১৬ মার্চ। ১৯৭১ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বৈঠক হয়। বৈঠকে বঙ্গবন্ধু সামরিক আইন প্রত্যাহার, বাঙালিদের ওপর গুলিবর্ষণ ও হত্যাকান্ড বন্ধসহ বিভিন্ন নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে এর জোরালো প্রতিবাদ জানিয়ে বিচার দাবি করেন। লাখো বাঙালি হত্যার প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে গাড়িতে কালো পতাকা উড়িয়ে বঙ্গবন্ধু অংশ নেন ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠকে। সকাল থেকেই উৎসুক জনতা অপেক্ষা করছিল বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়া বৈঠকের ফল কী হয় তা জানতে। সকাল ১০টায় শুরু হওয়া বৈঠকটি শেষ হয় বেলা ১২টা ৫০ মিনিটে। বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের জানান, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে ইয়াহিয়ার পক্ষ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি। বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়া বৈঠক চলছে, অন্যদিকে স্বাধীনতার প্রশ্নে আন্দোলন-সংগ্রামে পুরো পূর্ব পাকিস্তান কার্যতঃ অচল হয়ে পড়ে। পয়লা মার্চ থেকেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণ হারায় পূর্ব পাকিস্তানের ওপর। সামরিক জান্তার কোনো আদেশ-নির্দেশই মানছে না বীর বাঙালি। একমাত্র সেনা ছাউনি ছাড়া পাকিস্তানের অস্তিত্বই ছিল না কোনো জায়গায়। বরং গোটা পূর্ব পাকিস্তানের গ্রামে-গঞ্জে, পাড়া-মহল্লায়, শহর-বন্দরে পতপত করে উড়ছে বাংলাদেশের রক্তস্নাত জাতীয় পতাকা। পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট আলোচনার জন্য পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থান করলেও ভেতরে ভেতরে সামরিক জান্তারা ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে। কেননা, সামরিক জান্তারা বুঝতে পারে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার প্রশ্নে কোনো আপস করবেন না। তাই, আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করে ভেতরে ভেতরে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে পূর্ব পাকিস্তানে। প্রতিদিনই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও অস্ত্র-গোলাবারুদ আনা হয় পূর্ব পাকিস্তানে। তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব বিষয়টি আঁচ করতে পেরে তারাও গোপনে সারাদেশেই অস্ত্র-গোলাবারুদ সংগ্রহের মাধ্যমে সশস্ত্র প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। রক্তঝরা একাত্তরের এদিন শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের আলোচনার পাশাপাশি সারাদেশে আন্দোলন বাঁধভাঙা রূপ নিয়েছে। রাজপথ মিছিলে মিছিলে উত্তপ্ত করে সাধারণ মানুষজনও দেশের উদ্ভূত সমস্যার চূড়ান্ত সমাধানে বঙ্গবন্ধুর সর্বশেষ মন্তব্যের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। এরই মধ্যে ৩ মার্চ থেকে শুরু হওয়া অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জেও ছড়িয়ে পড়ে। মাঠে-ময়দানে সর্বত্রই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঘোষণা নিয়ে তোলপাড়। সারাদেশের অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ বন্ধ। সব সরকারি ভবন, হাটবাজার এমনকি পাড়া-মহল্লায়ও উড়ছে প্রতিবাদের কালো পতাকা। কোথাও কোথাও বাংলাদেশের নতুন পতাকাও উড়তে থাকে। মহল্লায় মহল্লায় গড়ে উঠতে থাকে সংগ্রাম কমিটি। সব বয়স, সব পেশা ও শ্রেণির মানুষ বেরিয়ে আসতে থাকে রাজপথে। স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত বঙ্গবন্ধুকে আরও উজ্জীবিত করতে রাস্তায়, মাঠে-ময়দানে তখন গণসঙ্গীত, নাটক, পথনাটক ও পথসভা করে চলছে উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, বেতার-টেলিভিশন শিল্পী সংসদ, মহিলা পরিষদ প্রভৃতি সংগঠন। হাইকোর্টের আইনজীবী, বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করতে থাকে। আর পূর্ব পাকিস্তানে আসা পাক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াও কঠোর নিরাপত্তার ঘেরাটোপে থাকলেও স্বাধীনতার প্রশ্নে বাঙালির বাঁধভাঙা সংগ্রাম ও প্রতিরোধের আঁচ ভালো করেই অনুভব করেন।