(ইতিহাসের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি)
বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে ১০ই জানুয়ারি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসটি বিজয়ের পরিপূর্ণতায় উদ্ভাসিত এক অনন্য-ঐতিহাসিক দিন। ১৯৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বর বিজয়ের পর থেকে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের জনসাধারণ প্রাণপ্রিয় নেতার আগমন প্রতীক্ষার প্রহর গুণছিল। ৭২-এর এই দিনে পাকিস্তানের লায়ালপুরের মিয়ানওয়ালি কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে দীর্ঘ ৯ মাস ১৪ দিনের বন্দীদশা তথা মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা বঙ্গবন্ধু মুজিবকে কাছে পেয়ে বাঙালি সেদিন আনন্দে আত্মহারা হয়ে স্বজন-হারানোর বেদনা ভুলেছিল। সেদিনের সুবিশাল গণমহাসমুদ্রতুল্য মহাসমাবেশ, বাঙালি জাতির পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাসে নজিরবিহীন। জাতির জনকের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে বাঙালির মরা গাঙে এমন জনজোয়ার নেমেছিল যে, সেদিন সকলেই জয় বাংলা রণধ্বনিতে চারদিক প্রকম্পিত করে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষায় দে খুলে দে পাল তুলে দে যা হয় হবে বাঁচি মরি প্রতীজ্ঞায় আপ্লুত হয়েছিল। ইতিহাসের পাতায় দিনটি কান্না-হাসির দোলদোলানো আনন্দাশ্রু বিসর্জনের দিন। ১৬ই ডিসেম্বর পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করলেও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির প্রশ্নে পাকিস্তানের নূতন রাষ্ট্রপতি জনাব ভুট্টো প্রথমে টালবাহানা করলেও অবশেষে বিশ্বজনমতের চাপে নতি স্বীকার করেন। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির ১ সপ্তাহ পূর্বে করাচির এক সমাবেশে জনাব ভুট্টো নাটকীয়তার সৃষ্টি করে জনসভায় আগত জনতার উদ্দেশে প্রশ্ন রেখে বলেন, তোমরা কি মুজিবের মুক্তি চাও? জনতা সমস্বরে সম্মতিসূচক জবাব দিলে নতমস্তকে ভুট্টো বলেন, তোমরা আমকে বড় একটি বোঝা থেকে মুক্তি দিলে। ক্ষমতালোভী রাজনীতির খলনায়ক ভুট্টোর ষড়যন্ত্রেই মূলত বাংলাদেশে পাকবাহিনী গণহত্যা শুরু করেছিল ।
পাকবাহিনীর গণহত্যা ও বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা
১৯৭১-এর ২৫শে মার্চ রাত ১১-৩০ মিনিটে পূর্বপরিকল্পিত অপারেশন সার্চলাইট” অনুযায়ী পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক বাঙালি নিধনে গণহত্যা শুরু হয়। গণহত্যা অভিযান শুরু হওয়ার এক ঘন্টা পর অর্থাৎ ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহর রাত ১২-৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন ইপিআর-এর ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্বাধীনতার ঘোষণায় তিনি বলেন, এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন| বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন, আপনাদের যা কিছু আছে তাই দিয়ে সেনাবাহিনীর দখলদারীর মোকাবিলা করার জন্যে আমি আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদেরকে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদানের এক ঘন্টা পর অর্থাৎ রাত ১-৩০ মিনিটে পাকবাহিনী বঙ্গবন্ধুর বাসভবন ঘেরাও করে তাঁকে গ্রেফতার করে প্রথমে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে এবং পরদিন পাকিস্তানে নিয়ে যায়। গ্রেপ্তার হওয়ার প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণা ৭১-এর ১০ই এপ্রিল, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে মুজিবনগরে গঠিত বাংলাদেশ গণপরিষদ কর্তৃক সর্বসম্মতিক্রমে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে গৃহীত হয়। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ৬নং প্যারায় বলা হয়েছে, …বাংলাদেশের সাড়ে সাতকোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন…। এবং ১১ নং প্যারায় বলা হয়েছে, …যেহেতু আমরা বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী ঘোষণা করিতেছি এবং উহা দ্বারা পূর্বাহ্ণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা অনুমোদন করিতেছি…।
লক্ষণীয় যে, বঙ্গবন্ধু মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণায় কোথাও নিজ নামোল্লেখের প্রয়োজন মনে করেন নি। বরং স্ব-সৃষ্ট পরিপক্ক রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে স্পষ্ট ঘোষণায় বলেছেন, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন| এরকম সোজাসাপ্টাভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার রাজনৈতিক বৈধতা কেবল তাঁরই ছিল, অন্য কারো নয়। এটা তিনি অর্জণ করেছিলেন। ৭০-এর নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা সরকার গঠন করে সংবিধান তৈরী করবেন এটিই ছিল গণঅভিপ্রায়। ৭১-এর রক্তঝরা মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের দিনগুলোতে বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধু মুজিবের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে তাদের এই অভিপ্রায় বিশ্ববাসীকে বুঝিয়ে দিয়েছিল। আর এসব কিছুর ভিত্তি বঙ্গবন্ধু রচনা করেছিলেন ১৯৭১-এর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে রেসকোর্স ময়দানে। ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু মুজিব প্রিয় দেশবাসীর নিকট যা অঙ্গীকার করেছিলেন সেসব পুনর্ব্যক্ত হয়েছে তাঁর ১০ই জানুয়ারির ভাষণে। ৭ই মার্চ এবং ১০ই জানুয়ারি যেনো একসূত্রে গাঁথা।
৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের অন্তর্নিহিত সত্য
রক্ত চোখের আগুন মেখে ঝলসে যাওয়া জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সুদীর্ঘ বছরগুলো অতিক্রম করে ঔপনিবেশিক নিপীড়ন থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় বাঙালি জাতি বুক বেঁধে দল মত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের ছায়াতলে ৭১-এর ৭ই মাচর্, রবিবার, রমনা-রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান)। এদিনে বঙ্গবন্ধু বজ্রকণ্ঠে ব্যক্ত করেছিলেন বাঙালী জাতির বহুশতাব্দীর লালিত পরমারাধ্য স্বাধীনতা ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভিপ্রায়। প্রতি মিনিটে উচ্চারিত ৫৯টি শব্দসহ সর্বমোট ১১০৮টি শব্দসম্বলিত ১৯ মিনিটের এই ভাষণটিতে ঘনীভূত হয়ে আছে রাজনৈতিক অধিকার বঞ্চিত বাঙালী জাতির কয়েকটি শতক। কী করে এমনটি সম্ভবপর হয়? ইতিহাসে সে প্রশ্নের উত্তর নিহিত আছে।
৪৭-এ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে দীর্ঘ ২৩ বছরে রাজনৈতিক অধিকার অর্জনের ধাপে ধাপে শত শহীদের রক্তস্নাত ৫২-এর ভাষার অধিকার থেকে ৬৯-এর সার্বজনীন ভোটাধিকার অর্জন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সূচিত সংগ্রামের প্রতিটি ধাপই ছিল নিয়মতান্ত্রিক তথা গণতান্ত্রিক। নিয়মতন্ত্র হচ্ছে গণতন্ত্রের আধেয়। নিয়মতন্ত্রকে উপজীব্য করে ৬৬-তে ৬ দফা দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক জীবনে নিয়মতন্ত্রের বাইরে একটি পদক্ষেপও নেন নি। ৫২-এর মহান ভাষা আন্দোলনে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মাতৃভাষার অধিকার অর্জনের রক্তস্নাত পথ বেয়ে ৬৯-এর মহান গণঅভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে বাঙালী জাতি অর্জন করে সার্বজনীন ভোটাধিকার। ভোটাধিকার অর্জনটি ছিল রাজনৈতিক অধিকার অর্জনের প্রাথমিক ধাপ। এরপরপরই সামনে আসে ৭০-এর নির্বাচন। এই নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগের প্রথম সুযোগে নির্বাচনটি রূপান্তরিত হয় ৬ দফা ও ১১ দফার পক্ষে রেফারেন্ডামে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ অর্জন করে ঐতিহাসিক বিজয়। নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিনিধির নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর না করার ষাড়যন্ত্রিক প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতা ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনের সর্বব্যাপী গণজাগরণের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ভাষণটি প্রদান করেন। ভাষণের প্রারম্ভেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের সংখ্যাগুরু বাঙালি জাতির রাজনৈতিক অধিকার বারংবার ভুলুণ্ঠিত হওয়া আর চরম নিষ্ঠুরতা ও পৈশাচিকতায় তা দমিয়ে দেওয়ার পুঞ্জিভূত মনোবেদনা উপস্থাপন করে রক্তাক্ত হৃদয়ে জলদগম্ভীর স্বরে বঙ্গবন্ধু বলেন, ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। নির্যাতিত-নিপীড়িত জনসাধারণের প্রতি সুউচ্চ আস্থা প্রকাশ করে বলেন আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন।
জনসভায় আগত শ্রোতৃমণ্ডলীর প্রত্যেকেই এসেছিলেন সমগ্র জাতির প্রতিনিধি হিসেবে। সভায় আগত জনদের অধিকাংশই ছিলেন ৬ দফা ও ১১ দফা আন্দোলনের দীর্ঘদিনের একনিষ্ঠ কর্মী, সহযোদ্ধা এবং সমর্থক। বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার দশ লক্ষাধিক মানুষের সমবেত সমাবেশের মূল চেতনাই ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ। সমবেত শ্রোতৃমণ্ডলীর আচরণে গণতান্ত্রিক আচরণ বিধির সর্বোচ্চ প্রকাশ পরিলক্ষিত হয়। এতো নিয়মানুগ, সুশৃঙ্খল এবং সুসংগঠিত যে মনে হয় একটি গণবিপ্লবী পার্লামেন্টের উদ্বোধনী অধিবেশন চলছে। যে অধিবেশনে বক্তব্য রাখছেন সমগ্র জাতির এমন একজন প্রতিনিধি যিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ম্যান্ডেট প্রাপ্ত, সর্বশ্রেণীর বাঙালীর সর্বোচ্চ ভালোবাসায় সিক্ত তাদের অধিকার আদায়ের মূর্ত প্রতীক। আর তাই ভাষণের শুরুতে ভাই বলে সম্বোধন অর্থাৎ একান্ত আপনজন। এ আচরণ একান্তই বাঙালির। আপনজনের সম্মুখে দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে হাজির হয়েছি বলার মধ্যদিয়ে সংগ্রামী জনতা এবং নেতা একসূত্রে সূত্রবদ্ধ হয়ে ওঠে। অতঃপর আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন কী অবিশ্বাস্য আস্থা! শাসক চক্রের জটিল এক ষাড়যন্ত্রিক ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে জনসভায় উপস্থিত শ্রোতৃমণ্ডলী পুরোপুরি জ্ঞাত এবং তারা তা সম্যক জানেন এবং বোঝেন। বক্তব্যের এ অংশটিতে নেতা এবং জনতা ঊভয়েই প্রতিনিয়ত সংঘটিত বাস্তবতায় সহমত পোষণ করেন। এরপর চলমান বাস্তবতায় উপনীত হওয়ার পূর্বে দীর্ঘ ২৩ বছরের বাঙালির করুণ ইতিহাসের সারাংশ উপস্থাপনে বলেন, কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, ২৩ বৎসরের করুণ ইতিহাস, বাংলায় অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বছরের ইতিহাস মুমূর্ষ নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস, এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। এ করুণ ইতিহাসের তিনি কেবল একজন প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী নন, কেবলমাত্র একজন সংগঠক নন, বঙ্গবন্ধু মুজিব ছিলেন রাজনৈতিক অধিকার বঞ্চিত মুমূর্ষ নর-নারীর অবিসংবাদিত নেতা। ফলে নেতার বীরত্বই পরিস্ফুট হয়েছে কণ্ঠে। যেহেতু বীরের চোখে অশ্রু বেমানান” আর তাই সীমাহীন বঞ্চনা আর লাঞ্ছনার বেদনার্ত অনুভব তাঁর কণ্ঠকে বাষ্পরুদ্ধ করতে পারে নি- করেছে বজ্রের মতো কঠিন। অতঃপর দীর্ঘ ইতিহাস বর্ণনা করে ষড়যন্ত্রকারী ভুট্টো আর সেনাশাসক জেনারেল ইয়াহিয়ার সাথে কথোপকথন ও বিদ্যমান পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করে নিজ রাজনৈতিক অবস্থান জনতার নিকট তুলে ধরে তীক্ষ্ণ স্বরে তির্যক কণ্ঠে বলেন, কী পেলাম আমরা? যে আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরীব-দুঃখী-নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে। তার বুকের উপর হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু, আমরা বাঙ্গালীরা যখনই ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করেছি, তখনই তাঁরা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। জাতিগত নিপীড়নের নিদারুণ সত্যসমূহ উল্লেখ করে জনতার প্রতি ৫টি নির্দেশ এবং পাকিস্তানী সামরিক শাসকদের উদ্দেশে ৫টি শর্ত দিয়ে বিদ্যমান পরিস্থিতির উন্নতি না ঘটলে আসন্ন স্বাধীনতার ঘোষণাও প্রদান করেন। বাংলার মানুষের প্রতি কর্তৃত্বমূলক এই নির্দেশাবলি প্রদানের অমিতবিক্রম তেজ, আস্থা আর প্রগাঢ় আত্মবিশ্বাস তিনি অর্জন করেছিলেন দীর্ঘ সংগ্রামের অগ্নি পরীক্ষায়।
এদেশের মানুষের অধিকার ধারিত ছিল বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ৬ দফায়। কার্যত ৭০-এর নির্বাচনী গণরায়ে ৬ দফার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ব্যক্ত হয়। আর তাই ৭১-এর ৩রা জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বঙ্গবন্ধু নিজেই শপথ বাক্য পাঠ করান। উক্ত শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে প্রদত্ত বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, যদি কেহ ৬ দফার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তবে বাংলার মানুষ তাকে জ্যান্ত সমাধিস্থ করবে। এমনকি আমি যদি করি আমাকেও। কেননা ৬ দফা আজ আর আমার বা আওয়ামী লীগের নয়, এ আজ জাতির সম্পদে পরিণত হয়েছে।” মুখ্যত, ৩রা জানুয়ারির শপথ অনুষ্ঠানের পর থেকে ৬ই মার্চের মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনার ধারাবাহিকতায় এটা স্বতঃস্পষ্ট যে, ইয়াহিয়া খান এবং ভুট্টো ষড়যন্ত্র আর চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে ৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়নে বিরত রাখতে নানামুখী কলাকৌশল অবলম্বন করেও ব্যর্থ হয়েছিলেন। বস্তুত, ৬ দফা মানলে অখণ্ড পাকিস্তানের অস্তিত্ব টিকবে অন্যথায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাঙালি জাতি ১ দফা তথা পরিপূর্ণ স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যাবে এটাই হয়ে উঠেছিল অনিবার্য বাস্তবতা। এরকম বাস্তবতার মধ্যেও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর টালবাহানার বিপরীতে সংখ্যাগরিষ্ঠের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ঔদার্য লক্ষণীয়। যখন তিনি বিরোধীদের উদ্দেশে বলেন, এমনকি আমি এ পর্যন্তও বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশী হলেও, একজন যদিও সে হয়, তার সে ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেবো।” মহান ফরাসী বিপ্লবের পটভূমি তৈরী করে গিয়েছিলেন যে চিন্তাবীর, সেই মহান চিন্তাবিদ ভলত্যেয়ারের বিখ্যাত সেই উক্তি- তোমার কথা আমার বিরুদ্ধে যেতে পারে, কিন্তু তোমার কথা বলার অধিকার রক্ষায় আমি জীবন দিতে প্রস্তুত।” ভলত্যেয়ার কথিত ব্যক্তিক পর্যায়ের এবংবিধ কাব্যিক প্রবচনকে ছাপিয়ে আরো অনেক গভীর ও মহত্তর রাজনৈতিক-দার্শনিক প্রত্যয় ব্যক্ত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর উক্তিতে। এটি নিছক কথার ফুলঝুরি নয়, নয় শুধু প্রবচন মাত্র- বক্তব্যটিতে রয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ কর্তৃক একজন হলেও তার ন্যায্য কথা মেনে নেওয়ার অঙ্গীকার। সমগ্র ভাষণে একথাটি দার্শনিক প্রতীজ্ঞায় উন্নীত একটি স্বতঃসিদ্ধপ্রত্যয়| ন্যায্য ও অন্যায্যর প্রশ্ন যেখানে, সেখানে সংখ্যাগুরু কী সংখ্যালঘু তথা সংখ্যা বা পরিমাণের প্রশ্নটি মুখ্য নয়। প্রধান বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে ন্যায্যতা বা বৈধতা। যা নিরুপিত বা পরিমাপিত হবে যৌক্তিকতা দিয়ে। সীমাহীন নির্যাতন, প্রবঞ্চনা আর ষড়যন্ত্রের মৃত্যু উপত্যকা থেকে বেরিয়ে এসে অবাধ নির্বাচনের মধ্যদিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত নেতার মুখ নিঃসৃত এ উক্তি সংখ্যাগরিষ্ঠের গণতান্ত্রিক ঔদার্য ও দার্শনিক মহানুভবতায় সিক্ত। নিঃসন্দেহে জাতির জনকের এ উক্তির জন্য বাঙালি হিসেবে আমরা গর্ববোধ করতে পারি। কেননা গণতান্ত্রিক চিন্তনের ইতিহাসে এ উক্তিটির গুরুত্ব সমধিক।
ভাষণের শেষাংশ এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম পুরো ভাষণটির উপসংহার। জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের উত্তুঙ্গ অবস্থায়ই কেবল জাতির অবিসংবাদিত নেতার মুখ থেকে এমন উক্তি সম্ভব। আরো বহু নেতা ছিলেন। যারা বঙ্গবন্ধুর সমসাময়িক শুধু নন, ছিলেন তার গুরুতুল্য অনেকেই। কিন্তু এমন মহৎ উক্তি ধারিত প্রত্যয়দীপ্ত একটি ভাষণে এরকমভাবে পরিস্থিতির মোকাবেলা করে স্বাধীনতার ঘোষণা অন্য কেউই দিতে পারেন নি। বঙ্গবন্ধু পেরেছিলেন। কেননা স্বাধীনতা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রাজনৈতিক তৎপরতা আরম্ভ করেছিলেন ১৯৪৮ থেকে। এজন্যই তিনি বলেন, ২৩ বৎসরের করুণ ইতিহাস, বাংলায় অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস।” এ ইতিহাসের নির্যাতিত নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু মুজিব স্বয়ং| যিনি ২৩ বছর পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে ১০ বৎসরের অধিককাল কারাগারে বন্দী ছিলেন। ৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ৭৫% বাঙালির সমর্থন অর্জন করে। এজন্যই জাতীয় মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় উজ্জীবিত বাঙালি বিদ্যমান পরিস্থিতির রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, করণীয় বা স্বাধীনতার ঘোষণা শোনার জন্য প্রতীক্ষার প্রহর গুনছিল কেবল বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকেই- অন্য কারও কাছ থেকে নয়। ৭১-এর মার্চের শুরুর দিন থেকেই জেনারেল ইয়াহিয়ার প্রতারণার বিরুদ্ধে দেশজুড়ে জনমনে যে সর্বব্যাপী ক্ষোভ-বিক্ষোভ দেখা দেয় তা দমনে শাসকগোষ্ঠী চরম নিষ্ঠুরতা আর পৈশাচিকপন্থা অবলম্বন করে। ফলে প্রতিদিন শত শত মানুষের রক্তে রঞ্জিত হয় প্রতিটি দিন। ১ থেকে ৬ তারিখের মধ্যে সারা দেশে নিহতের সংখ্যা দাড়ায় সহস্রাধিক। এমন অগ্নিগর্ভ বৈপ্লবিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে উদীয়মান নবীন প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার গণঅধিবেশন যেনো ৭ই মার্চের রেসকোর্স ময়দান। আর ভাষণটি ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠের ম্যান্ডেট প্রাপ্ত নেতার গণফরমান।
৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণঃ ইতিহাসের সারনির্যাস
সার্বিক দিক বিচারে ৭ই মার্চের ভাষণ বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসের সারনির্যাস। ভাষণটিতে প্রতিফলিত হয়েছে অতীত এবং বিদ্যমান বাস্তবতায় স্বৈরতান্ত্রিক কার্যকলাপ তথা ছল-চাতুরী, হুমকি-ধামকি, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, জেল-জুলুম, হত্যা-নির্যাতন ইত্যাকার অবৈধ অগণতান্ত্রিক আচরণের বিপরীতে সুশৃঙ্খল নিয়মতান্ত্রিক বক্তব্য। পরিপূর্ণ নিয়মতান্ত্রিকতা অক্ষুণ্ন রেখে গণতান্ত্রিক পন্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠের বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে রাজনৈতিক অধিকার অর্জনে পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ ও বিচ্ছিন্নতাবাদে অভিযুক্ত করবার ষড়যন্ত্র ভেদ করে নিপুণ কৌশলে পূর্ণ স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদানের পথ কণ্টকমুক্ত করার রণনীতি ও রণকৌশলের অপূর্ব মিথস্ক্রিয়ায় উদ্ভাসিত ভাষণটির প্রতিটি বাক্য। যে স্থানে, যে সময়ে, যতো মানুষের উপস্থিতিতে ভাষণটি প্রদান করা হয়েছে তার পুরো ক্যানভাসটি যেন দিগন্ত বিস্তৃত জনসমুদ্রের উর্মিমালা। আর এর প্রেক্ষাপটটি এক কথায় চরম উত্তেজনাকর। রাজনৈতিক অধিকার অর্জনে তথা জাতি রাষ্ট্র গঠনে আসন্ন গণতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটনার্থে এরূপভাবে নিরস্ত্র মানুষের এতো সুবিপুল মহাসমাবেশে এমন মহিমান্বিত মর্যাদাপূর্ণ গৌরবমণ্ডিত ভাষণ গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ইতিহাসে অদৃষ্টপূর্ব।
প্রিয় মাতৃভূমির পরিপূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনে স্থির-প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্বিচার গুলিবর্ষণে প্রতিদিন স্বদেশবাসীর অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুতে বিক্ষুব্ধ, বীর বাঙালির মনোসংযোগে নিবেদিত ভাষণটির প্রতিটি শব্দ এবং বাক্য। আর বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠের উচ্চারণ যেন মেঘনাদসম। যেভাবে উৎস থেকে নদী বেরিয়ে আসে সেইভাবে ভাষা বেরিয়েছে বঙ্গবন্ধুর চেতনার মর্মমূল থেকে। সুদীর্ঘ সংগ্রামের রক্ত-পিচ্ছিল পথে বঞ্চনার শিকার একটি জাতির শত-সহস্র মানব সন্তানের আত্মদানের মধ্যদিয়ে অর্জিত ৭ই মার্চ। তবুও ভাষণটির কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই। আছে স্বজন হারানোর বেদনা ভারাক্রান্ত মন। দীর্ঘদিনের বিয়োগ ব্যথা তৎসহ সংখ্যাগুরুর রাজনৈতিক অধিকারহীনতায় ঝলসে যাওয়া বছরগুলোর পুঞ্জিভূত শোক থেকে তৈরী হওয়া ইস্পাত-কঠিন সুদৃঢ় ঐক্য। আছে স্ফটিক-স্বচ্ছ সাবলীলতা, স্বতঃস্ফূর্ত শব্দ সঞ্চালন, সুচিন্তিত সংলাপ প্রক্ষেপণ, ইতিহাস বর্ণন, প্রবর্ধমান প্রবোধ, প্রবঞ্চিত ক্রোধ, গণচৈতন্যে প্রবিষ্ট প্রবুদ্ধ প্রবাহ, মহিমান্বিত কর্তৃত্ব, প্রমিত আত্মবিশ্বাস, প্রজ্ঞাচক্ষু প্রজ্ঞাপক, দক্ষ কৌশলীর প্রজ্ঞানসহ আবেগের পরিমিতি ও প্রজ্বলন, প্রশান্ত সহিষ্ণুতা, জনকের অভিব্যক্তি, প্রতিজ্ঞাত প্রতিজ্ঞা, নিয়মানুগ বিনম্রতা, বজ্রকঠিন নির্দেশ, বীরভোগ্যা বসুন্ধরার সৌম্যকান্তি, সর্বংসহা ধরিত্রীর মমত্ব সর্বোপরি ব্যক্তিসত্তার অভ্যন্তরে ধূমায়িত গণসার্বভৌমত্বের জ্যোতির্ময় বহিঃপ্রকাশ। ইতিহাসে সমাজ বিপ্লবের যে পর্বে এক সকলের তরে সকলে একের তরে তথা নেতা জনতার তরে জনতা নেতার তরে” এক সূত্রে সূত্রবদ্ধ হয় ৭ই মার্চ বাঙালির ইতিহাসে সেই পর্ব হিসেবে চিহ্ণিত। বিশ্বে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র উদ্ভবের ইতিহাসে এ এক বিশুদ্ধ গণতান্ত্রিক দৃষ্টান্ত। জাতীয় আত্মবিশ্বাসে দৃঢ়-প্রতীজ্ঞ ও আস্থাশীল ভাষণটির তীর্যক শব্দতরঙ্গ যেনো শত্রুকে উদ্দেশ করে বলছে আমার হাতেই নিলাম আমার নির্ভরতার চাবি, তুমি আমার আকাশ থেকে সরাও তোমার ছায়া, তুমি বাংলা ছাড়ো।
৭ই মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের সাফল্য হচ্ছে সংখ্যাগুরু বাঙালিকে বিচ্ছিন্নতাবাদের দায় থেকে মুক্ত করে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান। ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকে ৭২-এর ৮ই জানুয়ারি পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু মুজিবকে রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। এসময়ে তাঁর কোন বিবৃতি, বার্তা বা কণ্ঠস্বর শোনা যায় নি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করাকে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ হিসেবে গণ্য করে পাকিস্তানী সামরিক শাসকগোষ্ঠী প্রহসনমূলক বিচারের নামে তাঁকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে হত্যা করার আয়োজন করেছিল। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের পরমমিত্র ভারতবর্ষের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী মহিয়সী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় বিশ্বনেতৃবৃন্দের চাপে জেনারেল ইয়াহিয়ার ষাড়যন্ত্রিক অভিলাষ ভেস্তে যায় এবং বঙ্গবন্ধু মুক্তি লাভ করেন এবং বন্দীত্ব থেকে বাংলার গণমানুষের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার উত্তুঙ্গ শিখরে আরোহণ করেন।
বঙ্গবন্ধুর বন্দীজীবনের শেষ দিনগুলি
পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী বঙ্গবন্ধু মুজিবের দিনগুলো কেমন ছিল? এতদ্বিষয়ে আমাদের মননের দীনতা এতোটাই যে, অদ্যাবধি জাতির জনকের জীবন সম্পর্কে সামগ্রিকতায় নিবিড় কোন গবেষণা হয় নি। দায়সাড়াভাবে করা কিছু সাক্ষাৎকার ও ছেঁদো গবেষণা থেকে যতদূর জানা যায় তা নিতান্তই অপ্রতুল। পাকিস্তানের কারাগারে বন্দীজীবন সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকারের পরে ভিত্তি করে পাশ্চাত্যের প্রখ্যাত লেখক-সাংবাদিক রবার্ট পেইন তাঁর দি টর্চার্ড অ্যান্ড দি ড্যামড গ্রন্থে কিছু তথ্য লিপিবিদ্ধ করেছেন। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী গণযুদ্ধের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর অর্থাৎ ১৬ই ডিসেম্বরের ১০ দিন পর ২৬শে ডিসেম্বর রাতে মুজিবকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার ঘটনার যে বিবরণ বইটিতে আছে তা হুবহু তুলে দিচ্ছি।
মিয়ানওয়ালী কারাগারের প্রিজন গভর্নর জনাব হাবীব আলীকে উদ্ধৃত করে রবার্ট পেইন লিখেছেন, কর্তৃপক্ষের নির্দেশ পাবার পরপরই একটা ট্রাক নিয়ে মিয়ানওয়ালী কারাগারের দিকে যাই। কারা ফটক খুলে তার সেলের কাছে গিয়ে দেখি তিনি একটা কম্বল জড়িয়ে বিছানার উপর ঢুলছেন। এমন সময় সেখানে যারা কয়েদী ছিল তারা মুজিবকে ফিসফিস করে বলছিল যে, ওরা এসেছে। মুজিবও ফিসফিসিয়ে বললেন যে, শেষ পর্যন্ত আমি মাথা নত করবো না। তার আগে মিয়ানওয়ালী কারাগারেই সেলের মধ্যে একটা কবর খোড়া হয়েছিল। মুজিব যখন জিজ্ঞেস করেছিল, এটা কী? তখন তাঁকে বলেছিলাম যে, যুদ্ধ চলছে এটা বাংকার। শেল্টার নেবার জন্য। আসলে ছিল কবর। তখন মুজিবকে একজন কয়েদী বলছিল যে, আসলে এটা কবর। আপনি যদি আজ বের হন আপনাকে মেরে এখানে কবর দেওয়া হবে। তখন মুজিব আমাকে বলেছিল, কবরকে আমি ভয় পাই না। আমি তো জানি ওরা আমাকে ফাঁসী দেবে। কিন্তু আমি জানি আমার বাংলাদেশ একদিন স্বাধীনতা হবে। এবং আমি এও জানি, বাংলার দামাল ছেলেরা হাসিমুখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে পারে। সেই বাঙালী জাতিকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না। তিনি সেদিন মিনতি করে বলেছিলেন, আমাকে হত্যা করে এই কবরে না, এই লাশটি আমার বাংলার মানুষের কাছে পৌঁছে দিও। যে বাংলার আলো-বাতাসে আমি বর্ধিত হয়েছি- সেই বাংলার মাটিতে আমি চির-নিদ্রায় শায়িত থাকতে চাই।
যাহোক, ঐদিন ২৬ তারিখে আমি ট্রাকে করে মুজিবকে নেওয়ার জন্য মিয়ানওয়ালী কারাগারে আসি। কারণ ইতোমধ্যে এহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর করেছেন এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। ক্ষমতা হস্তান্তরকালে এহিয়া খান ভুট্টোর কাছে প্রার্থনা করেছিল যে, আমার ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে শেখ মুজিবকে হত্যা করার অনুমতি দাও। আমার জীবনে যদি কোন ভুল করে থাকি তাহলে শেখ মুজিবকে ফাঁসী কাষ্ঠে না ঝুলানো। তখন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো আমার নিকট এই মর্মে জরুরী বার্তা প্রেরণ করেন যে, শেখ মুজিবকে কারাগার থেকে দ্রুত নিরাপদ কোন স্থানে সরিয়ে ফেলা হোক। তখন আমি মুজিবকে মিয়ানওয়ালী কারাগার থেকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে ট্রাক নিয়ে কারা ফটকে আসি এবং সেলের মধ্যে গিয়ে শেখ মুজিবকে আমার সাথে যেতে অনুরোধ করি। কিন্তু তিনি আমাকে বাধা দেন। তখন আমি তাঁকে বলি, শেখ, আমি আপনার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী, বন্ধু। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আমি আপনাকে এখান থেকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে এসেছি। কারণ, এখানে কমান্ডো আসতে পারে। তারা আপনাকে হত্যা করবে। আমার উপর আপনি আস্থা রাখুন।
তারপর মুজিবকে ট্রাকে তুলে, ট্রাকের মধ্যে লুকিয়ে, আমার চশমা ব্যারাজ নামক বাড়ীতে নিয়ে যাই। সেখানে গিয়েই তিনি একটা টেলিফোন করতে চান। মুজিব আমাকে বলেছিলেন, আমি কী আমার স্ত্রীর সাথে কথা বলতে পারি। তখন আমি তাকে বলেছিলাম, না, আমার একমাত্র কাজ হলো আপনার জীবন রক্ষা করা। আপনি টেলিফোন করতে পারবেন না। তখন তিনি বললেন, আমি কী খবরের কাগজ পড়তে পারি। আমার উত্তর ছিল, না। এরপর বললেন, আমি কী এক কাপ চা পেতে পারি। তখন তাঁকে এক কাপ চা দেওয়া হয়। আমার বাড়ীতে তিনি দুই দিন থাকেন।
দিন দুই পরে মুজিবকে নিয়ে যাই শাহুল্যা নামক স্থানে। যেটা একসময় বৃটিশ সেনাবাহিনীর রেস্ট হাউস ছিল। পিন্ডির থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে এই শাহুল্যাতে প্রেসিডেন্ট ভুট্টো মুজিবের সাথে সাক্ষাৎ করতে আসেন। ভুট্টো যখন আসলেন তখন একজন কর্নেল এসে মুজিবকে বলছিল, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসবে। তারপরে সেখানে ভুট্টো আসলেন এবং মুজিবকে সালাম দিয়ে বললেন যে, নাউ আই অ্যাম দ্য প্রেসিডেন্ট অব পাকিস্তান অ্যান্ড চীফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর। ঐ অবস্থায় মুজিব হেসে দিলেন। তখন ভুট্টো জিজ্ঞেস করলেন, আপনি হাসছেন কেন? তখন মুজিব বললেন, আমি বুঝতে পারি একজন প্রেসিডেন্ট সিভিলিয়ান হতে পারে। কিন্তু আমি অবাক হই যখন শুনি যে, একজন সিভিলিয়ান প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। তখন ভুট্টো বলেছিলেন, দ্যাট ইজ পসিবল ইন পাকিস্তান। তারপরই মুজিবের দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল যে, ভুট্টো, টেল মি ফার্স্ট, হোয়েদার আই অ্যাম এ ফ্রি ম্যান অর প্রিজনার। তখন ভুট্টো উত্তর দিয়েছিলেন, নাইদার ইউ আর এ প্রিজনার, নর ইউ আর এ ফ্রিম্যান। তখন মুজিব পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, ইন দ্যাট কেইস আই উইল নট টক টু ইউ। তখন জুলফিকার আলী ভুট্টো বলতে বাধ্য হলেন যে, ইউ আর এ ফ্রিম্যান। এরপর মুজিব প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর সাথে কথা বলতে শুরু করলেন। ভুট্টো অনেক রকমের প্রস্তাব দিলেন। কীভাবে একটা কনফেডারেশন করা যায়, কীভাবে একসাথে থাকা যায়, ইত্যাদি। কিন্তু মুজিব কোন কথাই বললেন না। চুপ করে থেকে শুধু বললেন, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি আমার প্রিয় সহকর্মীদের সাথে কথা বলতে না পারবো, ততক্ষণ আমার পক্ষে কিছুই বলা সম্ভবপর নয়। এরপর মুজিবকে একটা যৌথ ইশতেহার দেওয়া হয়েছিল স্বাক্ষর করার জন্য। মুজিব সেটাও প্রত্যাখ্যান করলেন। পরিশেষে শেখ মুজিব বললেন, আমি কী এখন দেশে যেতে পারি? ভুট্টো বললেন, হ্যাঁ, যেতে পারেন। কিন্তু কীভাবে যাবেন? পাকিস্তানের পিআইএ ভারতের উপর দিয়ে যায় না। তখন মুজিব বললেন, সেক্ষেত্রে আমি লন্ডন হয়ে যাবো।
বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও লন্ডনে সংবাদ সম্মেলনঃ আমি এই মুহূর্তে আমার জনগণের কাছে ফিরে যেতে চাই
ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দুটি বৈঠক করার পর তার প্রতিশ্রুতি রাখেন এবং ৮ই জানুয়ারি আগে থেকে পাকিস্তানে অবস্থানরত ডঃ কামাল হোসেনসহ বঙ্গবন্ধুকে পিআইএর একটি বিশেষ বিমানে তুলে দেন। বিমানটি সর্বোচ্চ গোপনীয়তার মধ্যে রাত তিনটায় লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। গোপনে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিয়ে ইসলামাবাদ ত্যাগের এই খবর সাংবাদিকরা জানতে পারেন ১০ ঘন্টা পর। লন্ডনে পৌঁছে ক্ল্যারিজ হোটেলে বঙ্গবন্ধু অবস্থান গ্রহণ করেন এবং জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে একটি বিবৃতি প্রদান করেন। প্রগাঢ় দেশপ্রেম ও জনসাধারণের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা ব্যক্ত হয়েছে তাঁর বক্তব্যে। বিবৃতিতে তিনি বলেন, “বাংলার মুক্তি সংগ্রামে আজ আমি স্বাধীনতার অপরিসীম ও অনাবিল আনন্দ অনুভব করছি। এই মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। আমার জনগণ যখন আমাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেছে তখন আমি রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামী হিসেবে একটি নির্জন ও পরিত্যক্ত সেলে বন্দী জীবন কাটাচ্ছি।
বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে সমর্থন ও সহযোগিতা দানের জন্যে ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড, ফ্রান্স ও ব্রিটেনকে আমি ধন্যবাদ জানাই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সমর্থনদানকারী মার্কিন জনগণ ও অন্যান্য জনসাধারণকেও আমি ধন্যবাদ জানাই। স্বাধীনতা, সার্বভৌম বাংলাদেশ এখন একটি বাস্তব সত্য। এ দেশকে বিশ্বের স্বীকৃতি দিতে হবে। বাংলাদেশ অবিলম্বে জাতিসংঘের সদস্য পদের জন্যে অনুরোধ জানাবে।
পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ আমার বিরুদ্ধে বিচারের নামে এক প্রহসন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। শুনানি অর্ধেক সমাপ্ত হবার পর পাক কর্তৃপক্ষ আমার পক্ষ সমর্থনের জন্যে একজন আইনজীবী নিয়োগ করে। আমি কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে বিশ্বাসঘাতকের কলঙ্ক নিয়ে মৃত্যুদণ্ডের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়কর, আমার বিচারের জন্যে যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল তার রায় কখনো প্রকাশ করা হবে না। সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বিচারের নামে প্রহসন অনুষ্ঠান করে আমাকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানোর ফন্দি এঁটেছিলেন। কিন্তু ভুট্টো এই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে অস্বীকার করেন।
জনাব ভুট্টো আমাকে না বলা পর্যন্ত স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিজয় সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না। জেলখানা এলাকায় বিমান আক্রমণের জন্যে নিষপ্রদীপ জারি করার পর আমি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের কথা জানতে পারি। জেলখানায় আমাকে এক নিঃসঙ্গ ও নিকৃষ্টতম কামরায় বন্দী করে রাখা হয়েছিল। যেখানে আমাকে তারা কোন রেডিও, কোন চিঠিপত্র দেয় নাই। এমনকি বিশ্বের কোথায় কি ঘটছে, তা জানতে দেওয়া হয় নাই।
স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের জনগণের মতো এতো উচ্চমূল্য, এতো ভয়াবহ ও বিভীষিকাময় জীবন ও দুর্ভোগ আর কোন দেশের মানুষকে ভোগ করতে হয় নাই। বাংলাদেশে নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটানোর জন্যে পাকিস্তানী সৈন্যরা দায়ী। হিটলার যদি আজ বেঁচে থাকতো, বাংলাদেশের হত্যাকাণ্ডে সেও লজ্জা পেতো। প্রেসিডেন্ট ভুট্টো আমাকে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে যে কোন একটি সম্পর্ক বজায় রাখার ব্যাপারটি বিবেচনা করতে অনুরোধ জানিয়েছেন। আমি তাঁকে বলেছি, আমার দেশবাসীর সাথে আলাপ-আলোচনা না করে আমি কোন কিছু বলতে পারবো না। আমি আর এক মুহূর্ত এখানে থাকতে রাজি নই। আমি আমার জনগণের কাছে ফিরে যেতে চাই। [সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা ও পূর্বদেশ; ৯ জানুয়ারি, ১৯৭২]
নয়াদিল্লীতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণঃ অশুভের বিরুদ্ধে শুভশক্তির বিজয় হয়েছে
দীর্ঘদিন নির্জন কারাবাসের পর লন্ডনে মাত্র ২৪ ঘন্টা অবস্থান করে ১০ই জানুয়ারি প্রত্যুষে ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবাহিনীর একটি বিশেষ বিমান কমেটে বঙ্গবন্ধু নয়াদিল্লীর পালাম বিমানবন্দরে পৌছুলে ভারতবর্ষের রাষ্ট্রপতি শ্রী ভিভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, মন্ত্রী পরিষদ সদস্যবৃন্দ, সেনাবাহিনীর তিন প্রধান, শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ, বৈদেশিক কূটনীতিকগণ এবং ভারত সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ বিপুলভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিকে স্বাগত জানান। বিমানবন্দরে প্রদত্ত সংবর্ধনা সভার বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেন, আমার জন্যে এটা পরম সন্তোষের মুহূর্ত। বাংলাদেশে যাবার পথে আমি আপনাদের মহতী দেশের ঐতিহাসিক রাজধানীতে যাত্রাবিরতি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি এ কারণে যে, আমাদের জনগণের সবচেয়ে বড় বন্ধু ভারতের জনগণ এবং আপনাদের মহীয়সী প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী- যিনি কেবল মানুষের নয় মানবতারও নেতা, তাঁর নেতৃত্বাধীন ভারত সরকারের কাছে এর মাধ্যমে আমি আমার ন্যূনতম ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারবো। এ অভিযাত্রা সমাপ্ত করতে আপনারা সবাই নিরলস পরিশ্রম করেছেন এবং বীরোচিত ত্যাগ স্বীকার করেছেন।
এ অভিযাত্রা অন্ধকার থেকে আলোয়, বন্দীদশা থেকে স্বাধীনতায়, নিরাশা থেকে আশায় অভিযাত্রা। অবশেষে আমি নয় মাস পর আমার স্বপ্নের দেশ সোনার বাংলায় ফিরে যাচ্ছি। এ নয় মাসে আমার দেশের মানুষ শতাব্দীর পথ পাড়ি দিয়েছে। আমাকে যখন আমার মানুষদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল, তখন তারা কেঁদেছিল; আমাকে যখন বন্দী করে রাখা হয়েছিল, তখন তারা যুদ্ধ করেছিল আর আজ যখন আমি তাদের কাছে ফিরে যাচ্ছি, তখন তারা বিজয়ী। আমি ফিরে যাচ্ছি তাদের নিযুত বিজয়ী হাসির রৌদ্রকরে। আমাদের বিজয়কে শান্তি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করার যে বিরাট কাজ এখন আমাদের সামনে তাতে যোগ দেওয়ার জন্যে আমি ফিরে যাচ্ছি আমার মানুষের কাছে। আমি ফিরে যাচ্ছি আমার হৃদয়ে কারো জন্যে কোন বিদ্বেষ নিয়ে নয়, বরং এই পরিতৃপ্তি নিয়ে যে অবশেষে মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের, অপ্রকৃতিস্থতার বিরুদ্ধে প্রকৃতিস্থতার, ভীরুতার বিরুদ্ধে সাহসিকতার, অবিচারের বিরুদ্ধে সুবিচারের এবং অশুভের বিরুদ্ধে শুভের বিজয় হয়েছে।জয় বাংলা! জয় হিন্দ! [সূত্র : টাইমস অব ইন্ডিয়া, নয়াদিল্লী, ১৩ই জানুয়ারি, ১৯৭২]
হে বিজয়ী বীর নবজীবনেরও প্রাতে নবীন আশার স্বর্গ তোমার হাতে
নয়াদিল্লীর আনুষ্ঠানিকতা শেষে দুপুরে তিনি প্রিয় মাতৃভূমি সদ্য স্বাধীনতা বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। সকাল থেকে বিমানবন্দরে প্রিয় নেতাকে অভ্যর্থনা জানাতে সমবেত হয়েছিল অভূতপূর্ব উচ্ছা্বসে আত্মহারা লক্ষ লক্ষ মানুষ। রাজধানী ঢাকার রাজপথে নেমেছিল জনতার ঢল। জয় বাংলা রণধ্বণি, শ্লোগান, নৃত্য-গীতে মুখরিত মুক্তিযোদ্ধারা বন্দুকের গুলি ফুটিয়ে নেতার আগমন বার্তা ঘোষণা করছিল। সেদিন বহু মানুষ সমবেত হয় সেই ছোট্ট বাড়ীটির সামনে যেখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধু পরিবারকে আটক করে রেখেছিল। ঐদিন বেগম মুজিব রোজা রেখেছিলেন। বাড়ীর সামনে সমবেত জনতার উদ্দেশে হাত নেড়ে অশ্রুসজল চোখে বেগম মুজিব বলছিলেন, মার্চ মাসে গুলি চলেছিল বাংলাদেশের জনগণকে হত্যা করতে, এখন গুলি হচ্ছে আনন্দ করার জন্য।
পাকবাহিনী সৃষ্ট সীমাহীন ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও মানুষ বঙ্গবন্ধুর মুক্তিতে আনন্দিত-উৎফুল্ল। বিমানের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে লক্ষ জনতার উদ্দেশে হাত নেড়ে বিজয়ীর হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে বঙ্গবন্ধুর মুখাবয়ব। বিমানবন্দরে স্বাধীনতা বাংলাদেশ সরকারের নেতৃবৃন্দ, মুজিববাহিনী এবং মুক্তিবাহিনীর সদস্যগণ তাঁকে মাল্যভূষিত করে গার্ড অব অনার প্রদান করে। অতঃপর জনতার মহাসমুদ্র পেরিয়ে সংবর্ধনাস্থল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পৌঁছান। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমবেত লক্ষ লক্ষ জনতার মহাসমাবেশে আবেগাপ্লুত বঙ্গবন্ধু অশ্রুসিক্ত নয়নে বলেন, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন, যাঁরা বর্বর বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন, তাঁদের আত্মার প্রতি আমি শ্রদ্ধা জানাই। পুনরায় ভাইয়েরা আমার বলে জনতাকে সম্বোধন করে তিনি বলেন, লক্ষ মানুষের প্রাণদানের পর আজ আমার দেশ স্বাধীন হয়েছে। আজ আমার জীবনের সাধ পূর্ণ হয়েছে। বাংলাদেশ আজ স্বাধীনতা| বাংলার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, মুক্তিযোদ্ধা ও জনতার প্রতি জানাই সালাম। তোমরা আমার সালাম নাও। আমার বাংলায় আজ এক বিরাট ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা এসেছে। ৩০ লক্ষ লোক মারা গেছে। আপনারাই জীবন দিয়েছেন, কষ্ট করেছেন। বাংলার মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বাস করবে, খেয়ে-পরে সুখে থাকবে, এটাই ছিল আমার সাধনা। বাংলার এক কোটি লোক প্রাণভয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের খাবার, বাসস্থান দিয়ে সাহায্য করেছে ভারত। আমরা ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী, ভারত সরকার ও ভারতবাসীকে আমাদের অন্তরের অন্তস্থল থেকে জানাই কৃতজ্ঞতা। বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধে সমর্থন দান ও সহযোগিতা দানের জন্য ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন জনগণকেও আমি ধন্যবাদ জানাই।
গত ৭ই মার্চ আমি এই রেসকোর্সে বলেছিলাম দুর্গ গড়ে তোল। আজ আবার বলছি আপনারা একতা বজায় রাখুন। আমি বলেছিলাম, বাংলাদেশকে মুক্ত করে ছাড়বো। বাংলাদেশ আজ মুক্ত, স্বাধীন| একজন বাঙালি বেঁচে থাকতেও এই স্বাধীনতা নষ্ট হতে দেব না। বাংলাদেশ ইতিহাসে স্বাধীন দেশরূপেই বেঁচে থাকবে। বাংলাকে দাবিয়ে রাখতে পারে এমন কোন শক্তি নাই। গত ১০ মাসে সেনাবাহিনী বাংলাকে বিরাণ করেছে। বাংলার লাখো মানুষের আজ খাবার নাই, অসংখ্য লোক গৃহহারা। এদের জন্য মানবতার খাতিরে আমরা সাহায্য চাই। বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের প্রতি আমি সাহায্যের আবেদন জানাই। বিশ্বের সকল মুক্ত রাষ্ট্রকে অনুরোধ করছি-বাংলাকে স্বীকৃতি দিন। আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ কর নি। কবিগুরুর এই আক্ষেপকে আমরা মোচন করেছি। বাঙালি জাতি প্রমাণ করে দিয়েছে যে, তারা মানুষ, তারা প্রাণ দিতে জানে। এমন কাজ তারা এবার করেছে যার নজির ইতিহাসে নাই।
আমি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়, নেতা হিসেবে নয়, আপনাদের ভাই হিসেবে বলছি- আমাদের সাধারণ মানুষ যদি আশ্রয় না পায়, যদি দেশবাসী খাবার না পায়, যুবকরা চাকরি বা কাজ না পায়, তাহলে আমাদের এই স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে- পূর্ণ হবে না। আমাদের তাই এখন অনেক কাজ করতে হবে। তোমরা, আমার ভাইয়েরা, গেরিলা হয়েছিলে দেশমাতার মুক্তির জন্যে। তোমরা রক্ত দিয়েছ। তোমাদের রক্ত বৃথা যাবে না। তোমরা বাংলায় যারা কথা বলো না, তারা এখন থেকে বাংলার মানুষ হও। ভাইরা, তাদের গায়ে হাত দিও না; তারাও আমাদের ভাই। বিশ্ববাসীকে আমরা দেখাতে চাই; বাঙালিরা কেবল স্বাধীনতার জন্যেই আত্মত্যাগ করতে পারে, তাই না, তারা শান্তিতেও বাস করতে পারে। অনেকেই আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছে। আমি তাদের জানি। ইয়াহিয়া সরকারের সাথে যারা সক্রিয়ভাবে সহায়তা করেছে তাদের বিরুদ্ধে যথাসময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এদের বিচার হবে। সে ভার সরকারের ওপর ন্যস্ত রাখুন।
ইয়াহিয়া খান আমার ফাঁসির হুকুম দিয়েছিলেন। আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান। বাঙালিরা একবারই মরতে জানে। তাই আমি ঠিক করেছিলাম, আমি তাদের কাছে নতি স্বীকার করবো না। ফাঁসির মঞ্চে যাবার সময় আমি বলবো, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা। তাদের আরো বলেছি, তোমরা মারলে ক্ষতি নাই। কিন্তু আমার লাশ বাংলার মানুষের কাছে পৌঁছে দিও। মার্চের সেই রাতে আমাকে ছেড়ে যাবার সময় আমার সহকর্মী তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুল ও অন্যান্যরা কাঁদছিলেন। কিন্তু আমি বলেছি, এখানেই আমি মরতে চাই। তবুও মাথা নত করতে পারবো না। আমি তাদের বলেছিলাম, তোমরা নির্দেশমতো সংগ্রাম চালিয়ো। তারা সে ওয়াদা পালন করেছে।
বাংলাদেশ আজ মুক্ত, স্বাধীন| কিন্তু আজ আমাদের সামনে অসংখ্য সমস্যা আছে, যার আশু সমাধান প্রয়োজন। বিধ্বস্ত বাংলাকে নতুন করে গড়ে তুলুন। নিজেরাই সবাই রাস্তা তৈরি করতে শুরু করুন। যার যার কাজ করে যান। পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে আমার কোন ক্ষোভ নাই। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা-আপনারা অসংখ্য বাঙালিকে হত্যা করেছেন, অসংখ্য বাঙালি মা-বোনের অসম্মান করেছেন, তবু আমি চাই আপনারা ভাল থাকুন।
আমি আজ বক্তৃতা দিতে পারবো না। ওরা আমার লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে, এমন গ্রাম নেই যেখানে আগুন দেয় নাই, যেখানে মা-বোনদের ইজ্জত নষ্ট করে নাই। আজ বহু ছাত্র, যুবক, বুদ্ধিজীবী ও সহকর্মীকে আমি দেখছি না। এতো বেসামরিক লোককে হত্যা করার নজির আর নাই। প্রথম মহাযুদ্ধ, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধেও এতো বেসামরিক লোক মরে নাই। সকলে জেনে রাখুন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র এবং পাকিস্তানের স্থান চতুর্থ। ইন্দোনেশিয়া প্রথম ও ভারত তৃতীয়। কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাস, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ইসলামের নামে এ দেশের মুসলমানদের হত্যা করেছে। ইসলামের অবমাননা আমি চাই না। আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই যে, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোন ধর্মীয়ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এ দেশের কৃষক-শ্রমিক, হিন্দু-মুসলমান সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে আমি চিনি। তাঁকে আমি জানাই আমার শ্রদ্ধা। তিনি পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর কন্যা, পণ্ডিত মতিলাল নেহরুর নাতনী। তার রক্তে মিশে রয়েছে রাজনীতি। তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বের সকল রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে আমার মুক্তির জন্যে আবেদন করছেন। আমার সাথে দিল্লীতে শ্রীমতী গান্ধীর আলাপ হয়েছে। আমি যখনই বলবো, ভারতীয় সেনাবাহিনী তখনই দেশে ফেরত যাবে। এখনই আস্তে আস্তে অনেককে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। প্রায় ১ কোটি লোক যাঁরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ভয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল এবং বাকি যাঁরা দেশে রয়ে গিয়েছিল, তারা সবাই অশেষ দুঃখ-কষ্ট ভোগ করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে অংশগ্রহণকারী সকল শ্রেণীর জনতাকে আমি পরম কৃতজ্ঞতার সাথে সালাম জানাই। আমি সালাম জানাই-মুক্তিবাহিনীকে, গেরিলা বাহিনীকে, কর্মীবাহিনীকে। আমি সালাম জানাই-সংগ্রামী শ্রেণীকে, কৃষককুলকে, বুদ্ধিজীবীদের। বাংলাদেশকে একটি সুখী ও সমৃদ্ধিশালী দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। একটি লোককেও আর না খেয়ে মরতে দেওয়া হবে না। সকল রকমের ঘুষ লেনদেন বন্ধ করতে হবে।
আমি ফিরে আসার আগে ভুট্টো সাহেব অনুরোধ করেছেন দুই অংশের মধ্যে বাঁধন সামান্য হলেও রাখা যায় কিনা। আমি তখন বলেছিলাম, আমি আমার মানুষের কাছে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত কিছু বলতে পারছি না। আজ আমি আর বলতে পারব না। বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এখন যদি কেউ বাংলাদেশের স্বাধীনতা হরণ করতে চায়, তাহলে সে স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্যে মুজিব সর্বপ্রথম তাঁর প্রাণ দেবে। বাঙালি আর স্বাধীনতা হারাতে পারে না। আমি আপনাদের মঙ্গল কামনা করি। আমরা স্বাধীন, এটা মেনে নিন। আপনারা স্বাধীনভাবে থাকুন।
গত ২৫শে মার্চ থেকে এ পর্যন্ত দীর্ঘ ৯ মাসে বর্বর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এ দেশের প্রায় সব বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছে। তারা আমার মানুষকে হত্যা করেছে। হাজার হাজার মা-বোনের সম্ভ্রম নষ্ট করেছে। বিশ্ব এসব ঘটনার সামান্য কিছুমাত্র জানে। বিশ্বকে মানব ইতিহাসের জঘন্যতম কুকীর্তির তদন্ত অবশ্যই করতে হবে। একটি নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বর্বর পাকবাহিনীর কার্যকলাপের সুষ্ঠু তদন্ত করার জন্যে আবেদন জানাচ্ছি। আমি বিশ্বের সকল মুক্ত দেশকে অনুরোধ জানাই, আপনারা অবিলম্বে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেন। জাতিসংঘেরও উচিত অবিলম্বে বাংলাদেশকে আসন দিয়ে তার ন্যায়সঙ্গত দাবি পূরণ করা। জয় বাংলা! বাংলাদেশ-ভারত ভাই-ভাই!
ধ্বংসস্তূপে আলোর দিশারী
দীর্ঘদিন কারাবাসের পর মুক্তিলাভ করেও তিনি একটুও ভেঙে পড়েন নি! আবেগাপ্লুত হলেও প্রজ্ঞাচক্ষু বক্তৃতায় স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ও ভবিষ্যত সম্পর্কে দিকনির্দেশনামূলক বক্তৃতা প্রদান করেন। মানবতাবিরোধী কুকর্মে দায়ী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য জনতার নিকট প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে বলেন, একটি নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বর্বর পাকবাহিনীর কার্যকলাপের সুষ্ঠু তদন্ত করার জন্যে আবেদন জানাচ্ছি।” বিশ্বের নবীনতম দরিদ্র রাষ্ট্র বাংলাদেশ তখন ধ্বংসস্তূপ।
বিশ্বব্যাংকের একটি বিশেষজ্ঞ দল কয়েকটি শহর পরিদর্শন করে টাইম সাময়িকীতে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, শহরগুলি দেখতে পারমাণবিক হামলার পরের সকালের মতোই। প্রায় ৬০ লাখ বাড়ী-ঘর সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়েছে। ১৪ লাখ কৃষক পরিবার চাষবাসের হালহাতিয়ার ও পশু সম্পদ হারিয়েছে। পরিবহন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেতু বিধ্বস্ত এবং আভ্যন্তরীণ জলপথ অবরুদ্ধ। একমাস আগে পাকিস্তানী বাহিনী আত্মসমর্পণের আগ পর্যন্ত দেশটির ধ্বংসযজ্ঞ শুধুই বেড়েছে। যুদ্ধের শেষ দিনগুলিতে পাকবাহিনী পোড়ামাটি নীতি অবলম্বন করেছিল। পশ্চিম পাকিস্তানী ব্যবসায়ীরা (যারা ছিল দেশের সকল ব্যবসার মালিক) তাদের সর্বশেষ কড়িটিও পশ্চিমে নিয়ে যায়। পিআইএ বন্দর নগরী চট্টগ্রামে তাদের অ্যাকাউন্টে ১১৭ রুপি রেখে যায়। সেনাবাহিনী ব্যাংক নোট ও ধাতব মুদ্রা ধ্বংস করে যায়। বিশেষজ্ঞগণ তাৎক্ষণিক এক জরীপে বলেছিলেন, দেশকে ১৯৬৯-৭০-এর অর্থনৈতিক অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে অন্তত ৩০০ কোটি ডলার প্রয়োজন। উপরন্তু ছিল প্রায় ১ কোটি শরণার্থী ও ৪ লক্ষ সম্ভ্রম হারানো নারীর জরুরী ভিত্তিতে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা।
শেখ মুজিবঃ একটি নাম এক অনন্য ইতিহাস
৭২-এর ১০ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে বাংলাদেশ বেতার থেকে ডঃ নীলিমা ইব্রাহিম লিখিত ও তাঁর কণ্ঠে প্রচারিত বিশেষ কথিকাটিতে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বাংলার মানুষের প্রাণের আবেগ যথাযথভাবে অভিব্যক্ত হয়েছিল। দীর্ঘ চব্বিশ বছরের অবরুদ্ধ কণ্ঠকে মুক্তি দিয়ে আজ চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে জয়তু মুজিব জয়তু মুজিব। মুজিব, তোমারি হউক জয়। আজ সাত কোটি বাঙালির কণ্ঠে যে মাতৃমন্ত্র ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সেই জয় বাংলা মন্ত্রে তুমিই দীক্ষা দিয়েছিলে তোমার দেশবাসীকে, আকুল মন আজ সমস্ত বিশ্ববাসীকে ডেকে ওগো নূতন পৃথিবীর মানুষেরা শোন, বাংলার মাটিতে আজ সার্থকতা লাভ করেছে কবিকণ্ঠ উচ্চারিত সত্যবাণী, মানবের তরে মাটির পৃথিবী, দানবের তরে নয়। মানুষ আজ জয়ী, অসত্য আজ পরাজিত, পশু আজ ধুলি লুণ্ঠিত।
ইতিহাসের আলোয় বঙ্গবন্ধুর মহত্তর সৃষ্টিঃ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ
১১৯৯ খ্রীস্টাব্দে বখতিয়ার খিলজী কর্তৃক বাংলা দখলিত হওয়ার ৭৭২ বছর পর ১৯৭১-এ খণ্ডিত অস্তিত্ব নিয়ে হলেও পুনরায় স্বমহিমায় আরও বৃহত্তর ও মহত্তর ক্যানভাসে বাঙালি নিজ সত্তাকে আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বে অভিষিক্ত করতে সক্ষম হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে। কিন্তু মাঝখানে ৭৭২টি বছর বর্বর-আধাবর্বর-নিকৃষ্ট-ইতর সাম্প্রদায়িক পাশবিক শক্তির শাসনের নিগড়ে আবদ্ধ থেকে বাঙালি সমাজের মানবিকতার হানি হয়েছে সত্য। তবু বিস্ময় মানি এই ভেবে যে, মধ্যযুগের বর্বর সেনাধ্যক্ষ বখতিয়ারের আধুনিক উত্তরসূরী ইয়াহিয়াকে পরাজিত করবার মধ্যদিয়ে এক মহত্তর বিজয় সম্পন্ন হয়েছে। এ-এক মরীয়া লড়াই। বাঙালী সত্যিই তপোবীর! এ-কৃতিত্ব ব্যক্তি হিসেবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের; দল হিসেবে আওয়ামী লীগের; জাতি হিসেবে আপামর বাঙালির। ৭১-এর জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনের যুদ্ধে ধর্মের নামে প্রতিক্রিয়ার শক্তি ত্রিশ লক্ষ মানুষ হত্যা করে, লুণ্ঠন করে ৪ লক্ষ নারীর সম্ভ্রম এবং ধ্বংস করে দেওয়া হয় গোটা একটা দেশকে। বাংলার মানুষ যখন ৬৯-এ ভোটাধিকার দাবী করে তখন তাদের উপর চলে গুলী; ৫২-এ ভাষার অধিকারে চলে গুলী; ৪৬-এ অভিশপ্ত সামপ্রদায়িক দাঙ্গায় ৬ লক্ষ মানুষ হয় খুন ও ৬০ হাজার ধর্ষিতা। ৪৩-এর মন্বন্তরে প্রায় কোটি মানুষ অনাহারে পরমেশ্বরের কাছে চলে যায়। ১৯০ বছরের বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রামে লক্ষ মানুষের আত্মত্যাগ; শাসকের নির্দয় আচরণ; স্বপরিবারে শিশুপুত্রসহ জগৎশেঠকে হত্যা। মুঘল আমলের পুরোটা সময় জুড়ে নির্মমভাবে কৃষক আন্দোলন দমন, ধৃত কৃষকদের হত্যা, ধর থেকে মণ্ডু আলাদা করে রাজপথের দুই পার্শ্বে চবুতরার মতো মিনার স্থাপন করে সেখানে ছিন্ন মুণ্ডু স্থাপন; বিধর্মীদের তথা কাফেরদের জিজিয়া কর দিতে বাধ্য করে স্বদেশে তাদের পরবাসী বানানো, না দিলে মুখে কফ-থুতু নিক্ষেপ; যখন তখন গর্দান চলে যাওয়া; প্রতিক্রিয়ার শক্তির হাতে সুপ্রাচীনকাল থেকে গড়ে ওঠা বিদ্যাপীঠ টোলগুলো ধ্বংস হওয়া; নালন্দা, বিক্রমশীলা, ময়নামতি বিশ্ববিদ্যালয় ও এর সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারগুলো ধ্বংস করা; সেইসাথে শিক্ষক-পণ্ডিতদের মুণ্ডুচ্ছেদ! এযেন ধ্বংসের আর রক্তের হোলি খেলা। উপরোল্লিখিত বিষয়গুলো আমাদের জনগোষ্ঠীর একটি অংশের মানস গঠনে সাম্প্রদায়িকতায় আচ্ছন্ন হীনম্মন্যতা ও নীচতাপূর্ণ যে পাশবিক দিক- প্রতিক্রিয়ার যে সত্তা, সেটিকে প্রকাশ করে। যখন আমরা ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করি, আমরা দেখি এক পশু শক্তির তাণ্ডব উল্লাস। ধ্বংস, খুন ও তাণ্ডবের এই বীভৎস ও নারকীয় উল্লাস আমরা ইতিহাসে প্রত্যক্ষ করেছি ৭৭০ বছর ধরে। বিশাল ত্যাগের বিনিময়ে বাঙালির পাঁচ হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ মহত্তর অর্জন মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং এই ইতিহাসের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে, বর্বরোচিত কায়দায় সমাধিস্থ করে তার বিচারের পথ আইন করে নিষিদ্ধ করা হয় যখন; তখন আমরা আবার একই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করি। ইতিহাসের তামস শক্তি যেন পুনরায় চেপে বসে জাতির স্কন্ধে।
উপসংহার
সভ্যতা বিকশিত হয় সৃষ্টি আর ধ্বংস, উদ্ভব ও বিলয়, জন্ম ও মৃত্যু, প্রগতি ও প্রতিক্রিয়ার পরম্পরায়। প্রগতির ধারায় সমগ্র জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মূল মন্ত্রে দীক্ষা লাভে রাষ্ট্র গঠনের মূল বৈধ দলিল সংবিধানের ভিত্তিতে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় সর্বব্যাপী গণযুদ্ধের মধ্যদিয়ে যে বাংলাদেশের উদ্ভব; সে দেশে রাষ্ট্রীয় ও সমাজ জীবনে নিরন্তর সাংবিধানিক চর্চা আজ সময়ের দাবী। বাঙালীর সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারিত ছিল যেথায়- সেই ৭২-এর সংবিধানের মূল চেতনা রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবন থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। দীর্ঘ ২৬ বছরের স্বৈরশাসনের মধ্যদিয়ে রাজনীতির বহুমূল্যবান নৈতিক বহুদিক খোয়া গেছে। কিন্তু দীর্ঘ পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাস সমৃদ্ধ একটি জাতির জীবনে সভ্যতার অন্তস্রোতে প্রবহমান থাকে তার ঐতিহাসিক অর্জনসমূহ। কয়েক যুগে বা কয়েকটি শতাব্দীতেও সেই অর্জনসমূহ গুঁড়িয়ে দেওয়া সম্ভরপর নয়। এর প্রমাণ আমরা পাই জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকারের উদ্যোগে সংবিধানে ফিরে পাওয়া চার মূলনীতি পুনঃসংস্থাপিত হওয়ায়। যদিও সংবিধানটি বর্তমানে প্রগতি এবং প্রতিক্রিয়ার দুই মতাদর্শকেই ধারণ করছে। এর মধ্যে কোনটি টিকবে সেটি নির্ভর করছে নবপ্রজন্মের মানুষের উপর। নয়ন মেলে দিব্যজ্ঞানে অনুধাবন করতে হবে চার মূলনীতি সম্পর্কে। চার মূলনীতি বিরোধীদের শক্তিশালী অবস্থান রযেছে সমাজে। আর এতো শুধুমাত্র চারটি সংখ্যা পরিমাণের বিষয় নয়। চার মূলনীতির সাথে সম্পর্কিত রয়েছে আমাদের পূর্ব পুরুষদের সুমহান ত্যাগ-নিষ্ঠা-সাধনা-শ্রম-রক্ত-ঘাম। ফলে প্রতীজ্ঞা হোক, আগামী দিনের সংবিধান হবে চার মূলনীতির ভিত্তিতে প্রণীত ৭২-এর মূল সংবিধান।
সংবিধানের চার মূলনীতির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ৭২-এর ৪ঠা নভেম্বর, বাংলাদেশ গণপরিষদে প্রদত্ত বক্তৃতায় জাতির জনক ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উদ্দেশে বলেছিলেন, ভবিষ্যৎ বংশধর, ভবিষ্যৎ জনসাধারণ কিভাবে শাসনতন্ত্র সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করবে তারই উপর নির্ভর করে শাসতন্ত্রের সাফল্য, তার কার্যকারীতা। …ভবিষ্যৎ বংশধরেরা যদি সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে শোষণহীন সমাজ গঠন করতে পারে, তাহলে আমার জীবন সার্থক, শহীদের রক্তদান সার্থক।… ৭৭০ বছরের ঔপনিবেশিক ঘোর অন্ধকার যুগের ইতিহাসকে যিনি বদলে দিয়েছিলেন ২৪ বছরের সংগ্রামী জীবনের কঠোর তপস্যা দিয়ে; যিনি বাঙালীর পাঁচ হাজার বছরের মহত্তর জীবনাদর্শ নিজ জীবনে প্রকটিত করেছিলেন বিনয়ভূষণ তপোবীরের মতই; অসীম ধৈর্য আর অপরিসীম সহিষ্ণুতা নিয়ে জীবনের দশটি বছর যিনি কারান্তরালের নির্জন প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন; ফাঁসির মঞ্চকে উপেক্ষা করে যিনি দুর্জয়-সঙ্কল্প বোধ দ্বারা চালিত হয়ে জীবন মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্যে পরিণত করেছেন; কোনরূপ অন্যায়ের কাছে যিনি নতি স্বীকার করেন নি- বাঙালীর ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ভাবী বংশধরদের উদ্দেশে কর্তব্য-করণীয় যেভাবে নির্দেশ করেছেন, সেটি প্রতিপালনে সচেষ্ট হলে বাঙালীর গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের পুণ্যার্জনে ভবিষ্যৎ পুণ্যময় হয়ে আগামী জীবন শোভিত হবে সুনিশ্চিত। কেননা ইতিহাসের সাথে সম্পর্ক রক্ষার তিনিই একমাত্র যোগসূত্র। আর সকল কিছুই আমাদের জাতীয় জীবন থেকে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে প্রায় নিঃশেষিত। ফলে, তাঁর পরমারাধ্য নির্দেশকে ধ্যান-জ্ঞান করেই পথ তৈরী করে এগিয়ে যেতে হবে। এ ব্যাপারে অন্ধ হয়ে থাকলে চলবে না মোটেই। কেননা, অন্ধ হলে কী প্রলয় বন্ধ থাকে? সুতরাং, ১০ই জানুয়ারি জাতির জনকের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে আমাদের প্রতীজ্ঞা হোক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং অনুকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ৭২-এর সংবিধানে প্রত্যাবর্তন।