সাহিত্যে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান-রীনা তালুকদার


গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার ছোট ছেলে খোকা। ডানপিটে কিশোর ছেলেটির গাম্ভীর্যপূর্ণ কথা শুনে অবাক হলেন পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। যিনি অবাক হয়েছিলেন কিশোর মুজিবের দৃঢ় কণ্ঠস্বর শুনে। সেটি ছিল শেরেবাংলার সামনে স্কুলঘর মেরামতের জন্য পথরোধ করে দাঁড়িয়েছিলেন। ঐ বয়সের একটি কিশোরের এমন দৃঢ়তা খুব কমই দেখা যায়। সে খোকা নেশার মতো ছুটে এসেছেন বাংলার রাজনীতিতে। কিশোর যৌবন সবকিছু বিসর্জন দিয়ে মুক্তির নেশায় অস্থির হয়ে ওঠেছিলেন। ১৯৩৮ সালের জানুয়ারি মাসে ১৬ তারিখে বাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা গোপালগঞ্জ পরিদর্শন করতে গিয়ে সেখানকার মিশন স্কুলও পরিদর্শন করতে যান। সেখানে শেরে বাংলা সঙ্গে নিয়ে যান তার সরকারের বাণিজ্য ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে। তখন বঙ্গবন্ধু কেবল সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। স্কুল পরিদর্শন শেষে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ফিরে যাচ্ছিলেন। পথে বাধা দিয়ে দাঁড়ালেন ছোট্ট মুজিব। দাবি একটাই স্কুল মেরামত করে দিতে হবে। অবাক বিস্ময়ে বাংলার প্রধানমন্ত্রী আর বাণিজ্য ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রী তাকিয়ে থাকলেন মুজিবের দিকে। এ কিশোরের চোখে মুখে কতো দৃঢ়তা কতো সাহস। কতো সাহসী তার উচ্চারণ। তার সাহসের কাছে বাধ্য হলেন সে দিন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। স্কুল ঘর মেরামতের জন্য তৎক্ষণাৎ বরাদ্দ করলেন ১২ (বারশ') টাকা। যে কিশোর সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র হতেই জেল খেটেছেন। তার এলাকায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সমাজে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে প্রতিপক্ষের মামলায় জেলে গিয়েছেন। যিনি একাধারে ঐ ছাত্র অবস্থায়ই ছিলেন একজন ব্রতচারী শিল্পী, আবার গরিব ছাত্রদের জন্য মুষ্টি সংগ্রহের সাহায্য করতেন, ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে ভারতের বেকার হোস্টেলের ছাত্রটি টুঙ্গিপাড়ায় এসে ফুড কমিটি এবং ধর্মগোলা নিয়ে এসেছেন মানুষের জীবন বাঁচাতে। আবার একজন ফুটবলার, অন্যদিকে শেরে বাংলা আর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, সেই দর্শনে হয়ে ওঠেন রাজনীতিক। তারপরের ইতিহাসে সে টুঙ্গিপাড়ার দাদা-নানা, মা-বাবার ছোট্ট খোকার বেড়ে ওঠার পথ কতোটা সংগ্রামের সেটি যদি ভাবি তাহলে দেখতে পাই ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেয়া দুধের শিশুটি ধীরে ধীরে বিস্তৃত হয়ে পরিণত হচ্ছে বিশাল মহীরুহে। ১৯৪৪ সালের বঙ্গীয় মুসলিম লীগ হতে শুরু হয়ে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি মুসলিম ছাত্রলীগ ১৯৪৮ সালের ১৩ জানুয়ারি আওয়ামী মুসলিম লীগ, ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫০ সালের আবারো কারাবন্দি জীবন, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৩ সালের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক থেকে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে আইন সভার সদস্য ও মন্ত্রী। তারপরের সেই ৬ দফার আন্দোলনে ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত বাংলার রাজপথে তাকে চলতে হয়। চলার পথে ১৯৬৯ সালের আইয়ুব খানের পতনের মধ্য দিয়ে উন্মোচিত করেন বাংলার রাজনৈতিক জীবনের আরেক পথ। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফলে আকাশসম জয়ে বাংলার আপামর জনসাধারণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।

এই যে বঙ্গবন্ধু মানুষটি আর তার যে দার্শনিক চিন্তাধারা, সমাজতান্ত্রিক মতবাদ, সমবণ্টনের চেতনা, মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি, মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষা সবকিছুর সমন্বয়ে যে দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সমৃদ্ধির কথা চিন্তা করেছেন। সেখানেই কি কবি মানস খুঁজে পাওয়া যায় না? শুধুই কি রাজনৈতিক নেতা তিনি? নাকি তার ৭ মার্চের ভাষণ এক শক্তিশালী কবিতা? যদি তাই হয় তবে তিনিও এক সত্য অন্বেষী কবি। যে কবি একজন আপাদমস্তক কবির চেয়েও বেশি কিছু ছিলেন। কবিরা সমাজকে সুন্দরের দিকে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। সে স্বপ্ন সামনে রেখেই তাদের দীর্ঘপথের যাত্রা। এ যাত্রায় কখনো কবিদের স্বপ্নের প্রাপ্তি ঘটে আবার কখনও ঘটে না। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান? তিনি এক দার্শনিক কবি। একই সাথে স্বপ্ন দেখে সে স্বপ্নকে শিকড় থেকে তুলে এনে যুক্তিতর্কে বাস্তবতার মুখ দেখিয়েছেন। তাহলে তিনি কত বড় মাপের কবি তা অবশ্যই অনুধাবন করার অবকাশ আছে। যে মানুষ শত্রুকেও ক্ষমা করে দেন। ঘাতক মোস্তাকের যড়যন্ত্রের কথা জেনেও যিনি সরল বিশ্বাসে চুপ হয়ে বসেছিলেন। অথচ যার একটি আহ্বানে সমস্ত বাহিনী এবং আপামর জনতা আসে কিংবা তিনি চাইলেই আসত। কিন্তু তিনি এতোই বিশ্বাসী ছিলেন এই বাংলার মানুষের প্রতি। যিনি বিশ্বাস করতেন যে পাকিস্তানিরা জেলখানায় একপাশে ফাঁসির কাস্ট তৈরি করেছিল ; তখন তিনি দৃঢ়ভাবেই তা দেখে উচ্চারণ করলেন 'আমি মানুষ, আমি বাঙালি, আমি একজন মুসলমান এবং একজন মুসলমান একবারই মরে, দু'বার নয়। অতঃপর তিনি আরো বললেন, আমার লাশটি আমার বাঙালিদের কাছে পৌঁছে দিও। এছাড়া তিনি বলেন, আমি মনুষ্যত্বকে ভালোবাসি। প্রতি ইঞ্চিতে তোমরা লড়াই করবে। আমি বলেছিলাম হয়ত এটাই আমার শেষ নির্দেশ। কিন্তু মুক্তি অর্জন না করা পর্যন্ত তাদের লড়াই করতে হবে। সে ব্যক্তি কবি না হলে কি করে সম্ভব? ভয়ের কাছে পরাজয় মানেনি, মিথ্যার কাছে পরাজয় মানেননি, সত্যের মুখোমুখি হয়ে অর্জন করেছিলেন এক বিরল গুণ, সেটি হচ্ছে প্রজ্ঞা। প্রজ্ঞাবান এই ব্যক্তিত্ব বিশ্বনেতা মুজিবর। এক কালজয়ী ইতিহাস, এক মহা সমরের মহানায়ক। সে মুজিব কি কবি নয় তাহলে? তবে কবির সংজ্ঞা কি জানি না। বিশ্বের এতো লোক আর কোনো মানুষকে নিয়ে এতো গবেষণা করেনি, এতো গান রচনা করেনি, এতো নাটক কিংবা ইতিহাস লেখেনি। যতোটা লিখেছে এই বঙ্গপিতাকে নিয়ে। তবে কি তিনি কবি নন? তিনি কবিদের বন্ধু। তিনি কবিদের রাজনৈতিক কবি। যেহেতু রাজনৈতিক কবিতা আছে, তাই তিনিও রাজনৈতিক সাহিত্যের কবি অথবা কবিতার প্রেরণা। তা না হলে কিভাবে আজকেও কবিরা মুজিবকে নিয়েই স্বপ্ন দেখে, কোথা থেকে তাদের এতো শব্দ আসে? কীভাবে কবিরা লিখে যায় এতো কবিতা? কোথা থেকে আসে এতো কাহিনী? তবে তো তিনি কবিই।

রীনা তালুকদার : লেখক

SUMMARY

1917-1.png