ইতিহাসের আলোকে বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরা


হারুন হাবীব

শুক্রবার, নভেম্বর ৪। হোয়াইট হাউসে শ্রীমতি গান্ধী মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সঙ্গে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে বসেন। নিক্সন-ইন্দিরার মধ্যে আলোচনা চলে দুই ঘণ্টা। প্রসঙ্গ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি। কিন্তু আলোচনা ব্যর্থ হয়। নিক্সন ও কিসিঞ্জার বুঝতে পারেন ইন্দিরা গান্ধীকে বাগে আনা যাবে না, বাংলাদেশ প্রশ্নে তিনি একচুলও ছাড় দেবেন না। কাজেই ভিন্ন পথে অগ্রসর হতে হবে।

কার্যত বাংলাদেশ প্রশ্নে মার্কিন নীতি-কৌশল অকার্যকর পরিণত করেন ইন্দিরা গান্ধী, যা না হলে ১৯৭১-এর ইতিহাস ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে পারত। ইন্দিরা গান্ধীর যুক্তি, দৃঢ়তা এবং বিস্ময়কর আন্তর্জাতিক জনসংযোগের ফলে বিশ্ব জনমত বহুলাংশে বাংলাদেশের পক্ষে আসে।

যুক্তরাষ্ট্র চীনকে প্ররোচনা দিলেও সে ভারত আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকে। এর প্রধান কারণ ভারতের মাটিতে আক্রমণ চালানো হলে ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তির ধারা মতে মস্কো ভারতের পক্ষ অবলম্বন করবে, যা মঙ্গল বয়ে আনবে না। তিন সপ্তাহের ইউরোপ-আমেরিকা সফর শেষে দেশে ফিরে আসেন শ্রীমতি গান্ধী।

বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম তখন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে এক শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়ে বলেন : ‘Never in history did anyone do so much for the cause of the oppressed people of another land as you have done for my people. They will not fail to make their own contribution to this making of history whereby alone they could discharge their debt of gratitude to you personally and to the people of India.’ বঙ্গবন্ধুর মুক্তির আন্দোলনে ইন্দিরা গান্ধীর ব্যক্তিগত ও সরকারি ভূমিকা ইতিহাসের অংশ।

বিশ্ব ফোরামে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির ব্যাপারে ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ করে গেছে ভারত। পাকিস্তানের মাটিতে বঙ্গবন্ধুকে যখন প্রহসনমূলক গোপন বিচারে হত্যা করার চক্রান্ত চলছিল, তখন ১১ আগস্ট, ২৪ জন শীর্ষ রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে ব্যক্তিগত আবেদন প্রেরণ করেন শ্রীমতি গান্ধী। একই সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণদ- দিয়ে পরিস্থিতি আরো জটিল করে না তোলার জন্য পাকিস্তানকে শক্ত ভাষায় সতর্ক করে সোভিয়েত ইউনিয়ন।

৪ ডিসেম্বর ১৯৭১। বাংলাদেশ-ভারতের যৌথবাহিনী সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু করে পাকিস্তানের ওপর। সেদিনই আমেরিকার দূতিয়ালিতে নিরাপত্তা পরিষদে জরুরি বৈঠক বসে। ‘অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি’ কার্যকর করার প্রস্তাব আনে যুক্তরাষ্ট্র। প্রস্তাবটি বেশির ভাগ সদস্য রাষ্ট্র সমর্থন করে।

কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে দুবার ‘ভেটো’ প্রদান করে তা অকার্যকর করে দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘ভেটো’ প্রদান পাকিস্তানের পরাজয় এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এর ফলে যৌথবাহিনীর হাতে অবরুদ্ধ পাকিস্তান বাহিনী দ্রুত পরাজয়বরণ করতে থাকে এবং তারা আত্মসমর্পণের পথে যাত্রা করে।

উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাই কেবল নয়, নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যপদ লাভের ১০ মাসের মাথায় চীন তার প্রথম ‘ভেটো’ প্রদান করে বাংলাদেশের সদস্য প্রাপ্তির বিরুদ্ধে, যদিও বিশ্ব সংস্থার ৮৫টি সদস্য-রাষ্ট্র তখন বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় ২৫ জানুয়ারি ১৯৭২, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৮ এপ্রিল ১৯৭২ এবং চীন ৩১ আগস্ট ১৯৭৫ সালে।

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। পাকিস্তান বাহিনী মুক্ত ঢাকায় লাখো মানুষের আকাশ ফাটানো জয় বাংলা ধ্বনির মধ্যে আত্মসমর্পণ করে। ২১ ডিসেম্বর ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস তাদের সরকারের কাছে দুটি সুপারিশ পাঠায়। একটি বাংলাদেশ সরকারকে মেনে নেয়া এবং অবিলম্বে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে পাকিস্তান সরকারকে চাপ প্রয়োগ করা।

১৬ ডিসেম্বর ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ এক সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করে, ‘বাংলাদেশে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী বিপর্যয়ে গোটা গণতান্ত্রিক বিশ্বে আমেরিকার সম্মান ও ভাবমূর্তি বিনষ্ট হয়েছে।’ মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের মন্ত্রিসভা কলকাতা থেকে ঢাকা ফিরে বুধবার, ডিসেম্বর ২২, ১৯৭১। শত্রুমুক্ত ঢাকায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও তার মন্ত্রিসভার সদস্যরা এসে পৌঁছলে হাজার হাজার মানুষ তাদের বীরোচিত সংবর্ধনা জানায়।

মুজিবনগর মন্ত্রিসভার ঢাকা আগমনের মধ্য দিয়ে ঢাকা স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী হিসেবে অধিষ্ঠিত হয়। এর আগে ঢাকা দুবার রাজধানী হওয়ার মর্যাদা লাভ করে। ১৬০৮ সালে বাংলার নবাব ইসলাম খাঁর আমলে। এরপর ১৯০৫ সালে বঙ্গ ভঙ্গের সময়। বাংলাদেশ স্বাধীন হয় কিন্তু স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখনো পাকিস্তানের কারাগারে। পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের চারদিন পর ২১ ডিসেম্বর জুলফিকার আলী ভুট্টো ঘোষণা দেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেয়া হবে। কিন্তু কবে, কখন এসব কিছুই জানানো হয় না।

২৫ মার্চ ১৯৭১-এর মধ্য রাত থেকে পরের বছরের ৮ জানুয়ারি। নয় মাসের বন্দিজীবন শেষে বঙ্গবন্ধু মুক্তিলাভ করেন ৮ জানুয়ারি ১৯৭২। সেদিনই তিনি পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের (পিআইএ) বিশেষ ফ্লাইট-৬৩৫-এ লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছেন। বিমানবন্দরে ব্রিটিশ ও কমনওয়েলথ কর্মকর্তারা তাকে অভ্যর্থনা জানান।

একইদিন লন্ডনের Claridges Hotel-এ এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে ভাষণ দেন নতুন রাষ্ট্রের জনক। সেই ভাষণে তিনি বাংলাদেশকে এক ‘অমোচনীয় বাস্তবতা’ বলে উল্লেখ করেন। বলেন, ‘The ultimate achievement of the struggle is the creation of the independent, sovereign republic which my people have declared me President while I was a prisoner in a condemned cell awaiting the execution of a sentence of hanging.’

তিনি আরো বলেন, ‘I would like to thank all those freedom-loving states who have supported our national liberation struggle, in particular India, the Soviet Union, Poland, other Eastern European countries, the United Kingdom, France and also those freedom-loving people around the world who supported our cause, including the people of the United States of America.’

৯ জানুয়ারি হিথরো থেকে ব্রিটিশ রয়াল এয়ার ফোর্সের বিশেষ বিমানে ঢাকার পথে যাত্রা করেন বঙ্গবন্ধু। লন্ডনে প্রায় ২৪ ঘণ্টা অবস্থানের সময় তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ঢাকার পথে ১০ জানুয়ারি তিনি দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে (ইন্দিরা গান্ধী ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট) যাত্রাবিরতি করেন।

ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ মন্ত্রিসভার সব সদস্য ও শীর্ষ কর্মকর্তারা বাংলাদেশের জাতির পিতাকে ঐতিহাসিক অভ্যর্থনা জানান। একুশ গান স্যালুটের মধ্য দিয়ে তাকে রাষ্ট্রীয় অভিবাদন জানানো হয়, ওড়ানো হয় বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় পতাকা।

বাজানো হয় দুই দেশের জাতীয় সঙ্গীত। বঙ্গবন্ধুকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে ভারতের রাষ্ট্রপতি মন্তব্য করেন, ‘The emergence of independent Bangladesh is itself a unique event in the annals of democratic movements in world history. You have truly been acclaimed the Father of the new nation, Bangladesh.’ উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ভারতের জনগণ, সরকার, বিশেষ করে ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।’ একইদিন নতুন দিল্লি থেকে ঢাকায় পৌঁছেন বঙ্গবন্ধু।

কারাগারে থেকেও যিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রাণপুরুষ, যিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রতি, সেই প্রাণপ্রিয় নেতাকে মুক্ত স্বদেশে স্বাগত জানায় লাখো উদ্বেলিত জনতা। রয়াল এয়ার ফোর্সের বিমানটি তেজগাঁও বিমানবন্দরে থামার পর সেটাকে ঘিরে রাখে লাখো মানুষ, যা দেখার সৌভাগ্য আমারও হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধু অনেকক্ষণ ধরে বিমানের জানালা দিয়ে তার প্রাণপ্রিয় ‘সোনার বাংলা’ দেখেন। এরপর মোটর শোভাযাত্রায় রমনা রেসকোর্সে পৌঁছেন। ইন্দিরা গান্ধী বিলক্ষণ অনুধাবন করেছিলেন যে, পাকিস্তান কেবল পরাজিতই নয় দেশটির ৯৩ হাজার সৈন্যও বাংলাদেশ-ভারতের কাছে বন্দি, কাজেই বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই পাকিস্তানের।

১৬ ডিসেম্বর লোকসভায় পাকিস্তানি আত্মসমর্পণের সুখবরটি জানাতে গিয়ে ভারত নেত্রী আশা প্রকাশ করেন এই বলে, ‘We hope and trust that the Father of this new nation, Sheikh Mujibur Rahman, will take his rightful place among his own people and lead Bangladesh to peace, progress and prosperity.’

রমনা রেসকোর্সে ১০ জানুয়ারির ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমাকে কারাগারে আটক রাখা হয়েছিল। কিন্তু আমি জানতাম বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। বাংলার মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বাস করবে, খেয়ে-পরে সুখে থাকবে, এটাই ছিল আমার সাধনা। বাংলার এক কোটি লোক প্রাণভয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের খাবার, বাসস্থান দিয়ে সাহায্য করেছে ভারত।

আমরা ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী, ভারত সরকার ও ভারতবাসীকে আমাদের অন্তরের অন্তস্থল থেকে জানাই কৃতজ্ঞতা। বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধে সমর্থনদান ও সহযোগিতাদানের জন্য ব্রিটিশ, জার্মান, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন জনগণকেও আমি ধন্যবাদ জানাই।’

তিনি আরো বলেন, ‘ইয়াহিয়া খান আমার ফাঁসির হুকুম দিয়েছিলেন। আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান। বাঙালিরা একবারই মরতে জানে। তাই বলেছি, ক্ষমা চাই না। তাদের বলেছি, তোমরা মারলে ক্ষতি নাই। কিন্তু আমার লাশ বাংলার মানুষের কাছে পৌঁছে দিও।… ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে আমি চিনি। তাকে আমি জানাই আমার শ্রদ্ধা। তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বের সব রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে আমার মুক্তির জন্য আবেদন করেছেন।’

৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ ভারতে প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে লাখ লাখ মানুষের সামনে ভারতের জনগণ ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি। মঞ্চের পাশের আসনে ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী।

বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আপনাকে মোবারকবাদ জানাই, বেশি করে শ্রীমতি গান্ধীকে, আমাকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়েছিল, আমাকে ফাঁসি দেয়ার জন্য তারা সব কিছু ঠিক করে ফেলেছিল, আমি জানি আপনি দুনিয়ার দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন। আপনি দেশে দেশে ঘুরেছেন, আমার দুঃখী মানুষের জন্য, ব্যক্তিগতভাবে আমার জন্য। সে জন্য আপনাকে আমি কৃতজ্ঞতা জানাই।’

১৯৭২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন সেদিন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে আসেন সেদিন। তাকে নিয়ে পাকিস্তানের সামরিক আদালতে যে বিচার প্রহসন চালানো হয়েছিল, হত্যার চেষ্টা হয়েছিল, সে সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু ডেভিড ফ্রস্টের সঙ্গে তার বহুলালোচিত সাক্ষাৎকারে সবিস্তারে বলেন : ‘দেশদ্রোহিতা, পাকিস্তান ও তার সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ও পাকিস্তানের পূর্ব অংশকে স্বাধীন করাসহ ১২টি অভিযোগ আনা হয়েছিল তার বিরুদ্ধে। ফাঁসিতে ঝুলানোর সব ব্যবস্থা সম্পন্ন হয়েছিল।’ তিনি এও বলেন, ‘কারাগারের পাশেই তার কবর খোঁড়া হয়েছিল।’

হারুন হাবীব : মুুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক।

SUMMARY

190-1.jpg