মুহম্মদ নূরুল হুদা
ইতিহাসপূর্ব কাল থেকে গঙ্গা-পদ্মার এই পলিবাহিত অববাহিকায় মনোদৈহিক মিশ্র বিবর্তনের পথ ধরে ঋদ্ধিমান যে জাতিসত্তা, বিশ শতকে এসে আমরা তার প্রামাণ্য নাম দিয়েছি বাঙালি। এই জাতিসত্তাকে কাম্য প্রক্রিয়ায় ভাষিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অনুবর্তনের চূড়ান্ত মুহূর্তে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রিক কাঠামোতে উন্নীত করার জন্য বাঙালিকে করতে হয়েছে দৃষ্টান্তরহিত ত্যাগ স্বীকার আর অভূতপূর্ব রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ। এই বিবর্তন-অনুবর্তন, সংগ্রাম-আন্দোলন ও সম্মুখ সমরের প্রতিটি যৌক্তিক বাঁকে যিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ফলে এই জাতিগঠনের চূড়ান্ত পর্বে তিনিই কারুকৃৎ, তিনিই সঞ্চালক। অতীত ও সমকালের সবকিছু তার অনুঘটক ও নিয়ামক।
তিনি নিজেকে ঘোষণা করেছেন আপাদমস্তক অবিসংবাদিত বাঙালি হিসেবে। তাই বাঙালি তাকে স্বতঃস্ফূর্ত অভিধায় গ্রহণ করেছে জাতির জনকরূপে। বাংলা, বাংলাদেশ ও বাঙালিত্বে যার সংশয় নেই, বঙ্গবন্ধুর সামষ্টিক সুকৃতি সম্পর্কেও তিনি নিঃসংশয়। কিন্তু প্রতিটি প্রস্তাবনার বিরুদ্ধে একটি প্রতি-প্রস্তাবনা থাকে।
এটিই মানবিক অগ্রগমনের দ্বান্দ্বিক দর্শন। এ দর্শনের বাস্তবায়ন-শর্ত প্রধানত গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতা ও সদাচারবাহিত সহমর্মিতা। যে সমাজে এটি অনুপস্থিত, সেই সমাজ শক্তিমদমত্ত ও অন্ধ। তারা ভিন্ন মতাবলম্বীকে শারীরিকভাবে হত্যা করে উৎখাত করার মতো অসার ও যুক্তিহীন অজাচারে লিপ্ত হয়। এরই এক বিকটতম অভিব্যক্তি বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ। আধুনিক পর্বে বাঙালি জাতিসত্তার রূপকার শেখ মুজিব এই যুক্তবিবর্জিত অমানবিকতার শিকার হয়েই সপরিবারে শহীদ হয়েছিলেন ভিন্ন মতাবলম্বী অস্ত্রধারীদের হাতে।
দেরিতে হলেও তার বিচারিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে এবং বাঙালি পিতৃহন্তার বিরুদ্ধে প্রতিকার পেয়েছে। তাই আগস্ট শোকের মাস হয়েও বাঙালিত্ব ও মানবিকত্বের বিজয়ের মাস। পথভ্রষ্ট, নীতিভ্রষ্ট ও পেশাভ্রষ্ট অস্ত্রধারীদের হাতে শারীরিকভাবে নিহত হয়েও আজ তিনি চিরবিজয়ী বাঙালি ও চিরায়ত মানবসত্তার অগ্রযোদ্ধা। বাংলাদেশ এখন মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে লালিত, শাসিত ও অগ্রসরমান। বিজয়ী বাঙালি আজ বঙ্গবন্ধুর আদর্শে চিরজাগ্রত বাঙালি। মানবিক সহমর্মিতাই হোক তার চালিকাশক্তি। এক মুজিবের রক্তকণিকা জন্ম দিচ্ছে কোটি কোটি মুজিব। চক্রাকারে বেড়ে যাচ্ছে বাঙালির ভূমিপুত্র ও ভূমিকন্যাদের এই সম্মিলিত গণশক্তি।
যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন থাকবে বাঙালির এই মুক্তিযুদ্ধ ও যুক্তিযুদ্ধ। সেই যুদ্ধের চিরায়ত অগ্রযোদ্ধা ও সেনাপতির নাম শেখ মুজিব। তিনি এক স্বাধীন জাতির স্বাধীন পিতা। তিনিই আমাদের আদর্শিক ত্রাতা। সেই যুদ্ধে নেই কোনো পরাজয়। বাংলা, বাঙালি ও বাংলাদেশ আজ মুজিবময়। জয় হোক, বাংলা ও বাঙালির জয়।