জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বের সেরা বক্তাদের অন্যতম হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। রাজনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতিসহ নানা ক্ষেত্রে বক্তাদের বক্তব্য পর্যালোচনা করে বিশেষজ্ঞরা এ স্বীকৃতি দান করেন। এ ধারায় কয়েক শ’ বছরের সেরা বক্তাদের তালিকায় রয়েছে বঙ্গবন্ধুর নাম। এছাড়া বঙ্গবন্ধুর সাফল্য, জীবন ও বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করে বিশেষজ্ঞরা তাকে প্রথম শ্রেণীর বক্তার মর্যাদা দিয়েছেন। বস্তুত গুণ, বুদ্ধিমত্তা, সাহস ও প্রজ্ঞা না থাকলে কোনো ব্যক্তিই ইতিহাসে উজ্জ্বল স্থান অধিকার করতে পারেনা। বঙ্গবন্ধুর এসব গুণাবলী আলোচনায় প্রথমেই তাঁর বাগ্মীতার দিকটি আলোচনায় আসে।
বাগ্মীতা বা চিত্তাকর্ষক বক্তৃতার দক্ষতা সকলের থাকেনা। অনেকে ভালো লিখতে পারেন কিন্তু জনসমাবেশে দাঁড়িয়ে কথা বলতে বিব্রত হয়ে পড়েন। পান্ডিত্য এবং বাকবৈদগ্ধও সব সময় একত্রিত হয় না। বক্তৃতার দক্ষতা বিশেষ একটি গুণ বা শিল্প। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাগ্মীতার মতো বিরল গুণের অধিকারী ছিলেন। ছিলেন প্রথম শ্রেণির সংগঠক। কথার প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও রাজনৈতিক দক্ষতার ফলেই তিনি বিপদ সংকুল পথ পাড়ি দিয়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম জাতির জনকের মর্যাদায় আজ আসীন।
বঙ্গবন্ধু সেই বৃটিশ আমলেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন। ছাত্রজীবন থেকেই শুরু। হাতে খড়ি হয় অবিভক্ত ভারতের রাজনৈতিক বিশেষ ব্যক্তিত্ব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কাছে। আর তখন থেকেই ছোট বড় সমাবেশে তাকে বক্তৃতা দিতে হয়। তার ছিল প্রখর অনুভূতি এবং পরিবেশ পরিস্থিতি অনুধাবনের বিশেষ ক্ষমতা। কণ্ঠও ছিল ওজস্বী। লেখার ভাষা আর বক্তৃতার ভাষা এক নয়। বক্তৃতার শ্রোতা থাকেন সাক্ষর নিরক্ষর। তাই ভাষায় থাকতে হয় সহজ সরলতা-যাতে সকলেই তা সহজে বুঝে। এমন চিত্তাকর্ষক ভাষা ও শব্দ চয়নে বঙ্গবন্ধু শ্রোতাদের হৃদয় জয় করে নিতে পারতেন। তার এই বাগ্মীতার ঐতিহাসিক ও উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত ১৯৭১ এর ৭ মার্চের ভাষণ-যা অনেকের মুখস্থ হয়ে আছে। এর আগেও পরেও বঙ্গবন্ধু যে সব ভাষণ দিয়েছেন-রাজনীতির অঙ্গনে তাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং হৃদয়গ্রাহী হিসেবে প্রশংসিত।
বঙ্গবন্ধু স্বতন্ত্র আবাসভূমির আন্দোলন, ১৯৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন কালে স্থানে স্থানে সফর করেছেন। সংগঠক হিসেবে, দলীয় নেতা হিসেবে মিশেছেন সকল স্তরের লোকের সঙ্গে। সভা সমাবেশে বক্তৃতা দিয়েছেন। বিশেষ করে ১৯৬৬ সালে ছয় দফা ঘোষণার পর তার বক্তৃতায় সর্তকতা ও শব্দ চয়নে বিশেষ পারদর্শিতা লক্ষ্য করা যায়। সে ছিল এক দ্বিমুখী সংকটকাল। বাঙালির অধিকার আদায়ে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা এবং একই সঙ্গে পাকিস্তানে রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগ থেকে আত্মরক্ষার জন্য তাকে সব সময় সতর্ক থাকতে হয়েছে। এর পরও সারাদেশে তিনি সফর করেছেন। একেক দিনে চার পাঁচটি সমাবেশেও তাকে বক্তৃতা দিতে হয়েছে। তিনি সতর্কই ছিলেন। তবু ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানী শাসকচক্র সাজায় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। গণ-আন্দোলনের মুখে সে মামলা তুলে নিতে হয়। বঙ্গবন্ধুসহ অভিযুক্তরা মুক্ত হন। আসে ১৯৭০ এর নির্বাচন। ততদিনে বঙ্গবন্ধু বাঙালির প্রাণপ্রিয় একক নেতার আসন গ্রহণ করে নিয়েছেন। তাঁর বক্তৃতায়ও এসেছে বেশি প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা। তাঁর প্রতিটি আহবানে জনগণ সাড়া দেয়, আন্দোলিত হয়। বাঙালির একক নেতা হিসেবে এমন জনপ্রিয়তা আর কেউ পাননি।
বঙ্গবন্ধুর এই জনপ্রিয়তার ফলেই বাঙালি ১৯৭০-এর নির্বাচনে তাঁর নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগকে ভোট দেয়। পাকিস্তান জাতীয় সংসদে লাভ করে সংখ্যাগরিষ্ঠতা। ইয়াহিয়া খান সংসদের অধিবেশন আহবান করেন। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠি বুঝতে পারে যে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বাঙালির হাতে চলে যাচ্ছে। শুরু করে ষড়যন্ত্র। ইয়াহিয়া-ভুট্টো মিলিত হন। সংসদের অধিবেশন স্থগিত করেন ইয়াহিয়া খান। ডিসেম্বরে নির্বাচনের পর ফেব্রুয়ারি মাসে অধিবেশন হওয়ার কথা ছিল। স্থগিত ঘোষণার পর জনগণ রাস্তায় নেমে আসে। বঙ্গবন্ধুকে নতুন নির্দেশ দিতে আহবান জানায়। মধ্যখানে ইয়াহিয়া-ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠকেরও প্রহসন করেন। ফল হয়নি। আসে সেই ঐতিহাসিক ৭ মার্চ ১৯৭১।
১৯৭১ সালে যোগাযোগ ব্যবস্থা আজকের মতো ছিল না। এরপরও ঐদিন দেশের নানা প্রান্তের মানুষ ছুটে যায় নির্ধারিত স্থান রেসকোর্স ময়দানে-যা বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নামে পরিচিত। বঙ্গবন্ধু আসবেন। বক্তৃতা দিবেন। মুক্তিকামী, স্বাধিকার আদায়ে নিবেদিতপ্রাণ জনগণকে দেবেন পথের দিশা। এই প্রত্যাশায় লোকারণ্য হয়ে ওঠে মাঠ। বঙ্গবন্ধু জানতেন, মানুষ আর আপোষ চায়না। চায় স্বাধীনতা। কিন্তু স্পষ্টভাবে নেতা যদি এ ঘোষণা দেন তাহলে সেটি হয়ে যাবে রাষ্ট্রদ্রোহিতা। এর পরিণাম তাৎক্ষণিকভাবেই হবে মারাত্মক। এই উভয় সংকটে বঙ্গবন্ধু এলেন মাঠে। ধীর পায়ে উঠলেন মঞ্চে। লক্ষ লক্ষ মানুষ উন্মুখ। সারা দেশ অধীর অপেক্ষায়। কবি নির্মলেন্দু গুণ বঙ্গবন্ধুর এই সময় ও ছবি নিয়ে চমৎকার কবিতাও লিখেছেন। বঙ্গবন্ধু ধীর ও গম্ভীর কণ্ঠে শুরু করলেন-বক্তৃতা। মাত্র ১৯ মিনিটের সেই বক্তৃতাতেই একটি জাতির ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেল। সে ছিল বিস্ময়কর এক কণ্ঠ। প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা, আবেগ, সাহস, দৃঢ়তা ও শব্দ চয়নে উৎকৃষ্ট এক ভাষণ। উত্তাল জনসমুদ্রে এক যুগসন্ধিক্ষণে দেওয়া সেই ভাষণ বিশ্বের শেষ্ঠ বক্তৃতার তালিকায় স্থান পেয়েছে। কঠিন সংকটে এত ভারসাম্যপূর্ণ বক্তৃতা সত্যই বিরল। কে ভুলতে পারে, সেই বাক্য ঃ রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ।’ এই বক্তৃতার প্রতিটি কথাই এমনি হৃদয়জয়ী। তাঁর ঐ বজ্রকণ্ঠের শেষ বাক্য ছিল ঃ এবাবের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
বক্তৃতা শেষ হতেই জয় বাংলা শ্লোগানে কেঁপে উঠেছিল সমগ্র ঢাকা। এই ঘোষণা এবং শ্লোগানের জোরেই ন’মাস যুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে আজ বাংলা স্বাধীন। দেশের ইতিহাসে তাই বঙ্গবন্ধুর বাগ্মীতা ও বজ্রকণ্ঠ স্মরণীয় হয়ে আছে।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক সিলেটের ডাক।