সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ভাষণ

-মোহাম্মদ শাহজাহান
বছর ঘুরে আবার এসেছে মার্চ মাস। মার্চ মাস বাঙালির স্বাধীনতার মাস। ১৯৭১-এর ৭ মার্চ বাঙালি জাতির মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর জগৎ বিখ্যাত ঐতিহাসিক ভাষণে সাড়ে ৭ কোটি মানুষকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করেন। বিলম্বে হলেও ২০১৭ সালে ইউনেস্কো ৭ মার্চের ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সেই হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণটি এখন বিশ্ববাসীর সম্পদ। আসলে ৭ মার্চের ভাষণকে স্বীকৃতি দিয়ে ইউনেস্কোই সম্মানিত হয়েছে। ৭ মার্চের ভাষণটি ছিল আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা। ১৫ মার্চ ১৯৭১ সালে ৩৫ দফা নির্দেশ জারি করে শেখ মুজিব বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৭১-এর ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত মুজিবের নির্দেশেই বাংলাদেশ পরিচালিত হয়েছে। ৭ মার্চ পাকিস্তানের বিলুপ্তি এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। ওই ভাষণে মহান নেতা মুজিব পুলিশ, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, বেতার, টিভিসহ জনগণকে তাঁর নির্দেশ ছাড়া অন্য কারো নির্দেশ মানতে নিষেধ করেন। স্বাধীন দেশের সরকার প্রধানের মতো মুজিব বলেন, ‘খাজনা, ট্যাক্স বন্ধ করে দেয়া হলো, কেউ দেবে না। কর্মচারীরা ২৮ তারিখ গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন।’ ৭ মার্চ ভাষণের পর বঙ্গবন্ধু মুজিব ৩২ নম্বর বাসভবনে বিবিসির আতাউস সামাদকে বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন স্বাধীন, তোমরা এই স্বাধীনতা রক্ষা করো।’ ঐতিহাসিকরা একদিন লিখবেন, ‘১ মার্চ থেকে ২৫ দিন বাংলাদেশ স্বাধীন ছিল। ২৫ মার্চ পাকি হানাদার বাহিনী দেশ দখল করে নেয়। মুজিবের নেতৃত্বে বাংলার মানুষ ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে দখলদার পাকি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে ১৬ ডিসেম্বর দেশ মুক্ত করে।’ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নিরাপত্তা উপদেষ্টা পরবর্তীকালে সে দেশের প্রভাবশালী পররাষ্ট্র সচিব (মন্ত্রী) ড. হেনরি কিসিঞ্জার বলেছেন, ‘মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণ স্বাধীনতা ঘোষণার নামান্তর।’
১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘৭ মার্চ কি স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা বলা বাকি ছিল? প্রকৃতপক্ষে ঐদিনই স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছিল। সেদিন পরিষ্কার বলা হয়েছিল, এবারের সংগ্রামÑ স্বাধীনতার সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব তিনি বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষকে তাঁর নেতৃত্বে স্বাধীনতার জন্য ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। সেদিন পিয়ন থেকে হাইকোর্টের বিচারপতি পর্যন্ত মুজিবের ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন। ৭ মার্চ ঢাকায় আসা জে. টিক্কা খানকে সে সময় বিচারপতি বিএ সিদ্দিকী গভর্নর হিসেবে শপথ গ্রহণ করাননি।
বঙ্গবন্ধু তাঁর ৫৫ বছরের জীবনে শত শত ভাষণ দিয়েছেন। কিন্তু ৭ মার্চের ভাষণ শুধু বঙ্গবন্ধুর জীবনের শ্রেষ্ঠ ভাষণ নয়, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণের একটি হিসেবে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। পাকিস্তানের জেনারেলরা পর্যন্ত বলেছেন, ‘প্রকৃতপক্ষে ৭ মার্চই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়।’ ১৮ মিনিটের ওই ভাষণটির প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি চরণ দিয়ে একটি আলাদা প্রবন্ধ লেখা যেতে পারে। এমন উত্তেজনাপূর্ণ বিপরীতমুখী পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমে যেভাবে বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করেছিলেন, এর কোনো তুলনা হয় না। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ তখন স্বাধীনতার জন্য উন্মুখ। যুব ও ছাত্রসমাজ এবং আওয়ামী লীগের কট্টরপন্থীরা চাচ্ছিল বঙ্গবন্ধু যেন রেসকোর্স ময়দানেই স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন। অন্যদিকে পাকিস্তান সামরিক জান্তার পক্ষ থেকে স্পষ্টভাবে শেখ মুজিবকে জানিয়ে দেয়া হয়Ñস্বাধীনতা ঘোষণা করার সাথে সাথে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেয়া হবে। এমনকি সেনানিবাস থেকে জনসভাকে লক্ষ্য করে কামান বসানো হয়েছিল। এমন জটিল পরিস্থিতিতে বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ নেতা তাঁর ৭ মার্চের ভাষণে সরাসরি স্বাধীনতা যেমন ঘোষণা করেননি, আবার তেমনি স্বাধীনতা ঘোষণার কিছু বাকিও রাখেননি। পাকিস্তানি কামান-বন্দুক, ট্যাংক, মেশিনগানের হুমকির মুখে বঙ্গশার্দুল শেখ মুজিব ঐদিন বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেনÑ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছুÑ আমি যদি হুকুম দিবার না-ও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। ... এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
কী পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু সেই ইতিহাস বিখ্যাত ভাষণ দিয়েছিলেন। ১৯৭০-এর ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ১৩টি মহিলা আসনসহ জাতীয় পরিষদে আসন সংখ্যা ছিল ৩১৩টি (৩০০ + ১৩ = ৩১৩)। এর মধ্যে অবিভক্ত পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলÑপূর্ব পাকিস্তানের আসন সংখ্যা ছিল ১৬৯টি (১৬২ + ৭ = ১৬৯)। ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯ আসনের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পায় ১৬৭টি আসন। ঐ নির্বাচনে বহু রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে। সামরিক আইনের অধীনে ঐ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে আওয়ামী লীগ ১৬৭টি আসন পাওয়ার পর বাকি ২টি আসন পায় পিডিপি।
শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ শুধু জাতীয় পরিষদে নয়, প্রাদেশিক পরিষদেও একচেটিয়াভাবে বিজয় অর্জন করে। ঐ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ পায় ২৮৮টি আসন। এ এক অবিশ্বাস্য স্মরণীয় বিজয়। ’৭০-এর জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা ৯৮ জন ভোটার শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেন। ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর তৎকালীন সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ’৭১-এর ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান করেন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের পিপিপি নেতা জেড এ ভুট্টো এবং পাকিস্তান সামরিক চক্র সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে অর্থাৎ আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে ষড়যন্ত্র শুরু করে। ষড়যন্ত্রকারীদের হাতের পুতুলে পরিণত হলেন সামরিক প্রেসিডেন্ট জেঃ ইয়াহিয়া খান। ’৭১-এর পহেলা মার্চ ১টা ৫ মিনিটে আকস্মিক এক বেতার ঘোষণায় ৩ মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হয়।
জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত হওয়ার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে গর্জে উঠে বাংলাদেশ (পূর্ব পাকিস্তান)। বেতারের ঘোষণা শুনে রাস্তায় নেমে আসেন লাখো মানুষ। সে সময় ঢাকায় হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী কমিটির বৈঠক চলছিল। হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ মানুষ নেতার নির্দেশের জন্য মিছিল সহকারে হোটেল পূর্বাণীতে সমবেত হন। জনতাকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ ঢাকাসহ সারাদেশে হরতাল আহবান করেন।
২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় ছাত্রলীগের সভা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। ঐ সভায় প্রথমবারের মতো স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা দেখা যায়। লাল-সবুজের এই পতাকায় হলুদ রঙে বাংলাদেশের মানচিত্র ছিলো। স্বাধীনতার পর জাতীয় পতাকায় দেশের মানচিত্র না রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ৩ মার্চ বুধবার পল্টনে ছাত্রলীগের সভায় অনির্ধারিতভাবে বঙ্গবন্ধু উপস্থিত হন। ঐ সভায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ছিল দৃশ্যমান। বঙ্গবন্ধুকে তাঁর উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতির পিতা ঘোষণা করে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন পদাধিকারবলে ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ। পল্টনে ছাত্রলীগের এই সভায় বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করা হয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলাÑ আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানকে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত নির্ধারণ করা হয়। সভায় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্তও গ্রহণ করা হয়।
পল্টনে ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগের সভায় প্রধান অতিথি বঙ্গবন্ধু আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেন, “আমি থাকি আর না থাকি, বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন যেন থেমে না থাকে। বাঙালির রক্ত যেনো বৃথা না যায়। আমি না থাকলেÑ আমার সহকর্মীরা নেতৃত্ব দিবেন। তাদেরও যদি হত্যা করা হয়, যিনি জীবিত থাকবেন, তিনিই নেতৃত্ব দিবেন। যে কোনো মূল্যে আন্দোলন চালাইয়া যেতে হবেÑ অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।”
বঙ্গবন্ধু আগেই ঘোষণা করেছিলেন, ৭ মার্চ রোববার রেসকোর্স ময়দানে তিনি পরবর্তী কর্মপন্থা ঘোষণা করবেন। ৪ মার্চ থেকে ৬ মার্চ সকাল ৬টা থেকে ২টা পর্যন্ত সারা দেশে হরতাল পালনের আহ্বান জানান বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দুর্বার গতিতে আন্দোলন এগিয়ে চললো। সারাদেশে তখন একজন মাত্র নেতা। তিনি হচ্ছেন দেশের শতকরা ৯৮ জন মানুষের ভোটে নির্বাচিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশে সামরিক শাসন চালু থাকলেও সামরিক সরকারের কথা তখন কেউ শুনছে না। শেখ মুজিবের কথাই তখন আইন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সমগ্র বাংলাদেশ পরিচালিত হচ্ছে। সেই আন্দোলনমুখর পরিস্থিতিতে ঘনিয়ে আসলো ৭ মার্চ। সবার দৃষ্টি ৭ মার্চের দিকে। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে কি বলবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ভাবিয়ে তুললো পাকিস্তান সামরিক চক্রকেও। কারণ তারা বুঝে গেছে, বাংলাদেশের মানুষের উপর তাদের আর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। দেশ পরিচালিত হচ্ছে বিরোধী দলের নেতা শেখ মুজিবের কথায়।
এই অবস্থায় ৭ মার্চ শেখ মুজিব যদি রেসকোর্সের জনসভায় স্বাধীনতা ঘোষণা করে বসেন। চিন্তিত পাকিস্তান সামরিক চক্র কৌশলের আশ্রয় নিলেন। ৭ মার্চের একদিন আগে অর্থাৎ ৬ মার্চ জে. ইয়াহিয়া খান টেলিফোনে কথা বলেন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা, আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে। পূর্ব পাকিস্তান সামরিক সরকারের তৎকালীন তথ্য কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিকের ‘Witness to Surrender’ গ্রন্থে এসব তথ্য রয়েছে। ৬ মার্চ জেঃ ইয়াহিয়া কি বলেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানকে? ৭ মার্চের পূর্ব রাতে জেঃ ইয়াহিয়া টেলিপ্রিন্টারে শেখ মুজিবের কাছে একটি বার্তাও প্রেরণ করেন। সালিকের গ্রন্থে রয়েছেÑ একজন ব্রিগেডিয়ার জেঃ ইয়াহিয়ার সেই বার্তা মধ্য রাতে শেখ মুজিবের ৩২ নম্বরের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসেন।
৬ মার্চ জেঃ ইয়াহিয়া তাঁর দীর্ঘ টেলিফোন আলাপে আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বলার চেষ্টা করেন, ‘তিনি (বঙ্গবন্ধু) যেনো এমন কোনো কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করেন, যেখান থেকে ফিরে আসার উপায় আর না থাকে।’ মেজর সালিক ঐ বার্তাটি সংক্ষিপ্ত আকারে তার ডায়েরীতে লিখে রেখেছিলেন। বার্তায় জেঃ ইয়াহিয়া শেখ মুজিবকে অনুরোধ করেন, “অনুগ্রহ করে কোনো দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবেন না। আমি সহসাই ঢাকা আসছি এবং আপনার সাথে বিস্তারিত আলোচনা করবো। আমি আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আমি আপনার আকাক্সক্ষা এবং জনগণের প্রতি দেয়া আপনার প্রতিশ্রুতির পুরোপুরি মর্যাদা দেবো। আমার কাছে একটি পরিকল্পনা আছেÑ যা আপনাকে আপনার ছয় দফা থেকেও বেশি খুশী করবে। আমি সনির্বন্ধ অনুরোধ করছি, কোনো দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবেন না।” (সূত্র :Witness to Surrender) ৬ মার্চ টেলিফোনে বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনা, টেলিপ্রিন্টারে বঙ্গবন্ধুর কাছে বার্তা প্রেরণ করেও পুরোপুরি স্বস্তি পাচ্ছিলেন না জেঃ ইয়াহিয়া। ৬ মার্চ এও ঘোষণা করা হলো যে, ২৫ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে।
৭ মার্চ রেসকোর্সে জনসভার বক্তব্য কি হবেÑ এই নিয়ে ৬ মার্চ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির দীর্ঘ বৈঠক হয়। জনসভায় বঙ্গবন্ধু কি বলবেনÑ এ নিয়ে বিভিন্নজন বক্তব্য রাখেন। একপক্ষের মত, বঙ্গবন্ধু যেনো জনসভায় সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন। অন্য পক্ষ স্বাধীনতার সরাসরি ঘোষণা পরিহার করে আলোচনার পথ খোলা রাখার পক্ষে মত প্রদান করেন। সভা ৭ মার্চ সকাল পর্যন্ত মুলতবী রইলো। ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগের চরমপন্থীরা বিভিন্নভাবে চাপ দিচ্ছিলেন বঙ্গবন্ধুকে ৭ মার্চের জনসভায় স্বাধীনতা ঘোষণা করার জন্যে।
পরিস্থিতির চাপে ভীত-সন্ত্রস্ত পূর্ব পাকিস্তান সামরিক সদর দফতর থেকে বিভিন্নভাবে শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগকে এই মেসেজ দেওয়া হয় যে, ৭ মার্চ যেনো কোনোভাবেই স্বাধীনতা ঘোষণা না করা হয়। ৭ মার্চ জনসভাকে তাক করে কামান বসানোসহ আধুনিক অস্ত্র-সস্ত্র প্রস্তুত রাখা হয়। মেজর সিদ্দিক সালিক তার গ্রন্থে লিখেছেন, পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি মেজর জেনারেল খাদেম হোসেন রাজা ৭ মার্চের জনসভার প্রাক্কালে আওয়ামী লীগ নেতাকে স্পষ্ট জানিয়ে দেন, “পাকিস্তানের সংহতির বিরুদ্ধে কোনো কথা বলা হলে তা শক্তভাবে মোকাবেলা করা হবে। বিশ্বাসঘাতকদের (বাঙালি) হত্যার জন্য ট্যাংক, কামান, মেশিনগান সবই প্রস্তুত রাখা হবে। প্রয়োজন হলে ঢাকাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হবে। শাসন করার জন্যে কেউ থাকবে না কিংবা শাসিত হওয়ার জন্যও কিছু থাকবে না।”
এমন এক কঠিন সংকটময় পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ৭ মার্চ রেসকোর্সে তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষকে চারটি শর্ত দিয়ে ভাষণের শেষাংশে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, “এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।” বঙ্গবন্ধুর ভাষণের কিছু অংশ ব্যাখ্যা করলে দেখা যায়, তিনি সেদিন যুদ্ধের ঘোষণা যেমন পরোক্ষভাবে প্রদান করেনÑ আবার যুদ্ধে কিভাবে জয়ী হতে হবে সে ব্যাপারেও বক্তব্য রাখেন। স্বাধীন দেশের সরকার প্রধানের মতো বঙ্গবন্ধু বলেন, “২৮ তারিখে কর্মচারীরা গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন।”
প্রকৃতপক্ষে ’৭১-এর পহেলা মার্চ থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে মুজিবের শাসন কায়েম হয়। যে জন্য তিনি বলতে পেরেছেন, ২৮ তারিখ কর্মচারীরা বেতন নিয়ে আসবেন। তিনি পাকিস্তানী শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলারও আহ্বান জানান। অনেকেরই আশঙ্কা ছিল বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলা হতে পারে। যে জন্য তিনি ঘোষণা করেন, আমি যদি হুকুম দেওয়ার নাও পারি তোমরা রাস্তাঘাট সবকিছু বন্ধ করে দিও। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলেও শত্রু পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যেনো যুদ্ধ অব্যাহত থাকেÑ ৭ মার্চের ভাষণে তাই তিনি বলেছেন। তাছাড়া ভাতে মারবো, পানিতে মারবোÑ এই কথার মাধ্যমে পাকিস্তানী বাহিনীকে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে পর্যুদস্ত করার কথাই বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সে সময় এমন ছিলো যে, কোনো কোনো বিদেশী পত্রিকাও তখন জানিয়েছিলÑ ৭ মার্চ শেখ মুজিব হয়তো পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। ’৭১-এর ৫ মার্চ লন্ডনের গার্ডিয়ান, সানডে টাইমস, দি অবজারভার এবং ৬ মার্চ ডেইলী টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ৭ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণার পূর্বাভাস দেয়া হয়। ৬ মার্চ ’৭১ লন্ডনের ডেইলী টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ছাপা হয় “East Pakistan UDI (Unilateral Declaration of Independence) Expected. Sheikh Mujibur Rahman expected to declare independence tomorrow. অর্থাৎ “শেখ মুজিবুর রহমান আগামীকাল (৭ মার্চ) পূর্ব পাকিস্তানের একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারেন।”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ’৭১-এর ৭ মার্চ সরাসরি কেন স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি, তার ব্যাখ্যা পরবর্তীকালে তিনি নিজেই দিয়েছেন। ১৯৭২ এর ১৮ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে এনডব্লিউ টিভির জন্য দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ৭ মার্চের ঐ কাহিনী বর্ণনা করে

SUMMARY

1899-4.jpg