বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাংলাদেশের স্থপতি- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্রষ্টা, বাঙালি জাতির জনক, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা, বাঙালি জাতির মহাবিদ্রোহের মহানায়ক, বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা ও গণতন্ত্রের মানসপুত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান, যাঁর সুদীঘর্ দিনের সংগ্রাম, নেতৃত্ব ও আত্মত্যাগের ফলে বাঙালি জাতি আদিকাল থেকে নিয়ে প্রথমবারের মতো তাদের নিজস্ব একটি আবাস ভূমি প্রতিষ্ঠার সুযোগ পেয়েছে। বিশ্বের ইতিহাসে একটি সম্মানিত জাতি হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বেই বাঙালি জাতি অুপ্রাণিত ও ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ তথা পাকিস্তানি আধিপত্যবাদ ও সম্প্রদায়িকতার নাগপাশ থেকে মুক্ত করেছে তাদের স্বদেশভূমিকে। বাঙালি জাতির আত্মপ্রতিষ্ঠা ও জাতীয় ঐক্য গঠনের যে বিরামহীন সংগ্রাম প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে শুরু হয়েছে, সেই সংগ্রাম ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাঙালি জাতি বিশ্বের বুকে মহান স্বাধীন জাতি হিসেবে স্বীকৃতি পায়। মানব ইতিহাসে বাঙালি জাতির অভ্যুদয় এক যুগান্তকারী ঘটনা। এ যুগান্তকারী ইতিহাসের স্রষ্টা মহান জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
শেখ মুজিবুর রহমান (১৭ মার্চ ১৯২০ - ১৫ আগস্ট ১৯৭৫) বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ও ভারতীয় উপমহাদেশের একজন অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যিনি বাঙালীর অধিকার রক্ষায় ব্রিটিশ ভারত থেকে ভারত বিভাজন আন্দোলন এবং পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদান করেন। প্রাচীন বাঙ্গালি সভ্যতার আধুনিক স্থপতি হিসাবে শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের জাতির জনক বা জাতির পিতা বলা হয়ে থাকে। তিনি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সভাপতি, বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি এবং পরবর্তীতে এদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। জনসাধারণের কাছে তিনি শেখ মুজিব এবং শেখ সাহেব হিসাবে বেশি পরিচিত এবং তার উপাধি বঙ্গবন্ধু। তার কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বর্তমান সভানেত্রী এবং বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী।
১৯৪৭-এ ভারত বিভাগ পরবর্তী পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতির প্রাথমিক পর্যায়ে শেখ মুজিব ছিলেন তরুন ছাত্রনেতা।পরবর্তীতে তিনি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সভাপতি হন । সমাজতন্ত্রের পক্ষসমর্থনকারী একজন অধিবক্তা হিসেবে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর প্রতি সকল ধরণের বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। জনগণের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি একসময় ছয় দফা স্বায়ত্ত্বশাসন পরিকল্পনা প্রস্তাব করেন যাকে পশ্চিম পাকিস্তানে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী পরিকল্পনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। ছয় দফা দাবীর মধ্যে প্রধান ছিল বর্ধিত প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন যার কারণে তিনি আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের অন্যতম বিরোধী পক্ষে পরিণত হন। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকারের সাথে যোগসাজশ ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তার বিচার শুরু হয় এবং পরবর্তীতে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে তার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ বিপুল বিজয় অর্জন করে। তথাপি তাকে সরকার গঠনের সুযোগ দেয়া হয় নি।
পাকিস্তানের নতুন সরকার গঠন বিষয়ে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে শেখ মুজিবের আলোচনা বিফলে যাওয়ার পর ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে মার্চ ২৫ মধ্যরাত্রে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকা শহরে গণহত্যা পরিচালনা করে। একই রাতে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং পরবর্তীকালে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়।রহিমুদ্দিন খান সামরিক আদালতে তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে তবে তা কার্যকরা হয় নি। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৯৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনীর কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামে স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ শেখ মুজিব পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। পরবর্তীকালে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন। সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে ভিত্তি করে সংবিধান প্রণয়ন এবং সে অনুযায়ী রাষ্ট্র চালনার চেষ্টা সত্ত্বেও তীব্র দারিদ্র্য, বেকারত্ব, সর্বব্যাপী অরাজকতা এবং সেই সাথে ব্যাপক দুর্নীতি মোকাবেলায় তিনি কঠিন সময় অতিবাহিত করেন। ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক অস্থিরতা দমনের লক্ষ্যে ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি সকল দলীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে নিজেকে আজীবনের জন্য রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। এর সাত মাস পরে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তারিখে একদল সামরিক কর্মকর্তার হাতে তিনি সপরিবারে নিহত হন।
প্রাথমিক জীবন
জন্ম ও শিক্ষা:
বিশ্ববরেণ্য নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ ফরিদপুর জেলার টুঙ্গীপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা শেখ লুৎফর রহমান গোপালগঞ্জ দায়রা আদালতের সেরেস্তাদার (যিনি আদালতের হিসাব সংরক্ষণ করেন) ছিলেন এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার, স্পষ্টভাষী একজন মানুষ। তাঁর মায়ের নাম সায়েরা বেগম। চার কন্যা এবং দুই পুত্রের সংসারে তিনি ছিলেন তৃতীয় সন্তান। তার বড় বোন ফাতেমা বেগম, মেজ বোন আছিয়া বেগম, সেজ বোন হেলেন ও ছোট বোন লাইলী; তার ছোট ভাইয়ের নাম শেখ আবু নাসের।
মুজিব ছিলেন তাঁর মা-বাবার প্রথম ছেলে। ফলে পরিবারে তাঁর আদর কিছুটা বেশিই ছিল। তাঁর ডাকনাম ছিল খোকন। তাঁর বাল্যকাল কাটে টুঙ্গীপাড়া গ্রামে। তাঁর বাল্যশিক্ষা শুরু হয় বাড়িতেই। গৃহশিক্ষক পণ্ডিত সাখাউল্লাহর কাছেই পড়াশোনার হাতেখড়ি হয়। ১৯২৭ সালে শেখ মুজিব গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন যখন তার বয়স সাত বছর।তিনি টুঙ্গীপাড়ার গীমাডাঙ্গা স্কুলে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়াৗেশানা করেন।এরপর তিনি ভর্তি হন মাদারীপুর ইসলামিয়া হাইস্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে (১৯৩৪ সালে)। ১৯৩৫ সালে শেখ লুৎফর রহমান গোপালগঞ্জে বদলী হলে শেখ মুজিব গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু মারাত্মক চোখের ব্যাধি থাকার ফলে মুজিবকে তিন বছরের জন্য পড়াশোনা বন্ধ রাখতে হয়।কারণ তার চোখে জটিল রোগের কারণে সার্জারি করাতে হয়েছিল এবং এ থেকে সম্পূর্ণ সেরে উঠতে বেশ সময় লেগেছিল। ১৯৩৭ সালে তিনি গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন।
শেখ মুজিবুর রহমানের বয়স যখন ১০ তখন মাত্র ৩ বছর বয়সের ফজিলাতুন্নেছাকে বিয়ে করেন। ফজিলাতুন্নেছার বাবা মারা গেলে তাঁর দাদা এই বিয়ে দিয়ে সব সম্পত্তি নাতনীর নামে লিখে দেন। ফজিলাতুন্নেছা ৭ বছর বয়সে মাকে হারান। অসহায় এতিম মেয়েটিকে মুজিবের মা সায়েরা খাতুন বুকে টেনে নিয়ে কোলে-পিঠে মানুষ করেন। মুজিব-ফজিলাতুন্নেছা একই পরিবারের ছত্রচ্ছয়ায় বড় হতে থাকেন। ছোটবেলা থেকেই তাঁরা একে অপরকে বুঝতে শিখেছেন, জানতে শিখেছেন। তাঁরা উভয়ে খেলাঘরে খেলতে গিয়ে খেলার সাথী হয়েছিলেন, মরণেও তাই।
স্কুলে থাকাকালীন সময়েই তাঁর মধ্যে নেতৃত্বের বিকাশ ঘটতে শুরু করে।
রাজনৈতিক জীবনের সূচনা:
মুজিবের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছিল ১৯৩৯ সালে মিশনারি স্কুলে পড়ার সময় থেকেই। গোপালগঞ্জের মিশন হাইস্কুলের পঞ্চম শ্রেণীতে পড়বার সময় থেকেই খেলাধূলা এবং নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ছিলেন একাগ্রচিত্ত। তিনি পড়াশোনায় যেমন ছিলেন মেধাবী, তেমনি ছিলেন দুরন্ত এবং বলিষ্ঠ চরিত্রের অধিকারী। জীবনের শুরু থেকেই অন্যায়, অবিচার আর অসত্যের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে শিখেছিলেন। দশ-এগার বছর থেকেই শুরু তাঁর রাজনৈতিক জীবন। সে সময় হামিদ মাস্টার নামে তাঁর একজন গৃহশিক্ষক ছিলেন। তিনি ছিলেন বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের একজন নিষ্ঠাবান কর্মী। এই হামিদ মাস্টারের কাছে মুজিব রাজনৈতিক দীক্ষা লাভ করেন। মাস্টার সাহেব তখন একটি সামাজিক সংগঠন গড়ে তোলেন। মুজিব এ সংগঠনের সাথে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন। সংগঠনের কাজ ছিল বাড়ি থেকে বাড়ি গিয়ে ধান, টাকা তুলে মেধাবী গরীব ছাত্র-ছাত্রীদের সাহায্য করা। অসহায় মানুষদের সাহায্য করার শিক্ষা মুজিব এখান থেকেই পেয়েছিলেন। দলনেতা হিসেবে রাজনীতিতে অংশগ্রহণের এবং ব্যাপক প্রভাব বিস্তারের লক্ষণ তাঁর মধ্যে অল্পবয়সেই দেখা গিয়েছিল। ১৯৩৭ সালে তিনি যখন মাত্র ক্লাস সিক্সের ছাত্র তখনই একটি ঘটনা তাঁকে রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত করতে সাহায্য করে। সময় তখন ১৯৩৮ সালের ১৬ই জানুয়ারি। অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী এ.কে ফজলুল হক এবং বাণিজ্য ও পল্লী উন্নয়নমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এসময় গোপালগঞ্জ পরিদর্শনে আসেন। তখন আগমণ উপলক্ষে মুসলিম লীগ ও কৃষক প্রজা পার্টি একটি সম্বর্ধনার আয়োজন করে। মুজিব তখন এই সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানের পক্ষে কাজ করেন। তিনি তখন গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের ছাত্র। ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পরিদর্শন শেষে ফেরার পথে মুজিব তাঁর সহপাঠীদের নিয়ে পথ রোধ করে দাঁড়ান। শেখ মুজিবের দাবি ছিল তাঁরা যে হোস্টেলে থাকেন তার ছাদ ফেটে গেছে, বর্ষার পানি পড়ে বিছানাপত্র নষ্ট হয়। তাই ওটা মেরামত করে দিতে হবে। শেখ মুজবের সাহস দেখে তো হেড স্যার ভড়কে গেলেন। তাঁর স্কুলের ছেলেরা স্বয়ং মুখ্যমনত্রীর সাথে বেয়াদবি করেছে, না জানি এ অপরাধের কি শাস্তি হবে !
মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা ছেলেটির সাহস দেখে মুগ্ধ হলেন। তিনি তখন নিজেই এগিয়ে এসে বললেন, “এই ছেলে, তুমি কি বলতে চাও ?” শেখ মুজিব তাঁদের দাবির কথা বললেন। শেরে বাংলা থেমে বললেন, “তার আমি কি করব ?”
হোস্টেলের ছাদ মেরামত করে না দিলে পথ ছাড়বো না।
বেশ, এই ছাদ মেরামত করতে কত লাগবে ?
বারোশো টাকা।
শেরে বাংলা ছেলেটির সাহস দেখে সত্যিই মুগ্ধ হয়েছিলেন। হয়তো বাংলার এক ব্যাঘ্র পুরুষ একজন কিশোরের চোখেমুখে বিপুল সম্ভাবনার সিংহ শাবককে দেখেছিলেন। শেরে বাংলা তাঁর স্বেচ্ছাধীন তহবিল থেকে স্কুল হোস্টেলের নামে বারোশো টাকা মঞ্জুর করে দিলেন।
কিন্তু ঘটনার সমাপ্তি এখানে হলো না। শেরে বাংলা ডাক বাংলোতে গিয়ে আবার শেখ মুজিবকে ডেকে পাঠালেন। সেই থেকে শেখ মুজিব হলেন শেরে বাংলা ও সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক শিষ্য। এই সম্পর্ক তাঁদের আজীবন ছিল।
১৯৩৯ সালে ১৯ বছর বয়সে স্কুলজীবনে এক অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে যেয়ে প্রথম কারাবরণ করেন। যদিও সাতদিন হাজতবাসের পর তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়।
স্কুলজীবনে শেখ মুজিবুর রহমান একজন প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে গড়ে ওঠেন। ১৯৪০ সালে তিনি নিখিল ভারত মুসলিম ফেডারেশনে যোগ দেন। তিনি বঙ্গীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলার, গোপালগঞ্জ ডিফেন্স কমিটির সেক্রেটারী নিযুক্ত হন। তিনি গোপালগঞ্জ মুসলিম সেবক সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৪২ সনে এনট্র্যান্স পাশ করার পর কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে (বর্তমান নাম মাওলানা আজাদ কলেজ) আইন পড়ার জন্য ভর্তি হন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত এই কলেজটি তখন বেশ নামকরা ছিল। এই কলেজ থেকে সক্রিয়ভাবে ছাত্র রাজনীতি শুরু করেন।কলকাতা আগমনের অল্পদিনের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম শ্রেণীর ছাত্রনেতা হিসেবে স্বীকৃতি পান।১৯৪৩ সালে তিনি বেঙ্গল মুসলিম লীগে যোগ দেন এবং অগ্রণী কাশ্মিরী বংশদ্ভুত বাঙালি মুসলিম নেতা হুসেইন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে আসেন।১৯৪২ সাল স্কুল তেকে ১৯৪৭ সাল প৪র্যন্ত পাকিস্তান দাবীর পক্ষে মুসলিম লীগ ও মুসলিম ছাত্রলীগের উদ্যোগে যেসব আন্দোলন হয়েছে তার পুরোভাগে ছিলেন তিনি। তিনি মুসলিম ছাত্রলীগের প্রথম সারির নেতা ছিলেন।এখানে তার ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য বিষয় ছিল একটি পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন। ১৯৪৩ সনে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন।
১৯৪৩ সালে বাংলায় মহামারী আকারে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। মাত্র দেড় মাস সময়ের দুর্ভিক্ষে প্রায় ত্রিশ লাখ লোক প্রাণ হারায়। শেখ মুজিব গোপালগঞ্জ ও কলকাতায় দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের সেবায় এগিয়ে আসেন। এবছর শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গীয় মুসলি লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন এবং ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এ পদে বহাল ছিলেন।
১৯৪৪ সনে বর্তমান বাংলাদেশের কুষ্টিয়ায় নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্র লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে শেখ মুজিব বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তিনি কলকাতায় বসবাসকারী ফরিদপুরবাসীদের নিয়ে তৈরি "ফরিদপুর ডিস্ট্রিক্ট এসোসিয়েশনের" সেক্রেটারি মনোনীত হন। এর দুই বছর পর ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের মহাসচিব নির্বাচিত হন।
১৯৪৬ সালে ইসলামিয়া কলেজ ইউনিয়ন নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সমপাদক নিযুক্ত হন। ১৯৪৬ সালের ১৯ থেকে ২২শে মার্চ প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমান ফরিদপুর জেলায় নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৪৭ সনে অর্থাৎ দেশবিভাগের বছর মুজিব কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রী লাভ করেন। ভারত ও পাকিস্তান পৃথক হওয়ার সময়ে কলকাতায় ভয়ানক হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয়। এসময় মুজিব মুসলিমদের রক্ষা এবং দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সোহরাওয়ার্দীর সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক তৎপরতায় শরিক হন । এই সময় কলকাতা দাঙ্গা প্রতিরোধ তৎপরতায় মুজিবের ভূমিকা ছিল অগ্রণী।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ঢাকায় এসে ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে। ১৯৪৭ সালেই তিনি পূর্ব বাংলা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলো বটে কিন্তু স্বপ্নভঙ্গ হতে দেরী হলো না। পূর্ব বাংলার মানুষেরা দেখলো তারা নব্য ঔপনিবেশিক শাসনে অধীনে এসে পড়েছে। পশ্চিমাদের শাসন আর শোষণ শুরু হলো।এই শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন শেখ মুজিব।
তিনি কলকাতা থেকে আগত ছাত্রনেতাদের নিয়ে একটি বিরাট রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নেন। এ ছাত্রনেতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ফজলুল কাদের চৌধুরী, জহিরুদ্দীন, নুরুদ্দীন আহমদ, আব্দুর রহমান প্রমুখ। এসময় গণতান্ত্রিক যুবলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। ফজলুল কাদের চৌধুরী ব্যবসায় নিয়োজিত হয়ে পড়লে নেতৃত্বের ভার মুজিবের উপর ন্যাস্ত হয়।
১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে ঢাকার বলিয়াদি হাউজে মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীনের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনার জন্য আইনসভার একটি উপদলের বৈঠক ডাকা হয়। শেখ মুজিব এতে নেতৃত্ব দেন।
১৯৪৮ সালের জানুয়ারি ৪ তারিখে প্রতিষ্ঠা করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ যার মাধ্যমে তিনি উক্ত প্রদেশের অন্যতম প্রধান ছাত্রনেতায় পরিণত হন। এ সময় সমাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকে পড়েন এবং দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও জীবনযাত্রার নিম্নমানের উন্নয়নের জন্য এটিকেই একমাত্র সমাধান হিসেবে মনে করতে থাকেন।
প্রাথমিক রাজনৈতিক তৎপরতা
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন:
বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবী নিয়ে প্রতিষ্ঠিত আন্দোলনে অংশ নেয়ার মাধ্যমেই শেখ মুজিবের রাজনৈতিক তৎপরতার সূচনা ঘটে।পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম থেকেই মুসলিম লীগ সরকার বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। তারা সংখ্যাগুরু বাঙ্গালীদের ভাষাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে উদ্যোগ নেয়। পাকিস্তান গণপরিষদে উর্দু ও ইংরেজী ছাড়া অন্য ভাষায় বক্তৃতা দেয়ার অনুমতি ছিল না। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্র“য়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন গণ-পরিষদের অধিবেশনে বলেন যে, উর্দূই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। তার এই মন্তব্যে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
এ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজ তীব্র প্রতিবাদ জানায়।প্রতিবাদী শেখ মুজিব অবিলম্বে মুসলিম লীগের এই পূর্ব পরিকল্পিত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরুর সিদ্ধান্ত নেন। এই বছরের ২ মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নীতিমালা নিয়ে আলোচনা করা হয় যাতে শেখ মুজিব একটি প্রস্তাব পেশ করেছিলেন। এখান থেকেই সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষার দাবিতে হরতাল পালন করে। শেখ মুজিবুর রহমান একদল ছাত্র নিয়ে পূর্ব বাংলা সরকারের সচিবালয় ঘেরাও করে এবং কর্মচারীদের হরতাল পালনের জন্য আহ্বান জানায়। পুলিশ ছাত্রদের উপর আক্রমণ চালায় এবং শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৬৫ জনকে গ্রেফতার করে। পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯শে মার্চ ঢাকা আগমন করেন। তাই মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন ছাত্রদের সাথে বাংলাভাষাকে অন্যরকম রাষ্ট্র্রভাষা করার চুক্তি করেন এবং ছাত্রনেতাদের মুক্তি দেন। ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় শেখ মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম, পরিষদের র্যালি ও সভা অনুষ্ঠিত হয়। পুলিশ এই র্যালি অবরোধ করেছিল। পুলিশী কার্যক্রমের প্রতিবাদে শেখ মুজিব অবিলম্বে ১৭ মার্চ ১৯৪৮ তারিখে দেশব্যাপী ছাত্র ধর্মঘটের ঘোষণা দেন।
১৯৪৯ সালের ৩রা মার্চ তাঁর নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীগণ বিভিন্ন দাবিতে হরতাল পালন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মুসলিম সরকারের ইঙ্গিতে শেখ মুজিবুর রহমানসহ ২৭ জন ছাত্রনেতাকে বহিষ্কার ও জরিমানা করে। তিনি জরিমানা ও অঙ্গীকারনামা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যাননি। ফলে তাঁর আইন পড়া চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। উল্লেখ্য ২০১০ সালের ১৪ আগস্ট তাঁর হৃত ছাত্রত্ব (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) ফিরিয়ে দেয়া হয়।
১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২১ জানুয়ারি শেখ মুজিবকে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়। জেল থেকে বেরিয়ে তিনি আবার চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের দাবী আদায়ের আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন যার জন্য তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জরিমানা করা হয়। কিন্তু তিনি এই জরিমানাকে অবৈধ ঘোষণা করে তা আদায় থেকে বিরত থাকেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২৬ এপ্রিল মুসলিম লীগ বিরোধী প্রার্থী শামসুল হক টাঙ্গাইলে একটি উপ-নির্বাচনে বিজয় লাভ করেন। শেখ মুজিব তার সেই আন্দোলনের সফলতার জন্য উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অনশনের ধর্মঘট করেন যার জন্য তাকে আবার আটক করা হয়। এ সময়ই তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মাচারীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান।
২৩ জুন সোহরাওয়ার্দী এবং মাওলানা ভাসানী পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করার পর শেখ মুজিব মুসলিম লীগ ছেড়ে দিয়ে এই নতুন দলে যোগ দেন। তাঁকে দলের পূর্ব পাকিস্তান অংশের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। জুনের শেষ দিকে জেল থেকে ছাড়া পান। ছাড়া পাওয়ার পরই খাদ্য সংকটের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যোগ দেন। এ বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের অভিযোগে তাঁকে সাময়িকভাবে আটক করে রাখা হলেও অচিরেই ছাড়া পেয়ে যান। এর পর মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সাথে মিলে লিয়াকত আলি খানের কাছে একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণের চেষ্টা করায় ভাসানী এবং তাঁকে আটক করা হয়। এটি ছিল অক্টোবরের শেষদিকের কথা।
১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসের প্রথমদিকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের পূর্ব পাকিস্তান আগমনকে উপলক্ষ করে আওয়ামী মুসলিম লীগ ঢাকায় দুর্ভিক্ষবিরোধী মিছিল বের করে। এই মিছিলের নেতৃত্ব দেয়ার কারণেমাওলানা ভাসানীর সাথে কারাবরণ করেন। সেবার তার দুই বছর জেল হয়েছিল।
১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে মহান ভাষা আন্দোলন তীব্রতা লাভ করে।১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা করেন, উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে।এ ঘোষণার পর জেলে থাকা সত্ত্বেও মুজিব প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ আয়োজনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। জেল থেকে নির্দেশনা দেয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদকে পরিচালনায় তিনি ভূমিকা রাখেন।এরপরই ২১ ফেব্রুয়ারিকে রাষ্ট্রভাষার দাবী আদায়ের দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। একই সময়ে শেখ মুজিব জেলে থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন পালনের সিদ্ধান্ত নেন। তার এই অনশন ১৩ দিন কার্যকর ছিল। ২৬ ফেব্রুয়ারি তাকে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়। এই বছরের ২১শে ফেব্র“য়ারি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে যেয়ে সরকারের পুলিশ বাহিনীর হাতে জীবন দান করে বরকত, সালাম, জব্বার ও রফিকের মতো তাজাপ্রাণের তরুণেরা। এসময় শেখ মুজিব কারাগারের অন্তরালে থেকেই তিনি ভাষা আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন এবং মর্মান্তিক বাঙ্গালী ছাত্র-তরুণ হত্যার তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করেন। ভাষা আন্দোলনই এদেশের স্বাধীকার প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকেরা বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে বাধ্য হয়।
যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন
১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ৯ জুলাই তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনের শেষে দলের সেক্রেটারী জেনারেল (মহাসচিব) নির্বাচিত হন। একই বছরের ১৪ নভেম্বর সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য অন্যান্য দল নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯৫৪ সালের ১০ মার্চ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যুক্তফ্রন্ট পূর্ব পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে প্রাদেশিক সরকার গঠন করে। ভরাডবি হয় ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের।এই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ২৩৭ টি আসনের মধ্যে ২২৩ টিতে বিপুল ব্যবধানে বিজয় অর্জন করে যার মধ্যে ১৪৩ টি আসনই আওয়ামী লীগ লাভ করেছিল। শেখ মুজিব গোপালগঞ্জে আসনে ১৩,০০০ ভোটের ব্যবধানে বিজয় লাভ করেন। সেখানে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল শক্তিশালী মুসলিম লীগ নেতা ওয়াহিদুজ্জামান।
যুক্তফ্রন্টের শরীক দলের মধ্যে অন্যতম ছিল শেরে বাংলা ফজলুল হকের কৃষক শ্রমিক দল এবং সোহরাওয়ার্দী-মুজিব ও ভাসানীর আওয়ামী লীগ।
১৫ মে তাকে কৃষি ও বন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু যুক্তফ্রন্টের ক্ষমতা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।২৯ মে কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট ভেঙে দেয় তারপর াতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। ঐ মন্ত্রীসভায় শেখ মুজিব শিল্প ও বাণিজ্য দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী নিযুক্ত হন। এই মন্ত্রী পরিষদ বেশিদিন টেকেনি। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে গোলাম মোহাম্মদ নামের একজন উর্দুভাষী ক্ষমতাসীন ব্যক্তিত্ব সকল ষড়যন্ত্রের কলকাঠি নাড়ছিলেন। পরবর্তীতে তৎকালীন পূর্ব পাকি-স্তানে আওয়ামী লীগ মাত্র দু’বছর শাসনকার্য পরিচালনা করতে পেরেছিল।
৩০ মে করাচি থেকে ঢাকা ফেরার পর বিমান বন্দর থেকেই তাকে আটক করা হয়। ২৩ ডিসেম্বর মুক্তি লাভ করেন।
১৯৫৫ সালের ৫ জুন শেখ মুজিব আইন পরিষদের সদস্য মনোনীত হন। ১৭ জুন আওয়ামী লীগ পল্টন ময়দানে আয়োজিত এক সম্মেলনে ২১ দফা দাবী পেশ করে যার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন অন্তর্ভুক্ত ছিল। ২৩ জুন দলের কার্যনির্বাহী পরিষদের সভায় সিদ্ধান্ত হয়, পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন অর্জিত না হলে আইন সভার সকল সদস্য পদত্যাগ করবেন। ২৫ আগস্ট পাকিস্তানের করাচিতে গণপরিষদের অধিবেশনে শেখ মুজিব বলেন:
(ইংরেজি)
« Sir [President of the Constituent Assembly],, you will see that they want to place the word ‘East Pakistan’ instead of ‘East Bengal’. We have demanded so many times that you should use Bengal instead of Pakistan. The word ‘Bengal’ has a history, has a tradition of its own. You can change it only after the people have been consulted. If you want to change it then we have to go back to Bengal and ask them whether they accept it. So far as the question of One-Unit is concerned it can come in the constitution. Why do you want it to be taken up just now? What about the state language, Bengali? What about joint electorate? What about Autonomy? The people of East Bengal will be prepared to consider One-Unit with all these things. So, I appeal to my friends on that side to allow the people to give their verdict in any way, in the form of referendum or in the form of plebicite. »
(বাংলা)
« স্যার [গণপরিষদে প্রেসিডেন্ট], আপনি দেখবেন ওরা "পূর্ব বাংলা" নামের পরিবর্তে "পূর্ব পাকিস্তান" নাম রাখতে চায়। আমরা বহুবার দাবি জানিয়েছি যে; পাকিস্তানের পরিবর্তে আপনাদের বাংলা [বঙ্গ] ব্যবহার করতে হবে। "বাংলা" শব্দটার একটি নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য আছে। আপনারা এই নাম আমাদের জনগণের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে পরিবর্তন করতে পারেন। আপনারা যদি ঐ নাম পরিবর্তন করতে চান তাহলে আমাদের বাংলায় আবার যেতে হবে এবং সেখানকার জনগণের কাছে জিজ্ঞেস করতে হবে তারা নাম পরিবর্তনকে মেনে নেবে কিনা। এক ইউনিটের প্রশ্নটা গঠনতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। আপনারা এটাকে এখনই কেন তুলতে চান? বাংলা ভাষাকে, রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করার ব্যাপারে কি হবে? যুক্ত নির্বাচনী এলাকা গঠনের প্রশ্ননটাই কি সমাধান? আমাদের স্বায়ত্তশাসন সম্বন্ধে ভাবছেন? পূর্ব বাংলার জনগণ অন্যান্য প্রশ্নগুলোর সমাধানের সাথে এক ইউনিটের প্রশ্নটাকে বিবেচনা করতে প্রস্তুত। তাই আমি আমার ঐ অংশের বন্ধুদের কাছে আবেদন জানাবো তারা যেন আমাদের জনগণের ‘রেফারেন্ডাম’ অথবা গণভোটের মাধ্যমে দেয়া রায়কে মেনে নেন।
২১ অক্টোবর বাংলাদেশ আওয়ামী মুসলিম লীগের বিশেষ অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে দলের নাম থেকে "মুসলিম" শব্দটি বাদ দেয়া হয়। শেখ মুজিব পুনরায় দলের মহাসচিব নির্বাচিত হন। ৩ ফেব্রয়ারি মুখ্য মন্ত্রীর সাথে আওয়ামী লীগের বৈঠকে দল থেকে খসড়া সংবিধানে স্বায়ত্ত্বশাসন অন্তর্ভুক্ত করার দাবী জানানো হয়। ১৪ জুলাই রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে সামরিক উপস্থিতির বিরুদ্ধে একটি প্রস্তাব রাখা হয় যা তিনিই সরকারের কাছে পেশ করেন। সেপ্টেম্বর মাসের ৪ তারিখ তাঁর নেতৃত্বে একটি দুর্ভিক্ষ বিরোধী মিছিল বের হয়। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের কারণে এই মিছিলে পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে কমপক্ষে তিনজন নিহত হয়। ১৬ সেপ্টেম্বর শেখ মুজিব কোয়ালিশন সরকারে যোগ দিয়ে একযোগে শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতিরোধ এবং গ্রামীণ সহায়তা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দলের জন্য সম্পূর্ণ সময় ব্যয় করার তাগিদে ১৯৫৭ সালে ৩০ মে মন্ত্রীপরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন। ৭ আগস্ট সরকারি সফরে চীন এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন গমন করেন। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা এবং সেনাবাহিনী প্রধান আইয়ুব খান দেশে সামরিক আইন জারি করে সকল ধরণের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তিনি রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করার পর জনগণের উপর ইধংরপ উবসড়পৎধপু নামে একটি শাসন পদ্ধতি চাপিয়ে দেন। সামরিক শাসন জারীর পর ক্ষমতা কুক্ষীগত করে রাখার জন্য শুরু হয় নির্যাতন। দেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের নানা অজুহাতে গ্রেফতার করা হয়।এই বছরেরই ১১ অক্টোবর তাঁকে আটক করা হয়। জেলা থাকা অবস্থায় তাঁর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি ভিত্তিহীন অভিযোগ আনা হয়। ১৪ মাস একটানা আটক থাকার পর তাঁকে মুক্তি দেয়া হলেও জেলের ফটক থেকে পুনরায় তাঁকে গ্রেফতার করা হয়।
পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান নেতা
উচ্চ আদালতে একটি রিট পিটিশন দায়ের করার মাধ্যমে তিনি ১৯৬১ সালে জেল থেকে ছাড়া পান। এবার শুরু করেন গুপ্ত রাজনৈতিক তৎপরতা। অন্যান্য সাধারণ ছাত্রনেতাদের নিয়ে গোপনে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন যার উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা আদায়ের লক্ষ্যে কাজ কর ।১৯৬২ সাল থেকেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একদল বাঙালী তরুণ সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাকে স্বাধীন করার পরিকল্পনা করে আসছিল।
১৯৬২ সালের ৬ ফেব্রয়ারি জননিরাপত্তা আইনে তাকে আবার আটক করা হয়েছিল। জুনের ২ তারিখে চার বছরব্যাপী মার্শাল ল অপসারণের পর একই মাসের ১৮ তারিখে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। ২৫ জুন অন্য রাজনৈতিক নেতাদের সাথে মিলে আইয়ুব খান আরোপিত বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুর বিরুদ্ধে সংগ্রামে নেমে পড়েন। ৫ জুন পল্টন ময়দানে আয়োজিত এক সম্মেলনে আইয়ুব খানের সমালোচনা করেন। ২৪ সেপ্টেম্বর লাহোর যান এবং সেখানে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে মিলে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গড়ে তোলেন। এটি মূলত বিরোধী দলসমূহের একটি সাধারণ কাঠামো হিসেবে কাজ করেছিল। পুরো অক্টোবর মাস জুড়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে মিলে বাংলার বিভিন্ন স্থান সফর করেন এই যুক্তফ্রন্টের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে। ১৯৬৩ সালে সোহরাওয়ার্দীর সাথে আলোচনার উদ্দেশ্যে লন্ডন যান, সোহরাওয়ার্দী সেখানে চিকিৎসারত ছিলেন। এই বছরের ৫ ডিসেম্বর তিনি বৈরুতে মৃত্যুবরণ করেন।পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দী লেবাননের রাজধানী বৈরুতে নির্বাসিত অবস্থায় মারা গেলে শেখ মুজিব দলের ভিতর তাঁর অবস্থান সুদৃঢ় করে নেন।
সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর ১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারি মুজিবের বাসায় অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে আওয়ামী লীগকে পুণরায় সংহত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই বৈঠকের প্রস্তাবের ভিত্তিতে শেখ মুজিব তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের মহাসচিব ও মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ১১ মার্চ একটি সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় যার মাধ্যমে মুজিব সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধকল্পে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। সেনাশাসক আইয়ুব খানের বেসিক ডেমোক্রেসিস প্ল্যান, সামরিক শাসন এবং এক-ইউনিট পদ্ধতির বিরোধী নেতাদের মধ্যে অগ্রগামী ছিলেন শেখ মুজিব। এই পদ্ধতি অনুযায়ী ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার পরিকল্পনা করা হয় এবং প্রদেশগুলোকে একত্রে জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে কাজ করতে গিয়ে, মুজিব আইয়ুব বিরোধী দল প্রার্থী ফাতিমা জিন্নাহকে সমর্থন করেন। যথারীতি নির্বাচনের দুই সপ্তাহ পূর্বে তাকে আটক করা হয়। তাকে রাষ্ট্রদ্রোহীতা এবং আপত্তিকর প্রস্তাব পেশের অভিযোগে অভিযুক্ত করে এক বছরের কারদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। অবশ্য উচ্চ আদালতের এক রায়ে তার আগেই তিনি মুক্তি পেয়ে যান। এ সময় সামরিক বাহিনীর গণহত্যা আর বাঙালিদের চাহিদা পূরণে সামরিক শাসকদের ঔদাসীন্য পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে ক্ষুব্ধ করে তোলে।
ছয় দফা দাবী:
বঙ্গবন্:ধুর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা পশ্চিম পাকিসতানি সামরিক গোষ্ঠীর কাছে ঐতিহাসিক ৬ দফা পেশ। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেখা যায় বাঙালির কৃষ্টি, সংস্কৃতি অর্থনীতি আর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের উপর নেমে আসে ক্ষমতাসীন পশ্চিম পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের নির্যাতন আর শোষণ। শেখ মুজিবর রহমান পাকিস্তানি শাসক শোষক গোষ্ঠীর হাত থেকে বাঙালি জাতির স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে ১৯৬৬ সালে ৭ই জুন পাকিস্তান সরকারের সমীপে পেশ করেন ঐতিহাসিক ছয় দফা। ছয় দফা বাঙালি জাতির অকুণ্ঠ সমর্থন লাভ করে। গোটা জাতি আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ হয়।
শেখ মুজিব এই দাবীকে "আমাদের বাঁচার দাবী" শিরোনামে প্রচার করেছিলেন। এই দাবীর মূল বিষয় ছিল একটি দুর্বল কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে পরিচালিত পাকিস্তানী ফেডারেশনে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন।এই দাবী সম্মেলনের উদ্যোক্তারা প্রত্যাখান করেন এবং শেখ মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করেন। এ কারণে তিনি উক্ত সম্মেলন বর্জন করে পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসেন। মার্চ মাসের এক তারিখে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনের পর তিনি ছয় দফার পক্ষে সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে দেশব্যাপী অভিযান পরিচালনা করেন। প্রায় পুরো দেশই ভ্রমণ করেন। এই ভ্রমণের সময় তিনি সিলেট, ময়মনসিংহ এবং ঢাকায় বেশ কয়েকবার পুলিশের হাতে বন্দী হন। বছরের প্রথম চতুর্থাংশেই তাকে আটবার আটক করা হয়েছিল। এই বছরের মে ৮ তারিখে নারায়ণগঞ্জে পাট কারখানার শ্রমিকদের এক র্যালিতে অংশগ্রহণের জন্য তাকে আবার গ্রেফতার করা হয়। তার মুক্তির দাবীতে ৭ জুন দেশব্যাপী ধর্মঘট পালিত হয়। পুলিশ এই ধর্মঘট চলাকালে গুলিবর্ষণ করে যার কারণে ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জে আনুমানিক তিনজনের মৃত্যু হয়।তৎকালীন একনায়ক আইয়ুব খানের শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে অসন্তোষ ক্রমেই ঘনীভূত হতে থাকে।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা:
১৯৬৭ সালে নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কমাণ্ডার মোয়াজ্জমের হোসেনের নেতৃত্বে বেঙ্গল লিবারেশন ফোর্স গঠিত হয়। তাঁরা শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে পরামর্শ করে গোপনে সংগঠিত হতে থাকে। কিন্তু তাঁদের এ পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যায়। ঐ বছরই আইয়ুব সরকার লেফটেন্যান্ট কর্ণেল মোয়াজ্জেম হোসেনকে প্রধান আসামী করে “আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা” শুরু করে। মামলার এক নম্বর আসামী ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্ণেল মোয়াজ্জেম হোসেন। পরে ১৯৬৮ সালে ১৮ই জানুয়ারি শেখ মুজিবকে প্রধান আসামী করে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে াষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে “আগরতলা মামলা” দায়ের করা হয়। আসামীদের বিরদ্ধ অভিযোগ ছিল যে, তারা ভারতের কাছ থেকে গোপনে অস্ত্র ও অর্থ সংগ্রহের মাদ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য ষড়যন্ত্র করছে। সরকারের উদ্দেশ্য ছিল আসামীদের সাথে ভারতের যোগসাজস রয়েছে এটা প্রমাণিত হলে জনগণ মুজিবের বিরুদ্ধে চলে যাবে।
১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি শেখ মুজিবর রহমানকে ঢাকা জেলখানা থেকে মুকিত দিয়ে দেশরক্ষা আইনে গ্রেফতার করে ঢাকা সেনানিবাসে বন্দী করা হয়। এসময়ে দেশব্যাপী আগরতলা “ষড়যন্ত্র মামলা”র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ওঠে এবং সকল আসামীর মুক্তির দাবী করা হয়। ১৯৬৮ সালে ২১ এপ্রিল সুপ্রীম কোর্টের সাবেক বিচারপতি এম. এ রহমানের নেতৃত্বে ৩৫ অভিযুক্তের বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ১৯শে জুন কুর্মিটোলা সেনানিবাসে রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য মামলার শুনানী অনুষ্ঠিত হয়। সরকার পক্ষের উকিল ছিলেন পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মঞ্জুর কাদের। মুজিবের পক্ষ সমর্থনের জন্য এলেন বৃটেনের রাণীর আইন বিষয়ক উপদেষ্টা টমাস উইলিয়াম। এছাড়াও অভিযুক্তদের পক্ষে ছিলেন বিশিষ্ট আইনজীবী ড. আলীম আল রাজী, আব্দুস সালাম খান, ড. কামাল হোসেন, আতাউর রহমান খান ও জহিরউদ্দীন প্রমুখ।
এই মামলায় প্রায় ২৫০ জন সাক্ষী ¯ক্ষ্য প্রদান করে। মামলায় অভিযুক্তদের প্রতি সামরিক বাহিনী যে অমানুষিক নির্যাতন চালায় তা সাক্ষ্য গ্রহণের সময় প্রকাশিত হয়ে পড়ে। মামলার অন্যতম আসামী লেঃ কর্ণেল মোয়াজ্জেম হোসেন নির্যাতনের ফলে তাঁর যে দাঁতটি পড়ে যায় তা কোর্টে উপস্থিত করেন।
উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান:
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রতিক্রিয়া হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুব বিরোধী গণবিক্ষোভে ফেটে পড়ে বাঙালী জাতি। এইবারা আপামর জনতার সাথে যোগ দিলেন দেশের তরুণসমাজ। ছয় দফার পাশাপাশি ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকেও পেশ করা হলো তৎকালীন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা দাবী। ছয় দফা ও ১১ দফার যৌথ দাবীতে শুরু হলো তীব্র আন্দোলন।পরিষদের সিদ্ধান্তক্রমে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবীতে দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলনের প্রস্তুতি গৃহীত হয়। এই সংগ্রাম এক সময় গণ আন্দোলনে রূপ নেয়। এই গণ আন্দোলনই ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান নামে পরিচিত। মাসব্যাপী প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ আন্দোলন, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ, কারফিউ, পুলিশের গুলিবর্ষণ এবং বেশ কিছু হতাহতের পর আন্দোলন চরম রূপ ধারণ করলে পাকিস্তান সরকার ছাড় দিতে বাধ্য হয়।তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান রাজনৈতিক নেতাদের সাথে এক গোলটেবিল বৈঠকের পর এই মামলা প্রত্যাহার করে নেন। এর সাথে শেখ মুজিবসহ অভিযুক্ত সকলকে মুক্তি দেয়া হয়। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এই বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি তারিখে শেখ মুজিবের সম্মানে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক সভার আয়োজন করে। লাখো জনতার এই সম্মেলনে শেখ মুজিবকে "বঙ্গবন্ধু" উপাধি প্রদান করা হয়। উপাধি প্রদানের ঘোষণা দিয়েছিলেন জনাব তোফায়েল আহমেদ। এই সভায় রাখা বক্তৃতায় শেখ মুজিব ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এগার দফা দাবীর পক্ষে তার পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন।
১৯৬৯ সালে আইয়ুব খানের আহ্বানে অনুষ্ঠিত একটি সর্বদলীয় সম্মেলনে মুজিব তাঁর ছয়-দফাসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের চাহিদাগুলো মেনে নেওয়ার আহ্বান জানান এবং তা প্রত্যাখ্যাত হলে সম্মেলন থেকে বের হয়ে আসেন। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক জনসভায় মুজিব ঘোষণা করেন যে এখন থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে "বাংলাদেশ" নামে অভিহিত করা হবে:
" একটা সময় ছিল যখন এই মাটি আর মানচিত্র থেকে "বাংলা" শব্দটি মুছে ফেলার সব ধরণের প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল। "বাংলা" শব্দটির অস্তিত্ব শুধু বঙ্গোপসাগর ছাড়া আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যেত না। আমি পাকিস্তানের পক্ষ থেকে আজ ঘোষণা করছি যে, এখন থেকে এই দেশকে 'পূর্ব পাকিস্তানের' বদলে 'বাংলাদেশ' ডাকা হবে"।
মুজিবের এই ঘোষণার ফলে সারা দেশে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিবিদ এবং সামরিক কর্তারা তাঁকে একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে মূল্যায়িত করতে শুরু করেন। মুজিবের বাঙালি সংস্কৃতি ও জাতিগত আত্মপরিচয়ের বহিঃপ্রকাশ প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসনের বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করে। অনেক বুদ্ধজীবী ব্যক্তিত্ব্যের মতে, বাঙালিদের আন্দোলন দ্বিজাতিতত্ত্বকে অস্বীকার করার নামান্তর। এই দ্বিজাতিতত্ত্বের মাধ্যমেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। বাঙালিদের জাতিগত ও সংস্কৃতিগত এই আত্মপরিচয় তাদেরকে একটি আলাদা জাতিসত্ত্বা প্রদান করে।[৯] মুজিব পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক জনমত গড়ে তুলতে সমর্থ হন এবং কার্যত ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন।
১৯৬৯ সালের ২৪ মার্চ আইয়ুব খান পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। তারপর ক্ষমতায় এলেন আরেক সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান। তিনি ক্ষমতায় এসে আন্দোলন স্তিমিত করার কৌশল হিসেবে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দেন।
১৯৭০ এর নির্বাচন ও স্বাধীনতা যুদ্ধ
১৯৭০ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ মজিবুর রহমান পাকিস্তান আওয়ামীলীগের সভাপতি এবং এ.এইচ.এম কামরুজ্জামান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। জানুয়ারি মাস থেকে শেখ মুজিব নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু করেন। শেখ মুজিব নির্বাচন উপলক্ষে ২৮শে অক্টোবর জাতির উদ্দেশ্যে বেতার ও টেলিভিশনে ভাষণ দেন। এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, “আমাদের সংগ্রাম চলবেই। কারণ আমাদের মূল লক্ষ্যে এখনও আমরা পৌঁছাইনি। জনগণকে ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। মানুষের উপর মানুষের শোষণ, অঞ্চলের উপর অঞ্চলের শোষণের অবসান ঘটাতেই হবে।......আজকে জাতীয় সঙ্কটের প্রধান কারণ দেশবাসী রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত, দ্বিতীয়ত জনগণের এক সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বৈষম্যের কবলে পতিত, তৃতীয়ত অঞ্চলে অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্যের জন্য সীমাহীন অবিচারের উপলব্ধি জমেছে। প্রথমত এগুলি বঙালিদের ক্ষোভ ও অসন্তোষের কারণ।........”
১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বর সমগ্র পাকিস্তানে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে দেখা যায় শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ (পূর্ব পাকিস্তান) থেকে কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক উভয় পরিষদেই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। বাংলাদেশের প্রায় সব কটি আসন পায় আওয়ামীলীগ। পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় জুলফিকার আলী ভূট্টোর পিপলস পার্টি।
পূর্ব পাকিস্তানের কোটার ২ টি আসন ছাড়া বাকি সবগুলোতে জয়ী হওয়ার জন্য জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠতাও অর্জন করে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনের ফলাফল পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে মেরুকরণ সৃষ্টি করে। পশ্চিম পাকিস্তানের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো, মুজিবের স্বায়ত্বশাসনের নীতির প্রবল বিরোধিতা করেন। ভুট্টো এ্যাসেম্বলি বয়কট করার হুমকি দিয়ে ঘোষণা দেন যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান মুজিবকে সরকার গঠনের জন্য আহ্বান জানালে তিনি সে সরকারকে মেনে নেবেন না।
উভয় পাকিস্তান মিলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায় আওয়ামীলীগই এককভাবে পাকিস্তানে সরকার গঠনে সক্ষম ছিলো। বঙ্গবন্ধুর বিপুল বিজয়ে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর টনক নড়ে উঠলো। তিনি যাতে ক্ষমতায় আসতে না পারেন সেজন্য পশ্চিম পাকিস্তানের পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভূট্টো প্রকাশ্যেই শেখ মুজবের বিরোধিতা করতে লাগলেন। ইয়াহিয়াও চাচ্ছিলেন না বাঙালি জাতির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে। তিনি মুখে শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী বলে ঘোষণা করলেও গোপনে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করতে লাগলেন। এই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্যস্থগিত ঘোষণা করা হয়। এতে বাঙালি জাতি হতবুদ্ধি হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু বুঝলেন পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকেরা সহজেই বাঙালীকে ক্ষমতায় যেতে দেবে না। মেনে নেবে না তাদের ন্যায্য অধিকার। স্বীকার করবে না তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার।
রাজনৈতিক অস্থিশীলতার মধ্যে ইয়াহিয়া খান সংসদ ডাকতে দেরি করছিলেন। বাঙালিরা এতে বুঝে ফেলে যে, মুজিবের দলকে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও সরকার গঠন করতে দেয়া হবে না। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় শেখ মুজিব স্বাধীনতার ডাক দেন এবং জনগণকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত করেন।বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে আন্দোলন গণসংগ্রামে রূপ নিলো। তিনি পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন। পথে-ঘাটে, কল-কারখানায়, স্কুল-কলেজে, অফিস-আদালতে ছড়িয়ে পড়লো এই অসহযোগ আন্দোলন। তিনি ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল জনসভায় তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠতম ভাষণ দিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে গণঅভ্যূত্থানের আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু এই ঐতিহাসিক জনসভায় পশ্চিম পাকস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংগ্রামের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা গ্রহণের নির্দেশ দিলেন। তিনি বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করলেন, “রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
এই ঘোষণার পর ইয়াহিয়া খান যেন আরও হিংস্র হয়ে উঠলেন। অস্ত্র প্রয়োগ করে বাঙালির আন্দোলনকে দমন করার কৌশল খুঁজতে লাগলেন। চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরে গোপনে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আনা অস্ত্র নামাতে লাগলেন। ছদ্মবেশে ও গোপনে জাহাজ ও প্লেন ভর্তি করে পাকিস্তানি সৈন্য আনতে লাগলেন বাঙালিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য। আর এ ষড়যনত্র যাতে বাঙালিরা টের না পায়, তার জন্য ইয়াহিয়া তারসাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে ঢাকায় এলেন শেখ মুজিবের সাথে আপোস আলোচনার ছলচাতুরী করতে। দিন কয়েক চললো আলোচনার নাটক। সবাইি রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে। কিনতু শেখ মুজব তাঁর দবিী থেকে এক পাও সরে এলেন না। ফলে আলোচনা ভেঙ্গে গেল। ইয়াহিয়া খান ১৯৭১, ২৫শে মার্চ বাঙালী হত্যার নির্দেশ দিয়ে ঢাকা ত্যাগ করলেন। সেদিন মধ্যরাত থেকে হিংস্র পাকবাহিনী ঢাকায় তাদের নারকীয়হত্যালীলা শুরু করলো।
ইয়াহিয়া খান সামরিক আইন জারি করেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং মুজিবসহ আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতাদের গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী রাজনৈতিক ও জনসাধারণের অসন্তোষ দমনে ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট শুরু করে। সামরিক বাহিনীর অভিযান শুরু হলে মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ধানমণ্ডির ৩২ নং বাড়ি থেকে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। মূল ঘোষণার অনুবাদ নিম্নরূপ:
"এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানাই, আপনারা যেখানেই থাকুন, আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান। বাংলাদেশের মাটি থেকে সর্বশেষ পাকিস্তানি সৈন্যটিকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত আপনাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক"।
২৫শে মার্চ রাতেই বঙ্গবন্ধুকে বন্দী করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়এবং ফয়সালাবাদের একটি জেলে কড়া নিরাপত্তায় রাখা হয়। পাকিস্তানি জেনারেল রহিমুদ্দিন খান মুজিবের মামলার পরিচালনা করেন। মামলার আসল কার্যপ্রণালী এবং রায় কখনোই জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয় নি। এ মামলাটি "লায়ালপুর ট্রায়াল" হিসাবে অভিহিত। যাওয়ার আগেই তিনি দিয়ে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাÑযা পরে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে সম্প্রচার হয়েছিল। শুরু হয়মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধু জাতির মাঝে অনুপস্থিত থাকা সত্ত্বেও তাঁর নামে তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সমগ্র বাঙালি জাতি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ১৯৭১ সালে ২৬শে মার্চ থেকে শুরু করে ১৯৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে মুক্তিযুদ্ধ।
১৯৭১ সালে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপ্রধান (President) ও সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক (Supreme Commander Of All The Armed Forces) ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর অনুপস্থিতিতে উপরাষ্ট্রপ্রধান (Vice President) সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান (Acting President) ও অস্থায়ী সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক (Acting Supreme Commander Of All The Armed Forces) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
বাংলাদেশের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে তাদের মহান নেতা শেখ মুজিবের নামে। তখনকার প্রতিটি বাঙালীর মুখে ছিল একটি মাত্র শ্লোগান “জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।”
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরিচালিত অভিযান অল্প সময়ের মধ্যেই হিংস্রতা ও তীব্র রক্তপাতে রূপ নেয়। রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালি বুদ্ধিজীবি, রাজনীতিবিদ ও ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দসহ সাধারণ মানুষকে আক্রমণ করে। বাঙালি ও অবাঙালি হিন্দুদেরকে লক্ষ্য করে বিশেষ অভিযানের কারণে সারা বছরজুড়ে প্রচুর হিন্দু জনগোষ্ঠী সীমান্ত অতিক্রম করে পার্শ্ববর্তী পশ্চিম বঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় আশ্রয় গ্রহণ করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ও পুলিশ রেজিমেণ্টে কর্মরত পূর্ব বাংলার সদস্যবৃন্দ দ্রুত বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং লীগ সদস্যবৃন্দ কলকাতায় তাজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্ব প্রবাসে বাংলাদেশ সরকার গঠন করে। পূর্ব পাকিস্তানে মুক্তি বাহিনীর নেতৃত্ব বড় রকমের বিদ্রোহ সংঘটিত হতে থাকে। আন্তর্জাতিক চাপ থাকা স্বত্ত্বেও পাকিস্তানি সরকার মুজিবকে ছেড়ে দিতে এবং তাঁর সাথে সমঝোতা করতে অস্বীকৃতি জানায়।
যুদ্ধবর্তী সময়ে মুজিবের পরিবারকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। তাঁর সন্তান শেখ কামাল মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানীর এডিসি এবং একজন গুরুত্বপূর্ণ অফিসার ছিলেন। মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তান বাহিনীর ভিতরে সংঘটিত যুদ্ধটিই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ নামে পরিচিত।
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা রাশিয়ার নৈতিক সহায়তায় এবং ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সহায়তায় বাংলাদেশকে স্বাধীন করে। পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালিদের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয়। ৯৫ হাজার সৈন্য নিয়ে জেনারেল নিয়াজী ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন এবং লীগ নেতৃবৃন্দ ঢাকায় ফিরে সরকার গঠন করেন। বঙ্গবন্ধু তখনো পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী। ইয়াহিয়া খান তাঁকে পাকিস্তানে ফাঁসি দেবার ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক বিশ্বের চাপে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।পাকিস্তানি শাসকবৃন্দ মুজিবকে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি মুক্তিদান করে। এরপর তিনি লণ্ডন হয়ে নতুন দিল্লিতে ফিরে আসেন এবং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী’র সাথে সাক্ষাতের পর জনসমক্ষে “ভারতের জনগণ, আমার জনগণের শ্রেষ্ঠ বন্ধু” বলে তাঁকে সাধুবাদ জানান। তিনি ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশে ফিরে আসেন। গান্ধীর সাথে সেদিন তিনি ঢাকায় জড়ো হওয়া প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের সামনে বক্তৃতা দেন।দেশে ফিরে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেন। তিি ন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তোলার জন্য নতুন সংগ্রাম শুরু করেন। তিনি বাংলাদেশের জন্য একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করে চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ঘোষণা করেনÑবাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা।
বাংলাদেশের শাসন
শেখ মুজিবর রহমান অল্পদিনের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন রাষ্ট্রপতি ছিলেন এবং পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭০-এ পূর্ব পাকিস্তান আইনসভার জন্য নির্বাচিত রাজনীতিবিদরা নতুন রাষ্ট্রের প্রথম সংসদ গঠন করেন। মুক্তিবাহিনী এবং অন্যান্য মিলিশিয়াদের নিয়ে নতুন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গঠিত হয়। তাঁরই অভিপ্রায়ক্রমে ১৭ মার্চ ১৯৭২ ভারতীয় বাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের ভূ-খণ্ড ত্যাগ করে।
যুদ্ধ বিধ্বস্থ দেশের প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণ করেন। টাইম ম্যাগাজিন ইউএসএ ১৭ জানুয়ারি ১৯৭২ ভাষায়
গত মার্চে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পর বিশ্বব্যাংকের পরিদর্শকদের একটি বিশেষ টিম কিছু শহর প্রদক্ষিণ করে বলেছিলেন, ওগুলোকে দেখতে ভুতুড়ে নগরী মনে হয়। এরপর থেকে যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত এহেন ধ্বংসলীলার ক্ষান্তি নেই। ৬০ লাখ ঘরবাড়ি মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং ২৪ লাখ কৃষক পরিবারের কাছে জমি চাষের মতো গরু বা উপকরণও নেই। পরিবহনব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। রাস্তাঘাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, পুল-কালভার্টের চিহ্নও নেই এবং অভ্যন্তরীণ নৌ-যোগাযোগেও অনেক বাধাবিঘ্ন। এক মাস আগে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ পর্যন্ত দেশের ওপর নির্বিচার বলাৎকার চলেছে। যুদ্ধের শেষদিকে পাকিস্তানি মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো (কার্যত প্রতিটি ব্যবসা ক্ষেত্রই পাকিস্তানিদের দখলে ছিল) তাদের সব অর্থ-সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার করে দেয়। যুদ্ধ শেষে চট্টগ্রামে পাকিস্তান বিমানের অ্যাকাউন্টে মাত্র ১১৭ রুপি জমা পাওয়া গিয়েছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ব্যাংক নোট ও কয়েনগুলো ধ্বংস করে দেয়। ফলে সাধারণ মানুষ নগদ টাকার প্রকট সংকটে পড়ে। রাস্তা থেকে প্রাইভেটকারগুলো তুলে নেওয়া হয়, গাড়ির ডিলারদের কাছে থাকা গাড়িগুলো নিয়ে নেওয়া হয় এবং এগুলো নৌবন্দর বন্ধ হওয়ার আগমুহূর্তে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার করে দেওয়া হয়।
বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে স্বীকৃতি লাভের পর শেখ মুজিব পাকিস্তান, ওআইসি, জাতিসংঘ ও জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলনে বাংলাদেশের সদস্যপদ নিশ্চিত করেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে ভ্রমণ করে বাংলাদেশের জন্য মানবীয় ও উন্নয়নকল্পের জন্য সহযোগিতা চান। তিনি ভারতের সাথে একটি ২৫ বছর মেয়াদী মিত্রতা চুক্তি স্বাক্ষর করেন যাতে অর্থনৈতিক ও মানব সম্পদ উন্নয়নে ব্যাপক সাহায্যের আশ্বাস দেয়া হয়। চুক্তিতে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী ও সরকারি কর্কমর্তাদের প্রশিক্ষণের শর্ত অন্তর্ভুত ছিল। মুজিব ইন্দিরা গান্ধির সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখেন। মুজিবের জীবদ্দশায় দুই সরকারের মধ্যে পারষ্পরিক সমঝোতা ছিল।
মুজিব তাঁর অন্তর্বর্তী সংসদকে একটি নতুন সংবিধান রচনার দায়িত্ব দেন এবং চারটি মূলনীতি হিসেবে “জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র” ঘোষণা করেন যা মুজিববাদ নামেও পরিচিত। মুজিব শতাধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও কোম্পানি রাষ্ট্রীয়করণ করেন এবং ভূমি ও মূলধন বাজেয়াপ্ত করে ভূমি পূনর্বণ্টনের মাধ্যমে কৃষকদের সাহায্যের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধ কালে ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী ১ কোটি শরণার্থীর পূনর্বাসনের জন্য বড় পদক্ষেপ নেয়া হয়। এর ফলে অর্থনৈতিক সঙ্কট হ্রাস পেতে শুরু করে এবং সমূহ দুর্ভিক্ষ এড়ানো সম্ভব হয়।১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে সংবিধান অনুমোদিত হয়। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর থেকে নতুন সংবিধান কার্যকর করা হয় এবং ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে শেখ মুজিব ও তাঁর দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং তিনি বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচিত সরকার গঠন করেন। তিনি প্রাথমিক শিক্ষা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা, খাদ্য, স্বাস্থ্য, পানি ও বিদ্যুত সরবরাহ নিশ্চিতকল্পে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের বিস্তৃতি ঘটান। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে প্রণীত বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চ বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় কৃষি, গ্রামীণ অবকাঠামো ও কুটির শিল্প উন্নয়নে প্রাগ্রাধিকারমূলক সরকারি অর্থ বরাদ্দের নির্দেশ দেয়া হয়।
ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা থাকা স্বত্ত্বেও মুজিব ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ইসলামি অনুশাসনের পথে অগ্রসর হন। তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে আঁতাতের অভিযোগে ১৯৭২ সালে নিষিদ্ধ ঘোষিত ইসলামিক একাডেমি পুনরায় চালু করেন। ইসলামিক গোত্রগুলোর জোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মদ তৈরি ও বিপণন এবং জুয়া খেলা নিষিদ্ধ করেন।তাঁরই সিদ্ধান্তক্রমে বাংলাদেশ অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কনফারেন্স ও ইসলামিক ডেভেলপমেণ্ট ব্যাংক-এর সদস্যপদ গ্রহণ করে। মুজিব ১৯৭৪ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ওআইসি সম্মেলনে যোগ দিতে যান যা পাকিস্তানের সাথে কিছুমাত্রায় সম্পর্ক উন্নয়ন ও পাকিস্তানের স্বীকৃতি পেতে সহায়তা করে। জনসাধারণের সামনে উপস্থিতি ও ভাষণের সময় শেখ মুজিব ইসলামিক সম্ভাষণ ও শ্লোগান ব্যবহার বাড়িয়ে দেন এবং ইসলামিক আদর্শের উল্লেখ করতে থাকেন। শেষ বছরগুলোতে মুজিব তাঁর স্বভাবসুলভ “জয় বাংলা” অভিবাদনের বদলে ধার্মিক মুসলিমদের পছন্দনীয় “খোদা হাফেজ” বলতেন।
বঙ্গবন্ধু তাঁর তিন বছরের শাসনামলে যেসব যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষাকে বাদ্যতামূলক করা, পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত বিনামূল্যে বই এবং গরীব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে পোশাক প্রদান, ইসলাম বিরোদী কাজ বিবেচনা করে রমনা রেসকোর্স ময়দানে ঘোড়দৌঁড় নিষিদ্ধ করা, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা, টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমার জন্য জমি বরাদ্দ করা, মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে মুক্তিযোদ্:ধা কল্যাণ ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করা, নারী পুনর্বাসন ও কল্যাণ ফাউণ্ডেশন প্রতিষ্ঠা করা, ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজ না মওকুফ এবং ১০০ বিঘা জমির সিলিং ধার্য করা, সামরিক একাডেমী প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি। এছাড়া বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ভারত থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা এবং তাঁকে নাগরিকত্ব প্রদান করা, সরকারী-বেসরকারী অফিস-আদালতসহ সবধরণের রাষ্ট্রীয় কাজে বাংলা ভাষা প্রচলন বাধ্যতামূলক করেন। তিনি ১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাসে যমুনা নদীর উপর সেতু নির্মাণের গুরুত্ব উপলব্ধি করে জাপান সরকারের কাছে ওই সেতু নির্মাণের প্রস্তাব করেন এবং তার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেনÑবর্তমান যা বাস্তব রূপলাভ করেছে।
তাঁর একান্ত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংস্থা তথা ঋউঈ এর জন্ম। তিনি ১৯৭৪ সালে জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেষনে প্রথম বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করেন এবং বাংলা ভাষোকে বিশ্বের দরবারে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেন।
যুদ্ধের পর বাংলাদেশ এক ধবংস¯তূপের ওপর দাঁড়িিেছল। রাস্তাঘাট, রেলপথ, মিল কলকারখানাসহ সবকিছু ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। ফােল যুদ্ধবিধ্বস্থ একটি দেশের পুনর্গঠন, পুনর্বাসন অত সহজ ছিল না। এদিকে ছিল বিভিন্নমুখী আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। ১৯৭৪ সালে ভয়াবহ বন্যার পর দেশে অন্ন, বস্ত্র এবং খাদ্যের প্রচণ্ড অভাব দেখা দেয়। তিনি এসব সমস্যা দূর করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। কিন্তু পরিসিথতি ছিল তাঁর প্রতিকূলে। বিশ্বব্যাপী তখন শুরু হয় মুদ্রাস্ফীতি। সেই মুদ্রাস্ফীতির ঢেউ এসে লাগে বাংলাদেশে। সেব নানা সীমাবদ্ধতার কারণে দেশ পরিচালনায় ব্যর্থ হন শেখ মুজিব।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজবুর রহমান এই অবস্থার প্রেক্ষাপটে দেশের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার উদ্দেশ্যে ১৯৭৫ সালের ২৪ মার্চ তিনি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী আনেন। দেশের সকল রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে “বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামীলীগ” বা “বাকশাল” গঠন করেন।এই সাথে তিনি তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লবের প্রাতিষ্ঠানিক রূপরেখা ঘোষণা করেন। ২ মাস পর ১৯৭৫ সালে ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় ভাষণে তিনি সেদিন বলেছিলেন-
“প্রেসিডিয়াম ফরম অব গভর্ণমেন্ট করেছি। জনগণ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবে। পার্লামেন্ট থাকবে। পার্লামেন্টের নির্বাচনে একজন, দুইজন, তিনজনকে নমিনেশন দেওয়া হবে। জনগণ বাছবে, কে ভাল, কে মন্দ। আমরা চাই শোষিতের গণতন্ত্র, আমরা চাই না শোষকের গণতন্ত্র।
বাকশাল:
স্বাধীনতা পর অচিরেই মুজিবের সরকারকে ক্রমশ বাড়তে থাকা অসন্তোষ সামাল দিতে হয়। তাঁর রাষ্ট্রীয়করণ ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল সমাজতন্ত্রের নীতি প্রশিক্ষিত জনবল, অদক্ষতা, মাত্রাতিরিক্ত দুর্নীতি আর দুর্বল নেতৃত্বের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মুজিব অতিমাত্রায় জাতীয় নীতিতে মনোনিবেশ করায় স্থানীয় সরকার প্রয়োজনীয় গুরুত্ব লাভে ব্যর্থ হয়। আওয়ামী লীগ ও কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ করায় গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে। এ সময় তৃণমূল পর্যায়ে কোন নির্বাচনই অনুষ্ঠিত হয় নি। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মধ্যে কমিউনিস্ট এবং ইসলামি মৌলবাদীরা অন্তর্ভুক্ত ছিল। বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ঘোষণা করায় ইসলামিক গোত্রের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। এ ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ পদে আপনজনদের নিয়োগ দেয়ার জন্য মুজিবের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ আনা হয়। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ খাদ্য সংকট আরো বাড়িয়ে দেয় এবং অর্থনীতির প্রধান উত্স কৃষিকে ধ্বংশ করে ফেলে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাব, দ্রব্যমূল্যের অসামঞ্জস্যতা, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যর্থতার কারণে মুজিবকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়।
রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সংঘাতের মাত্রা বাড়তে থাকায় মুজিবও তাঁর ক্ষমতা বাড়াতে থাকেন। ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর মুজিব জরুরি অবস্থা জারি করেন.
১৯৭৫ এ কয়েকটি দল মিলে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ নামের রাজনৈতিক দল গঠন করে। সংক্ষেপে বাকশাল নামে পরিচিত .এই নতুন ব্যবস্থায় প্রেসিডেন্ট সরাসরি নির্বাচিত হবে ,একটি নির্বাচিত সংসদ আইন পাস করতে পারেন,
বাকশাল বিরোধী রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ৪টি বাদে সকল সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করা হয়। দলটি প্রত্যন্ত জনসাধারণ, কৃষক ও শ্রমিকদের প্রতিনিধি হিসেবে নিজেদের বিবেচিত করে রাষ্ট্রযন্ত্রের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে। দলটি বৃহৎ সমাজতান্ত্রিক কর্মকাণ্ড গ্রহণ করে। সরকারি বাহিনীর সাথে সমর্থকদের নিয়ে গঠিত জাতীয় রক্ষী বাহিনীর সহায়তায় মুজিব বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার করেন এবং সারাদেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের উপর কড়া নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেন। রক্ষী বাহিনী এবং পুলিশের বিরুদ্ধে অত্যাচার ও রাজনৈতিক হত্যার অভিযোগ ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারীরা মুজিবের উপর অসন্তুষ্ট হয়ে ওঠেন এবং তাঁর কর্মকাণ্ডকে গণতন্ত্র ও নাগরিক অধিকারবিরোধী বলে গণ্য করেন। মুজিবের বিরোধীরা অসন্তোষ ও সরকারের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে একত্রিত হয়ে ওঠে।কিন্তু তার এই নীতির ফলে অবস্থা কিছুটা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং দুর্নীতি,কালোবাজারী এবং অবৈধ মজুদদারি অনেকাংশে বন্ধ হয়ে যায়।
সংগ্রামের স্বীকৃতি
১৯৭৩ সালের ৭ই মার্চ বাঙালি জাতির প্রাণপুরুষ, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে তাঁর সংগ্রামের স্বীকৃতি দিয়ে এবং বিশ্বমানবতার ক্ষেত্রে বিশ্বশান্তি পরিষদ তাঁকে “জুলিও কুরি” পদকে ভূষিত করে।
হত্যাকাণ্ড
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট প্রত্যূষে একদল তরুণ সেনা কর্মকর্তা ট্যাঙ্ক দিয়ে রাষ্ট্রপতির ধানমণ্ডিস্থ বাসভবন ঘিরে ফেলে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর পরিবার এবং তাঁর ব্যক্তিগত কর্মচারীদের হত্যা করে। কেবল তাঁর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করার কারণে হত্যাযজ্ঞ থেকে সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান । তাদের বাংলাদেশে ফিরে আসার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। সেনা অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেন বিক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগের সদস্য এবং সামরিক কর্মকর্তারা। এদের মধ্যে ছিলেন শেখ মুজিবের প্রাক্তন সহকর্মী খন্দকার মোশতাক আহমেদ, যিনি তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন.
সংকীর্ন রাজনৈতিক দৃষ্টিভংগীর অধিকারী খন্দকারকে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক,পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ চর বলে ও সন্দেহ করেন । পাকিস্তানের ভুট্টো সরকারই প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছে এই নতুন সরকারকে
২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৫ তারিখে মুজিব হত্যাকাণ্ডের বিচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে খন্দকার মোশতাক সরকার ইমডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করেন এবং জেনারেল জিয়াউর রহমান ও পাকিস্তানপন্থী প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে তার বৈধতা দেয়া হয়। যা ১২ অগাস্ট, ১৯৯৬ তারিখে সংসদে রহিত করা হয়।। সংবাদ মাধ্যমে এ হত্যা কান্ডের ইন্ধনদাতা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সেণ্ট্রাল ইণ্টেলিজেন্স এজেন্সি সিআইএ-কে দায়ী করা হয়।বাংলাদেশে অবস্থিত তৎকালীন রাষ্ট্রদুত ইউজিন দিয়ে লরেন্স লিফসুল্জ সিআইএ-কে অভ্যুত্থান ও গণহত্যার জন্য দোষারোপ করেন। তাঁর মরদেহ তাঁর জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়ায় হেলিকপ্টারে করে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সামরিক তত্ত্বাবধানে দাফন করা হয়। অন্যান্যদের ঢাকার বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়।
মুজিবের মৃত্যু বাংলাদেশকে বহু বছরের রাজনৈতিক সংঘাতের দিকে টেনে নেয়। সেনাঅভ্যুত্থানের নেতারা অল্পদিনের মধ্যেই উচ্ছেদ হয়ে যান এবং অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থান আর রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডে দেশ অচল হয়ে পড়ে। ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর আরেকটি সেনা অভ্যুত্থানের ফলশ্রতিতে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতা আসীন হয়।
সেনাঅভ্যুত্থানের অন্যতম প্রধান নেতা কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমানসহ ১৪ জন সেনা কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়। বাকিরা বিদেশে পালিয়ে গিয়েছিলেন।
সমালোচনা ও কৃতিত্ব
কিছু কিছু ঐতিহাসিকদের মতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ভিতরের সংঘাত ও বৈষম্যগুলোকে শেখ মুজিবও তাঁর দল অতিরঞ্জিত করেছিল এবং স্বাধীনতা বাংলাদেশকে শিল্প ও মানবসম্পদের ক্ষেত্রে ক্ষতির সম্মুখীন করে। সৌদি আরব ও চীনা সরকার শেখ মুজিবের সমালোচনা করে এবং মুজিবের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অনেক দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি।
অনেক ইতিহাসবিদ মুজিবকে বিদ্রোহে মদদদাতা নেতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং তাঁদের মতে তিনি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে প্ররোচিত করলেও রাষ্ট্র পরিচালনায় অদক্ষ হিসেবে উল্লেখ করেন। বাংলাদেশের নেতা হিসেবে শাসনকালে, মুসলিম ধর্মীয় নেতারা মুজিবের তীব্র সমালোচনা করেন তাঁর ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির কারণে। ভারতীয় সরকারের কাছ থেকে ব্যাপক সহযোগিতা গ্রহণ এবং গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক ও পররাষ্ট্রনীতিতে ভারতের সাথে একাত্মতার কারণে অনেকে মুজিবের উপর অসন্তুষ্ট হয়ে ওঠেন। সমালোচকদের অনেকে আশঙ্কা করেন বাংলাদেশ ভারতের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে একটি স্যাটেলাইট রাষ্ট্রে পরিণত হবে।মুজিবের একদলের শাসন এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের দমন জনগণের একটি বড় অংশের অসন্তোষের কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং বাংলাদেশের বহুদলীয় গণতন্ত্রের চর্চাকে দীর্ঘসময়ের জন্য কক্ষচ্যুত করে।
১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ পুনরায় ক্ষমতায় যাওয়ার পূর্বে মুজিবের মৃত্যুর পরবর্তী সরকারগুলোর মুজিব বিরোধিতার কারণে তাঁর সম্পর্কে জনমনে নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হয়। তাঁর ভাবমূর্তি আবার ফিরে আসে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ নির্বাচিত হয়ে ফিরে আসার পর। ১৫ আগস্টকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করা হয়। তিনি এখনো আওয়ামী লীগের আদর্শগত প্রতীক হয়ে আছেন এবং দলটি মুজিবের সমাজতান্ত্রিক ভাবধারা ধারণ করে চলেছে। মুজিব বাংলাদেশ, ভারত ও বিশ্বের বাঙালি বুদ্ধিজীবিদের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং পাকিস্তানের গোষ্ঠীগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বাঙালিদের আন্দোলনকে স্বাধীনতার পথে ধাবিত করার জন্য তিনি ব্যাপকভাবে প্রশংসিত।
২০০৪ সালে বিবিসি'র বাংলা রেডিও সার্ভিসের পক্ষ থেকে সারা বিশ্বে যে জরিপ চালানো হয়, তাতে মুজিব সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে বিবেচিত হন।
টাইম সাময়িকী ইউএসএ ভাষায় (১৫ আগষ্ট ১৯৭৫ মুজিব। স্থপতির মৃত্যু)
তাঁর প্রশংসনীয় উদ্যোগঃস্বাধীনতার পরের তিনবছরে ৬ হাজারের ও বেশি রাজনৈতিক হত্যাকান্ড ঘটে । সহিংসতা সারাদেশব্যাপি ছড়িয়ে পরার আশঙ্কা তৈরী হলে মুজিব রাষ্ট্রীয় জরুরী অবস্থা ঘোষনা করেন । চরমবাম ও চরম ডানপন্থী সংগঠনগুলো নিষিদ্ধ করা হয়, পত্রিকাগুলোকে নিয়ে আসা হয় সরকারী নিয়ন্ত্রনে এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয় ।এ উদ্যোগগুলো বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে গৃহীত হলেও অনেকেই সমালোচনামুখর হয়ে উঠেন । সমালোচকদের উদ্দেশ্যে মুজিব তার স্বভাবসুলভ ভংগীতে বলেনঃ-'ভুলে যেওনা আমি মাত্র তিনবছর সময় পেয়েছি । এই সময়ের মধ্যে তোমরা কোনো দৈব পরিবর্তন আশা করতে পারোনা' ।যদি ও শেষ সময়ে তিনি নিজেই হতাশ ও বিরক্ত হয়ে কোন দৈব পরিবর্তন ঘটানোর জন্য অধৈর্য্য হয়ে পড়েছিলেন ।সন্দেহাতীতভাবেই মুজিবের উদ্দেশ্য ছিলো তার দেশ ও দেশের মানুষের উন্নয়ন ঘটানো । শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মুজিব একটা 'সোনার বাংলা' গড়তে চেয়েছিলেন, যে 'সোনার বাংলা'র উপমা তিনি পেয়েছিলেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে, ভালোবেসে মুজিব সেই 'সোনার বাংলা'র স্বপ্নকে তার দেশের জাতীয় সংগীত নির্বাচন করেছিলেন।
১৯৬৫ সালে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় নামে একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়।
উনবিংশ শতাব্দীতে শেখ মুজিব সড়ক নামে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম শহরের আগ্রাবাদের একটি প্রধান বাণিজ্যিক সড়কের নামকরণ করা হয়।
২০১৭ সালে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির একটি সড়কের নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মার্গ নামকরণ করা হয়। কনট প্লেসের নিকটবর্তী স্থানটি ইতোপূর্বে পার্ক স্ট্রিট নামে পরিচিত ছিল।