হোসাইন আনোয়ার
ঊনিশশো একাত্তুরের ৭ মার্চ ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্সে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান যে ভাষণ দেন সে ভাষণটি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ভাষণগুলোর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য ভাষণ হিসেবে বিবেচিত। ওই দিন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১০ লক্ষ জনতার উপস্থিতিতে মাত্র সাড়ে ১৮ মিনিটের যে অলিখিত ভাষণ প্রদান করেন, তাতে পাকিস্তানি শাসকদের ২৪ বছরের সীমাহীন শোষণ ও নির্যাতনের একটি কাব্যিক অথচ বাস্তব এবং দৃঢ় একটি চিত্র তিনি তুলে ধরেন।
এটি ছিল রাজনৈতিক ও সামরিক দর্শনে পরিপূর্ণ একটি স্বাধীনতার রূপরেখা। ৭ মার্চের ভাষণের পর লন্ডনের টাইমস এবং নিউইয়র্কের নিউজ উইক ম্যাগাজিনে তাঁকে প্রথম ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’; ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে উল্লেখ করে।
তাঁর এই ভাষণটি অধিকারবঞ্চিত বাঙালির শত সহস্র বছরের সংগুপ্ত আশা আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নের উচ্চারণে সমৃদ্ধ। ওই ভাষণে প্রচণ্ড রকম আন্তর্জাতিক চাপ মাথায় নিয়ে এতো কথা অমন অমোঘ তীক্ষ্ণতা, সাবলীল ভঙ্গি, বাহুল্যবর্জিত কিন্তু গভীরভাবে অন্তর ছুঁয়ে যাওয়া ভাষায় কেমন করে বলতে পারলেন সেটি একটি বিশাল গবেষণার বিষয় হতে পারে।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের গুরুত্ব ও অসাধারণত্ব বহুমাত্রিক। ৭ মার্চের ভাষণটির গুরুত্ব সর্বভৌগোলিক গণ্ডির সীমানা অতিক্রম করে এখন সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের জন্য এক অনন্য দর্শনে পরিণত হয়েছে।
ফলে এটি এখনো চিরঞ্জীব ও চিরভাস্বর। কেউ কেউ এই ভাষণটিকে আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ এ্যাড্রেস (১৮৬৩) বা মার্টিন লুথার কিং (জুনিয়র) ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’ (১৯৬৩) ভাষণের সঙ্গে তুলনা করেন। এই তুলনাকেও যথাযথ মনে হয় না। ওই দুটি ভাষণের প্রেক্ষাপটও ছিল ভিন্ন।
বঙ্গবন্ধুর মতো বিপুল মানুষের আকাশছোঁয়া প্রত্যাশার চাপ এবং শক্তিশালী প্রতিপক্ষের মারণাস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার সম্ভাবনার মধ্যে তাদের ওই ভাষণ দিতে হয়নি। তবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে উইনস্টন চার্চিলের একটি ভাষণের সঙ্গেই শুধু বঙ্গবন্ধুর ভাষণের কিছুটা তুলনা করা যেতে পারে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নেভিল চ্যাম্বারলিন। যুদ্ধের শুরু থেকেই জার্মানির নেতৃত্বে অক্ষশক্তির বিজয়ধারা অব্যাহত থাকে। অভ্যন্তরীণ চাপের মুখে চ্যাম্বারলিন পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং ২০ মে ১৯৪০ সালে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন উইনস্টন চার্চিল। ওই বছর শেষের দিকে ‘ব্যাটল অব ব্রিটেন’ এ ব্রিটেন এর জয়লাভই হিটলারকে বাধ্য করে ব্রিটেনের মূল ভূখণ্ডের উপর আক্রমণ পরিকল্পনা স্থগিত রাখতে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রায় পুরোটা সময় জুড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন রুজভেল্ট। রুজভেল্টের অসাধারণ প্রজ্ঞা এবং দূরদৃষ্টি যুদ্ধে মিত্রশক্তির চূড়ান্ত বিজয়ের ক্ষেত্রে অভাবনীয় ভূমিকা রেখেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে তিনিই একমাত্র প্রেসিডেন্ট যিনি পর পর চারবার প্রেসিডেন্ট নির্র্বাচিত হয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী চার্চিল এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট জোসেফ স্টালিন, এই তিন নেতা রুদ্ধদ্বার বৈঠকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের টার্নিং পয়েন্ট খ্যাত ফ্রান্সের উপকূলে নরম্যান্ডি নামক স্থানে সামরিক ইতিহাসে উদাহরণ সৃষ্টিকারী নরম্যান্ডি ল্যান্ডিং নামক অপারেশনটি পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এ পর্যন্ত পৃথিবীর যুদ্ধের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় উভচর মিলিটারি অপারেশন ছিল নরম্যান্ডি ল্যান্ডিং। ১৯৪৪ সালের ৬ জুন নরম্যান্ডিতে মিত্রশক্তির আক্রমণ শুরু হয় এবং মাত্র এক বছরের কম সময়ের ভেতর ১৯৪৫ সালের ৭ মে হিটলারের আত্মহত্যা এবং জার্মানির নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মধ্যদিয়ে ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে। একটি দেশ যখন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তখন সে দেশের সর্বস্তরের জনগণ সেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। আর তার রণকৌশল ঠিক করেন সে দেশের নেতা। যুদ্ধের জয়পরাজয় নির্ভর করে সেই দেশের নেতা বা রাষ্ট্রপ্রধান কতখানি প্রজ্ঞাজনিত এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন তার ওপর। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে মাত্র ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে।
এই রাষ্ট্রের স্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম তাঁর চিন্তা চেতনা, আদর্শ ও দর্শন এবং দিক নির্দেশনা এবং দীর্ঘ ২৪ বছরের পাকিস্তানি শোষণের বিরুদ্ধে তাঁর বজ্রকণ্ঠ জাতিকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করেছে।
বাঙালির স্বাধিকারের প্রশ্নে তিনি কখনোই আপোস করেননি। ১৯৫৫ সালের ২৫ আগস্ট পাকিস্তান গণপরিষদে দেয়া একটি ভাষণ থেকে আমরা তার প্রমাণ পাই। সেদিন গণপরিষদের স্পিকারকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন।- ংরৎ, ুড়ঁ রিষষ ংবব ঃযধঃ, ঃযবু ধিহঃ ঃড় ঢ়ষধপব ঃযব ড়িৎফ ‘ঊধংঃ চধশরংঃধহ’ রহংঃবধফ ড়ভ ‘ঊধংঃ ইবহমধষ’, ঃযব ড়িৎফ ‘ইবহমধষ’ যধং ধ যরংঃড়ৎু, যধং ধ ঃৎধফরঃরড়হ ড়ভ রঃং ড়হি, তবে এতে তিনি শুধু ঐতিহ্য বা আবেগের প্রকাশ ঘটাননি, তার মধ্যে ছিল যুক্তি ও গণতন্ত্রের কথা। তাই পরের লাইনেই তিনি বলেছেন, ণড়ঁ পধহ পযধহমব রঃ ড়হষু ধভঃবরৎ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব যধাব নববহ ঈড়হংঁষঃবফ. (ঝঢ়ববপযবং ড়ভ ঝযবরশয গঁলরন রহ চধশরংঃধহ চধৎষরধসবহঃ পড়সঢ়রষবফ নু তরধঁৎ জধযসধহ (তরধঁৎ জধযসধহ ঝযধযৎরধৎ ওয়ঁনধষ ঠড়ষ . ১. চ-১২-১৭. সধৎপয ১৯৯০)
১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের ভূরাজনৈতিক নিরাপত্তা নিয়ে বঙ্গবন্ধু খুবই উদ্বিগ্ন ছিলেন। এর পর বাঙালির মুক্তিসনদ ঐতিহাসিক ৬ দফা ঘোষণা বঙ্গবন্ধুর সমর দর্শন ও প্রতিরক্ষার প্রস্তুতির প্রতিফলন ঘটে ৬ দফাতে। ৬ দফার দ্বিতীয় দফায় তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, ফেডারেল সরকারের এখতিয়ারে কেবল মাত্র দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থাকবে। ৬ দফার ৩ নং দফায় তিনি বলেছেন, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুটি সম্পূর্ণ পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা থাকতে হবে। দু অঞ্চলের জন্য দুটি স্বতন্ত্র স্টেট ব্যাংকের কথাও বলেছেন তিনি ৬ দফায়। এর পরও কি আমরা বলবো তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি।
৭ মার্চের ভাষণে আমরা বঙ্গবন্ধুর সমরকৌশলের বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাই। দেখতে পাই সামরিক দিক নির্দেশনা। ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে তোমরা বন্ধ করে দিও। আমরা ভাতে মারব আমরা পানিতে মারব’ এখানে তিনি চীনের মাও সে তুং এর সফল গেরিলা যুদ্ধের রণকৌশলের কথাই বলেছেন। এ নির্দেশের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু স্পষ্টতই বাঙালি জাতিকে একটি যুদ্ধে শামিল হতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় সামরিক কৌশলের যে নির্দেশনা বঙ্গবন্ধু মার্চের ভাষণের মধ্যদিয়ে জাতিকে দিয়েছেন, তা একজন দক্ষ সেনাপতিকেও হার মানায়। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়ক নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু ভারতবাসীর উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব।’ নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু সফল হননি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সফল হয়েছিলেন। তিনি তাঁর ৭ মার্চের ভাষণে বলেছিলেন ‘রক্ত যখন দিয়েছি। রক্ত আরও দেব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ্।’ তাঁর এই উক্তিকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন মুজিবনগর সরকারের জাতীয় চার নেতা শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, কামারুজ্জামান ও মনসুর আলী। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত চার সিপাহসালার।
ইয়াহিয়া খানের কূটচালের সমুচিত জবাব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু তার ৭ মার্চের ভাষণে। তিনি বলেছেন, ‘রক্তের দাগ এখনো শুকায় নাই। ওই শহীদের রক্তের উপর পা দিয়ে আরসিটিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না।’ তিনি বলেছিলেন, ‘এ্যাসেম্বলি যখন কল করেছেন, আমার দাবি মানতে হবে, প্রথম, সামরিক আইন মার্শাল ল উইথ ড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোককে ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে। যে ভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর আমরা বিবেচনা করে দেখবো আমরা এ্যাসেম্বলিতে বসতে পারবো কি পারব না।’
এই চারটি শর্তকেও বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিচক্ষণ রণকৌশল হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। এই চারটি শর্তে স্বাধীনতার ঘোষণা শোনার জন্য পাগলপার উত্তাল জনসমুদ্র একটু থমকে গেছে তবে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেনি।
তারা ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করেছে যে, বঙ্গবন্ধু অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্যই একটি কৌশলগত ধাঁপ অতিক্রম করলেন মাত্র। দৃশ্যত নেতা, গণতন্ত্র এবং নিয়মতান্ত্রিক পথেই রয়েছেন বলে পাকিস্তানিদের বোঝানো গেল। এই শর্ত দেয়া না হলে, তাঁর এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। এই বাক্যটিকে একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা গণ্য করা হতো। তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে অভিযুক্ত হতেন। ফলে আন্তর্জাতিক আইন ও বিশ্বজনমত দুটোই তাঁর বিপক্ষে চলে যেত।
তাই রাষ্ট্রনায়কোচিত করে রাখলেন তার ঘোষণা। ৭ মার্চের ভাষণের সময় ১৯৬৫ সালের বায়াফ্রাব টহরষধঃবৎধষ উবপষধৎধঃরড়হ ড়ভ ওহফবঢ়বহফবহপব টউও এর কথা তার স্মরণে ছিল। তাই সমরকৌশলবিদের মতো স্বাধীনতার ঘোষণাকে শর্তসাপেক্ষ করে বৈধতার পথে নিয়ে গেলেন।
আমার পরম সৌভাগ্য হয়েছিল, জাতির সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তে লক্ষ জনতার সাথে আমিও দ্রবীভূত হয়ে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই অমর কবিতাখানি শুনেছিলাম। কি মর্মস্পর্শী সেই কবিতার বাণী – এ বারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। সেই থেকেই ৭ মার্চের ভাষণ আজো জাতির প্রেরণার উৎস।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট