বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ, মানবতাবোধ ও রাজনৈতিক দর্শন


জিয়া আহমেদ 

১৭ই মার্চ ১৯২০ সালে শেখ লুৎফুর রহমান ও সায়রা খাতুনের কোল আলোকিত করে জন্ম যে মানবের, যার জন্য পূর্ব দিগন্তের উজ্জল আলোকরশ্মি ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন ভূখন্ডে, আজ সে রাষ্ট্রনায়কের ৯৯তম জন্মদিন। তরুণ প্রজন্ম বিশেষ করে যারা ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত তাদের জানা উচিত একজন দক্ষ ও সফল রাজনীতিবিদ হতে হলে কতটা কর্তব্যপরায়ন, পরিশ্রমী, পরিচ্ছন্ন ও সাংগঠনিক ক্ষমতা থাকতে হয়। একজন সাধারণ কর্মী থেকে রাষ্ট্রনায়ক হতে গেলে কতটা আত্মত্যাগ, মেধাবী ও মানুষের ভালোবাসার প্রার্থী হতে হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের সব গুণই ছিল তাই তিনি সফল রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়ক হয়েছেন। 
শামসুর রাহমান তার ধন্য সে পুরুষ কবিতায় যথার্থই বলেছেনÑ
ধন্য সে পুরুষ, যার নামের উপর রৌদ্র ঝরে / চিরকাল গান হয়ে / নেমে আসে শ্রাবণের বৃষ্টিধারা, যার নামের উপরে / কখনো ধুলো জমতে দেয় না হাওয়া। / ধন্য সে পুরুষ, যার নামের উপরে পাখা মেলে দেয় জ্যো¯œার সারস। / ধন্য সে পুরুষ, যার উপরে পতাকার মতো দুলতে থাকে স্বাধীনতা।
শেখ মুজিবের ১৯৪৮ সালের পরবর্তী অধ্যায় আমরা ভালোভাবে জানি, কিন্তু এর আগের সময়গুলোও কম গুরুত্ব ছিলনা তার রাজনীতিবিদ হয়ে উঠার পেছনে। কথা হচ্ছে আমরা বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ ও রাজনীতিক দর্শন বাস্তব জীবনে কতটুকু চর্চা করি। সবার কৌতুহল, আগ্রহ কেমন ছিল শেখ মুজিবের শৈশব, বেড়ে উঠা, ও রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া ইত্যাদি বিষয়গুলো। শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় তার গ্রামের স্কুলে, যা তারই দাদার প্রতিষ্ঠা করা ছিল। তার পর ৪র্থ থেকে ৭ম শ্রেণি পর্যন্ত কেটেছে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে। ১৯৩৪ সাল থেকে ১৯৩৬ সালের মধ্যে শেখ মুজিব ২ বার অসুস্থ হন, প্রথমে বেরিবেরি রোগ ও পরে গ্লুকোমায় আক্রান্ত হন। বাবার চাকরির কারণে মাদারিপুর গিয়ে ৭ম শ্রেণিতে আবার ভর্তি হন। কলকাতায় চোখ অপারেশনের পর থেকেই ৭ম শ্রেণি থেকে পড়াশোনা আবার শুরু করতে প্রায় বছর খানেক সময় লাগে। ঐ সময়ে শেখ মুজিব রাজনীতি নিয়ে ভাবনা শুরু করেন কারণ তখন স্বদেশি আন্দোলন চলছিল। শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিদিনকার রুটিন ছিল স্বদেশি আন্দোলনের সভায় যোগদান করা। কারণ উঠতি বয়সি যুবকদেরই তখন আন্দোলনকারীরা দলে ভিড়াত। শেখ মুজিব তখন সুভাষ চন্দ্র বসুর ভক্ত হয়ে পড়েন। স্বদেশি আন্দোলনের সভায় যোগদানের জন্য তিনি মাঝে মধ্যে গোপালগঞ্জÑমাদারিপুর যাতায়াত করতেন। এ জন্য স্বদেশি আন্দোলন বিরোধীরা শেখ মুজিবের নামে তাঁর দাদার কাছে অভিযোগও দিয়েছিলেন। শেখ মুজিব ১৯৩৭ সালে আবার পড়াশোনা শুরু করেন। গোপালগঞ্জে এসে মিশনারি হাই স্কুলে ভর্তি হন এবং তারই হাউজ টিউটর আব্দুল হামিদের “মুসলিম সেবা সমিতি” সংগঠনের সাথে যুক্ত হন। যাদের কাজ ছিল প্রত্যেক রবিবার মুষ্টির চাল উঠানো এবং তা বিক্রি করে এবং এই টাকা দিয়ে গরিব ছেলেদের সাহায্য করা। 
শেখ মুজিবের ছোটবেলা থেকেই সাংগঠনিক ক্ষমতা তোখুড় ছিল। ১৯৩৮ সালে শেরেবাংলা ও সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জে আসবেন। তখন শেখ মুজিব কেবল স্কুলের ছাত্র। তারই ঘাড়ে পড়লো স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী করার দায়িত্ব যারা সভার আয়োজনে সাহায্য করবে। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও শেখ মুজিব অনুষ্ঠান আয়োজনের সব প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেন এবং সোহরাওয়ার্দী যখন মিশনারী স্কুল পরিদর্শনে যান তখন শেখ মুজিব এর সাথে পরিচয় ও আলাপচারিতা হয়। তখন থেকেই তার সাথে চিঠির যোগাযোগ হতো মাঝে মধ্যে। ১৯৩৯ সালের সোহরাওয়ার্দীর সাথে দেখা করে তাকে আশ্বস্ত করে আসেন যে গোপালগঞ্জে মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করবেন এবং মুসলিমলীগও গঠন করবেন। তখন থেকেই রাজনীতিতে সক্রিয় পদার্পন শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর। শেখ মুজিব রাজনীতি করলেও খেলাধুলায় বেশ ভালো ছিলেন এবং তার এলাকায় যারা খেলাধুলা ভালো করতো তাদেরকে স্কুলে ভর্তি করানো থেকে শুরু করে বেতন ফ্রি করে দেওয়া ইত্যাদি কাজও তিনি করতেন। ১৯৪১ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন শেখ মুজিব এবং পরীক্ষা দিয়েই কলকাতায় যান। তখন থেকেই সভা সমাবেশে যোগদান করতেন এবং এরই মাঝে মাদারিপুরে যেয়ে মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করেন। ম্যাট্রিক পাস করার পর তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় খাজা নাজিম উদ্দিন সাহেব প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তখন শেখ মুজিবুর রহমান দুর্ভিক্ষপিড়ীত মানুষের জন্য লঙ্গরখানা খোলেন। এমনও দিন গেছে বেশি রাত হওয়ার কারণে কলকাতার বেকার হোস্টেলে ফিরতে পারেননি। দুর্ভিক্ষপিড়ীত মানুষের সেবা করতে গিয়ে হোস্টেলে যাওয়ার সময়টা পেরিয়ে গেছে। তখন তিনি লীগের অফিসের টেবিলে শুয়ে রাত পার করতেন। 
১৯৪৩ সালে রিলিফের কাজের জন্য গোপালগঞ্জে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু। ফিরে এসে মানুষের ভয়াবহ অবস্থা দেখে সিদ্ধান্ত নেন যে একটা বড় কনফারেন্স করার যাতে সোহরাওয়ার্দী ও মুসলিমলীগের অন্যান্য নেতারা এই ভয়াবহ অবস্থা প্রত্যক্ষ করতে পারেন। সেই কনফারেন্স আয়োজনের জন্য নিদারুন পরিশ্রম করেন শেখ মুজিবুর রহমান। কলকাতায় গিয়ে নেতৃবৃন্দকে দাওয়াত দেয়া, টাকা তোলা, প্যান্ডেল করা এই সমস্ত কাজের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। 
১৯৪৫ সালের শুরুর দিকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ইস্যু নিয়ে ইলেকশনের প্রস্তুতি শুরু হয়। এই ইলেকশনের কারণে যাতে বাইরে কাজ করতে সুবিধা হয় সে জন্য বঙ্গবন্ধু ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে অব্যাহতি নেন। কংগ্রেস ও মুসলিমলীগ তাদের প্রচার প্রচারণা চালাতে থাকে। শেখ মুজিব ও তার সংগীদের দায়িত্ব পড়লো মুসলিমলীগের নির্বাচনী অফিস প্রত্যেক জেলায় জেলায় প্রতিষ্ঠিত করা। এর কিছু দিন পরেই কলকাতা, নোয়াখালি ও বিহারে দাঙ্গা শুরু হয়। কলকাতায় দাঙ্গার সময় হোস্টেলের চাল আটা ফুরিয়ে যায়। শেখ মুজিব তখন সোহরাওয়ার্দীর সাথে যোগাযোগ করে নবাবযাদা নসরুল্লাহর সহায়তায় চাল নিজে তার সংগীদের নিয়ে ঠেলাগাড়ি ঠেলে বেকার হোস্টেল, ইলিয়ট হোস্টেলে পৌছে দেন। ১৯৪৬ সালে ভারতের রাজনীতিতে এক কঠিন পরিস্থিতি তৈরি হয় এবং ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করা হয়। ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি ফজলুল হক মুসলিম হলে যে সভার আয়োজন হয়েছিল সে সভার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান সবাইকে একত্রিত করেন এবং বোঝান যে, একটা ছাত্র সংগঠন করা একান্তই জরুরি এবং সেই সভায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নামে একটি সংগঠন করা হয়। তখন ছাত্রলীগ গঠন করা হলে ছাত্রদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায় এবং ১ মাসের মধ্যে সব জেলায় কমিটি দাড় করানোর পেছনেও কৃতিত্ব ছিল শেখ মুজিবের। ১৯৪৮ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা কী হতে পারে তা নিয়ে করাচিতে সংবিধান সভার বৈঠক আয়োজন করা হয়। মুসলিমলীগের অধিকাংশ নেতা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে ছিলেন। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দাবি করেছিলেন পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু ভাষা যেহেতু বাংলা তাই বাংলা রাষ্ট্রভাষা হবে এবং তারই প্রেক্ষিতে ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমান এই ধর্মঘট সফল করার জন্য ফরিদপুর, যশোর, খুলনা ও বরিশালের ছাত্র সম্মেলন করে প্রচারণা চালান। প্রচারণা চালিয়ে ১১ই মার্চের ৩ দিন আগে ঢাকায় আসেন এবং ১১ই মার্চ সফল ধর্মঘট হয় শেখ মুজিবুর রহমানের কল্যাণেই। 
১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চের ধর্মঘটই ছিল পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্মের পর প্রথম সফল হরতাল। শেখ মুজিবুর রহমান যখন আইন বিভাগের ছাত্র তখন নি¤œ বেতনে চাকুরীরত কর্মচারীরা ধর্মঘট শুরু করে। শেখ মুজিবুর রহমান সেই ধর্মঘটকে সমর্থন জানান। যার, জন্য পরে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার হতে হয়েছিল। ১৯৪৮ সালের পর ৫২, ৬২, ৬৬, ৬৯, ৭০, ৭১ প্রত্যেকটি অধ্যায়ের নিউক্লিয়াস ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তরুণ প্রজন্ম যত বেশি শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনাদর্শ, মানবতাবোধ ও রাজনৈতিক দর্শন পাঠ করবে তাদের বাস্তব জীবনের চলার পথ তত বেশি সুগম হবে। সমস্যা হচ্ছে আমাদের পরশ্রীকাতরতা, শেখ মুজিব তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে একটা জায়গায় আফসোস করে বলেছেন “পরশ্রীকাতরতা ও বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধহয় কোন দুনিয়ার কোন ভাষায়ই এই কথাটা পাওয়া যাবে না। ঈর্ষা, দ্বেষ সকল ভাষাতে পাবেন, সকল জাতির মধ্যে কিছু কিছু আছে কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে আছে পরশ্রীকাতরতা। ভাই, ভাইয়ের উন্নতি দেখে খুশি হয় না, এজন্যই বাঙালি জাতির সকল গুণ থাকা সত্ত্বেও জীবনভর অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। সুজলা, সুফলা বাংলাদেশ সম্পদে ভর্তি, এমন উর্বর ভূমি দুনিয়ায় খুবই অল্প আছে তবু এরা গরিব কারণ যুগ যুগ ধরেই এরা শোষিত হয়েছে নিজের দোষে। নিজেকে এরা চেনে না, আর যতদিন চিনবেনা এবং বোঝবে না ততদিন এদের মুক্তি আসবে না।” 
স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরেও আমরা কী নিজেদেরকে চিনতে পেরেছি।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, শাবিপ্রবি, সিলেট।

SUMMARY

1895-1.png