বেলাল আহমদ চৌধুরী
সূর্যসেন বলেছেন, আগামীদিনের বংশধর জানুক যে, তাদের পূর্ব পুরুষগণ মোটেই কাপুরুষ ছিলেন না। স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য বাংলায় কখনো প্রাণের অভাব হয়নি। একটি জাতির স্বাধীনতা আনতে হলে বহু প্রাণের প্রয়োজন হয়। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আ¤্রকাননে বাংলার শেষ নবাব সিরাজুদ্দৌলা তার সভাসদ মীর জাফরদের মোনাফিকির কারণে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর রবার্ট ক্লাইভের কাছে পরাজিত হন।
১৭৬৫ সনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মোগল স¤্রাট শাহ আলমের নিকট থেকে বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকা প্রদানের বিনিময়ে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানী অর্থাৎ ভূমি রাজস্ব আদায়ের অধিকার লাভ করে। ভারতের ঐতিহাসিকরা ১৭৬৫ থেকেই এ দেশের আধুনিক কাল গণনা করেন। তন্মধ্যে ১৭৬৫ থেকে সিপাহী যুদ্ধের শেষ ১৮৫৮ পর্যন্ত কালকে বলা হয় কোম্পানি আমল। ১৮৫৮-র ১লা নভেম্বর মহারানী ভিক্টোরিয়া ভারত শাসন গ্রহণ করেন এবং ১৮৭৭ সালে তিনি ভারত স¤্রাজ্ঞী বলে ঘোষিত হন। ১৯৪৭ পর্যন্ত ভারত শাসন ব্রিটিশদের অধীনেই ছিল। ১৮৫৮ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত কাল ব্রিটিশ রাজ্যের শাসন কাল (India under the crown) বা ব্রিটিশ রাজ্যের কাল নামে অভিহিত।
১৭৯৩ এর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরেই অবশ্য আর একটা নতুন সামাজিক ব্যবস্থার উন্মোচন ঘটে। ১৮০০ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত কালকেই বাঙলায় ঔপনিবেশিসক মধ্যবিত্তের যুগ বলা হয়ে থাকে। ১৮১৭ থেকে ১৯১৮ প্রথম যুদ্ধের অবসান কাল পর্যন্ত ছিল তাদের প্রতিপত্তির যুগ। এই কালই বাঙলার “জাগরণের” যুগ, যাকে বলা হয় বাঙলার ‘রেনাইমেন্স’। তন্মধ্যে ১৮০০ থেকে ১৮৫৭-৫৮ পর্যন্ত কাল প্রস্তুতি পর্ব, ১৮৫৮ থেকে ১৮৯৩ পর্যন্ত কাল প্রকাশের পর্ব। তখন বাঙলায় জোয়ার। ১৮৯৩ থেকে ১৯০৫ পর্যন্ত স্বদেশী যুগের সময় বলে বিবেচিত হয়। তন্মধ্যে আরও ভাগ দেখতে পাওয়া যায যেমন ১৯০৫ থেকে ১৯১৮ স্বদেশীয় যুগ, ১৯১৮ থেকে ১৯৪২ বিশ্ব সংকটের যুগ, এরপর কালান্তর। ১৯১৮-র সময়েই কালান্তরের বীজ উপ্ত হয় এবং তা ১৯৪১-৪২ সময়ে অঙ্কুরিত হয়।
১৮৫৭-১৯৪৭ ব্রিটিশ শাসন ছিল খুবই ঘটনাবহুল। সমাজ রাজনীতি, অর্থনীতি শিক্ষা, বিচার ব্যবস্থা তথা জীবনের সর্বস্তরে এর বিরাট প্রভাব ছিল। ১৭৯৩ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত-এ ভূমি ব্যবস্থায় সাম্প্রদায়িক বিভাজন উসকে দেয়। যা ব্রিটিশ শাসনের উল্লেখ্যযোগ্য বৈশিষ্ট হয়ে দাঁড়ায়।
১৮৮৫ সালে সর্বভারতীয় কংগ্রেস এবং ১৯০৬ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হলো। কংগ্রেস বা হিন্দু নেতৃত্বে মুসলমানের স্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থতায় হতাশার সৃষ্টি করে। ভারতের মুসলমানের মধ্যে মোট জনসংখ্যার ২৪ শতাংশ ছিল মুসলমান। অবিভক্ত ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের স্থায়ী শাসন নিয়ন্ত্রন আধিপত্যের নীতি মুসলমানদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধ ও সর্বভারতীয় মুসলিম ঐক্যের জন্ম দেয়। উভয় দলকে কেন্দ্র করে রাজনীতি পারস্পরিক বিরোধ ও বিচ্ছিন্নতার ধারায় প্রবাহিত হতে থাকে। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ ছিল এর পরিনতি। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ (১৮৭০-১৯২৫), শেরেবাংলা একে ফজলুল হক (১৮৭৩-১৯৬০) নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু (১৮৯৭-১৯৪৫) এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী (১৮৯২-১৯৬৩) প্রমুখ বরেণ্য নেতা হিন্দু মুসলিম ঐক্যের ধারাকে রাজনীতির অগ্রভাগে দাঁড় করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু তাদের সে উদ্যোগ সফল হয়ে উঠেনি।
১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের সাধারণ অধিবেশনে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা একে ফজলুল হক ভারতকে ভাগ করে এর উত্তর পূর্ব ও উত্তর পশ্চিম অংশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেন। যা সম্মেলনে সর্বসম্মতিতে গৃহীত হয়। এটিই ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব যা পাকিস্তান প্রস্তাব নামে জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই লাহোর প্রস্তাবই ছিল বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্রচিন্তার আনুষ্ঠানিক বহি:প্রকাশ।
ব্রিটিশ আমলে বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে দেশের মুক্তি সাধনের জন্য যে, সংগ্রাম তা কোম্পানীর শাসনামল থেকেই শুরু হয়েছিল। এ সম্পর্কে ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙলা’ গ্রন্থের রচয়িতা নরহরি কবিরাজ লিখেছেন-বাংলার জনগণের কাছে সে দিন কোম্পানীর শাসন বিদেশীর শোষন বলেই প্রতিভাত হয়েছিল। সিরাজুদ্দৌলা ছিলেন দেশের শেষ স্বাধীন নবাব। তিনি স্বদেশের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখার জন্য আপ্রাণ সংগ্রাম করেন। বিদেশী শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার পরে বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম সংগ্রাম ঘোষণা করেন ‘মীর কাশেম’ তার এই সংগ্রাম তদানিন্তন ঐতিহাসিক পর্বে জাতীয় মুক্তির সংগ্রামের অন্তর্ভুক্ত। প্রকৃত পক্ষে মীর কাশেমের সময় থেকেই বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সূত্রপাত। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলার মানুষ আন্দোলন গড়ে তুলেছে। তিতুমীরের বিদ্রোহ, সিপাহী বিদ্রোহ, কৃষক বিদ্রোহ, সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, ফকির বিদ্রোহ দৃষ্টান্ত হিসাবে উল্লেখ করা যায়।
১৯৪৭-এর স্বাধীনতা পূর্ববাংলার মানুষকে হিংসা-বিদ্বেষ আর বৈষম্যের যন্ত্রনায় জর্জরিত করে তুলে ফলে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম নতুন আঙ্গিক বা মাত্রা লাভ করে। ১৯৪৭-১৯৭১ ছিল বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্রগঠনের অধ্যায়। এই অধ্যয়ের মহানায়ক হয়ে আবির্ভুত হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনিতে লিখেছেন :
পাকিস্তান দুইটো হবে। লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে। একটা বাংলা ও আসাম নিয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। আর একটা ‘পশ্চিম পাকিস্তান’, স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান, সীমান্ত প্রদেশ, অন্যটা হবে ‘হিন্দুস্থান’।
মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ সাহেবের সভাপতিত্বে ১৯৪৬ সালে দিল্লী “মুসলিম লেজিসলেটরস কনভেশন” লাহোর প্রস্তাবের বহুমাত্রিক রাষ্ট্র ধারণার স্থলে একক পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা মর্মে প্রস্তাব গৃহীত হলে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলীম লীগের জেনারেল সেক্রেটারী আবুল হাশিম এর প্রতিবাদ করেছিলেন।
পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ (৫৬ শতাংশ) থাকা সত্বেও পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিমাতাসুলভ আচরণ চলতে থাকে। ১৯৪৮-১৯৫২ ভাষা আন্দোলন এর জ্বলন্ত প্রমাণ। ভাষা আন্দোলনই জাতিসত্ত্বাভিত্তিক বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তিভূমি রচনা করে।
পাকিস্তান শাসন আমলেই বঙ্গবন্ধু ছিলেন ভাষা আন্দোলনের প্রথম কারাবন্দি (১১ মার্চ ১৯৪৮) ১৯৫২ ভাষা আন্দোলনে দ্বিতীয় পর্বে কারাগারে বন্দী অবস্থায় রাজনৈতিক কর্মীদের আন্দোলনের বিস্তারিত নির্দেশনা দিয়ে বন্দি মহিউদ্দিন আহমদকে নিয়ে তিনি আমরণ অনশন পালন করেন। বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন, পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র কঠামো ও শাসন ব্যবস্থা না ভেঙ্গে বাঙালির সার্বিক মুক্তি অর্জন সম্ভব নয়। সেই লক্ষই ছিল তার সফল আন্দোলন। ১৮ই মার্চ ১৯৬৬ ঢাকার মতিঝিলে ইডেন হোটেল প্রাঙ্গনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামীলীগের তিন দিন ব্যাপী কাউন্সিল অধিবেশনে ঘোষণা করেন ঐতিহাসিক ৬ দফা। উক্ত ৬ দফাই ‘আমাদের বাঁচার দাবী’ যা “ম্যাগনাকার্টা” হিসাবে খ্যাত। ৬ দফার বিরুদ্ধে ১৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট আয়ুব খাঁন রাজশাহীতে প্রকাশ্যভাবে সমালোচনা করেন এবং বলেন, ইহা বৃহত্তর স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়নেরই একটি পরিকল্পনা এবং তৎকালীন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্রো ৬ দফার বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন। ৬ দফা ঘোষণার পর থেকেই বঙ্গবন্ধুর আপোষহীন যাত্রা শুরু হল। দেশের বিভিন্ন কারাগার হয় তার দ্বিতীয় আবাসস্থল। আইয়ুব খান সরকার তখন কারাগারে অন্তরীন করে শেখ মুজিবুর রহমান গং এর বিরুদ্ধে “আগরতলা মামলা” রুজু করেন। তখন বাঙালিরা গর্জে ওঠে। রচিত হয় ৬৯-এর অভ্যুত্থান। এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু তার সহযোগীগণ নিঃশর্ত মুক্তি লাভ করেন এবং তখনই শেখ মুজিবুর রহমান মুজিব ভাই থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত হন।
পাক সেনা শাসকের পালাবদলে জেনারেল ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট হয়ে ক্ষমতায় এসে সাধারণ নির্বাচনে যেতে বাধ্য হন। এই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ ৬ দফার ভিত্তিতে বাঙালির ম্যান্ডেট পেয়ে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করেন। ক্ষমতা হস্তান্তরে প্রেসিডেন্ট এহিয়া খান কূটকৌশলে শুরু করলে বঙ্গবন্ধুর ডাকে পূর্ব বাংলায় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। সামরিক শাসন পূর্ব বাংলায় ভেঙ্গে পড়ে। বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন জনতার সরকার প্রধান। ধানমন্ডির ৩২নং সড়কের বাড়ি পরিণত হয় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ১০নং ড্রাউনিং স্টিটের অনুরূপ। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পূর্ববাংলার প্রশাসন চলে। অসহযোগ চলাকালে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্দান)-এর জনসমুদ্রে জাতির উদ্দেশে মাত্র ১৯ মিনিটের স্বাধীনতার দিক নিদর্শনাপূর্ণ এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন।
২৫ মার্চ “অপারেশন সার্চলাইট” নাম দিয়ে পাকিস্তানী বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু পাক বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্বাধীনতার জন্য বাঙালির দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম আর রক্তের সাগর পাড়ি দিতে হয়েছে। বাংলাদেশ বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্রচিন্তার লালিত স্বপ্নের ফসল আর পৃথিবীর অমর মহামানুষের তালিকায় আর একটি উজ্জ্বল নাম সংযোজিত হল সেই নামটিই “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব”।