দ চয়নের কুশলতা, বাক্যের বিন্যাস, কাব্যিকতা ও বাচনভঙ্গির অভিনবত্ব আমাদেরকে দারুণভাবে মুগ্ধ করে। একান্তই আপন, স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল।
বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে পাকিস্তানের ২৩ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাস ও বাঙালিদের অবস্থা ব্যাখ্যা, পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাথে বাঙালিদের দ্বন্দ্বের স্বরূপ তুলে ধরা, শান্তিপূর্ণভাবে বাঙালিদের অধিকার আদায়ের চেষ্টা, অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমি ব্যাখ্যা ও বিস্তারিত কর্মসূচি ঘোষণা, সারা বাংলায় প্রতিরোধ গড়ে তোলার নির্দেশ, প্রতিরোধ সংগ্রাম শেষে মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয়ার ইঙ্গিত, শত্রুর মোকাবেলায় গেরিলা যুদ্ধের কৌশল অবলম্বন, যেকোনো উস্কানির মুখে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এরপর তিনি ঘোষণা করেনণ্ড ‘… ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে— এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’
বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ ছিলো প্রচণ্ড উদ্দীপনাময়ী, প্রেরণাদায়ী, দেশাত্মবোধে উজ্জীবিত, ভারসাম্যপূর্ণ, ব্যঞ্জনাপূর্ণ ও গীতিময়, তাৎক্ষণিক, স্বতঃস্ফূর্ত ও হৃদয় উৎসারিত, আকারে নাতিদীর্ঘ, সর্বোপরি শিল্পোত্তীর্ণ, যুগোত্তীর্ণ, কালোত্তীর্ণ। এসব দিক বিবেচনায় এটি বিশ্বের ইতিহাসে একটি শ্রেষ্ঠ ভাষণ।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন প্রাজ্ঞ, অত্যন্ত বিচক্ষণ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন একজন রাজনীতিবিদ। স্নায়ুযুদ্ধকালীন বিশ্ব রাজনীতির গতিধারা বা মেরুকরণ সম্পর্কে তিনি পুরোপুরি জ্ঞাত ছিলেন। দেশের ভেতরে বা বাইরে একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে তিনি যাতে কোনো অবস্থায় চিহ্নিত না হন, এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ সচেতন। এমনটি হলে, সে সময়ের বিশ্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন হয়তো অসম্ভব হয়ে দাঁড়াত। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিলো বস্তুত বাংলাদেশের স্বাধীনতারই ঘোষণা। তবে বিদ্যমান বিশ্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতির বাস্তবতায় তিনি কৌশলের আশ্রয় নেন। তাঁর ভাষণের শেষদিকে তিনি এমনভাবে ‘স্বাধীনতার’ কথা উচ্চারণ করেন, যাতে স্বাধীনতা ঘোষণার কিছু বাকিও থাকে না, অপরদিকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর তাঁর বিরুদ্ধে একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার অভিযোগ আনাও মোটেও সহজ ছিলো না। বঙ্গবন্ধুর এ কৌশলী অবস্থান সুদক্ষ সমর কুশলীদেরকেও অবাক করে দেয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১৯৭১এর ৭ মার্চ সরাসরি কেনো স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি,তার ব্যাখ্যা পরবর্তীকালে তিনি নিজেই দিয়েছেন। ১৯৭২ এর ১৮ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে এনডব্লিউ টিভির জন্যে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ৭ মার্চের ঐ ঘটনা বর্ণনা করেন। ফ্রস্ট শেখ মুজিবের কাছে জানতে চান, ‘আপনার কি ইচ্ছাছিল যে, তখন ৭ মার্চ রেসকোর্সে আপনি স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঘোষণা দেবেন?’ জবাবে শেখ মুজিব বলেন, ‘আমি জানতাম এর পরিণতি কী হবে এবং সভায় আমি ঘোষণা করি যে এবারের সংগ্রাম মুক্তির, শৃঙ্খল মোচন এবং স্বাধীনতার।’ ফ্রস্ট প্রশ্ন করেন, ‘আপনি যদি বলতেন, আজ আমি স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঘোষণা করছি, তো কী ঘটত?’ শেখ মুজিব উত্তর দেন, ‘বিশেষ করে ওই দিনটিতে আমি এটা করতে চাইনি। কেননা বিশ্বকে তাদের আমি এটা বলার সুযোগ দিতে চাইনি যে, মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন এবং আঘাত হানা ছাড়া আমাাদের আর কোনো বিকল্প ছিলো না। আমি চাইছিলাম তারাই আগে আঘাত হানুক এবং জনগণ তা প্রতিরোধ করার জন্য প্রস্তুত ছিলো।’
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা না করে পুরোপুরি ঠিক কাজটিই করেছেন। কলাম লেখক আইয়ুব খান ২০০৬ সালের ৩১ মার্চ দৈনিক ভোরের কাগজে যথার্থই লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের একটি শব্দ বা দাঁড়ি–কমাতেও বাহুল্য ছিল না। প্রতিটি শব্দ বা বাক্য বাস্তবতার গভীর থেকে উৎসারিত। এ যেন কোনো দেবদূত, সমবেতজনতাকে তাদের সংকটকালে অমোঘ নিয়তির দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন।’
তিনি তাঁর ভাষণে বাঙালিকে একান্ত আপন তুমি সম্বোধন করে বললেন, ‘মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।’ তাঁর এ উচ্চারণে প্রতিটি বাঙালির শিরায় শিরায় আবেগ ও উত্তেজনার ঢেউ খেলে যায়। একেবারে আড়ম্বরহীন ও বাহুল্য ছাড়া লাখো জনতার সামনে এমন অন্তরঙ্গ, প্রায় ব্যক্তিগত সম্বোধন বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই সম্ভব ছিলো।
ভাষণে একদিকে যেমন ছিল শত্রুর বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান, অপরদিকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে বাঙালিদের অধিকার আদায়ের প্রচেষ্টা (‘আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি’), গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ (যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজন যদিও সে হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব’), মানবিকতা (‘….. গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে, সেজন্য…’), অসাম্প্রদায়িক আদর্শ ও সম্প্রীতি (‘এই বাংলায় হিন্দু–মুসলমান, বাঙালি–নন বাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপরে)। ভাষণের এসব দিক তথা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের দায়িত্ববোধের প্রকাশ ছিলো সবার নজর কাড়ার মতো। পৃথিবীর ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে পরিগণিত বেশিরভাগ নেতৃত্বের বক্তব্য যেখানে লিখিত, সেখানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি ছিলো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অলিখিত, স্বতঃস্ফূর্ত, যা এ ভাষণকে বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে। পৃথিবীর কোনো দেশে কোনো নেতার ভাষণ সে দেশের মানুষ এতো দীর্ঘ সময় ধরে (৪৬ বছর) শুনে আসছে কিনা সন্দেহ। এ ভাষণ একটি জাতি–জনগোষ্ঠীর মুক্তির কালজয়ী সৃষ্টি,এক মহাকাব্য। শুধু বাঙালি জাতির জন্যেই নয়, বিশ্বমানবতার জন্যেও এটি মহামূল্যবান দলিল বা সম্পদ। পৃথিবীর ইতিহাসে আপন গৌরব ও মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে থাকবে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর এ অনন্য ভাষণ। কবি অন্নদাশংকর রায়ের ভাষায় –
যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা গৌরী যমুনা বহমান
ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত উপাধ্যক্ষ, বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এন্ড কলেজ , জেদ্দা, সৌদি আরব