রক্তঝরা উত্তাল ১৭ মার্চ


১৭ মার্চ। একাত্তরের এই দিনে খোদ প্রেসিডেন্টকে ঢাকায় রেখে বাংলার দামাল ছেলেরা দেশ স্বাধীন করতে ঢাবি মাঠে প্রথম কুচকাওয়াজ ও রাইফেল চালনা প্রশিক্ষণ শুরু করে। ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস পালনের পরিবর্তে দেশজুড়ে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলনসহ নানা কর্মসূচির মাধ্যমে প্রতিরোধ দিবস পালনের ঘোষণা দেয়া হয়। 
একাত্তরের এই দিনে প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের সাথে ঢাকাস্থ প্রেসিডেন্ট ভবনে স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দ্বিতীয় দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সকাল ১০টা থেকে কড়া সামরিক প্রহরায় অনুষ্ঠিত এক ঘণ্টার বৈঠক শেষ হয় কোনরূপ সিদ্ধান্ত ছাড়াই। বৈঠক শেষে বের হয়ে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, আলোচনা এখনো অব্যাহত রয়েছে এবং আমাদের মধ্যে আরো আলোচনা হতে পারে। তবে সময় নির্ধারিত হয়নি। আমি শুধু এটুকু বলতে পারি যে, আমার কিছু বলার নেই। তাঁর হতাশাব্যঞ্জক ও ইঙ্গিতপূর্ণ কথায় বৈঠকের পরিণতি আঁচ করতে পেরে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে গোটা দেশ। বৈঠকে সামরিক শাসন প্রত্যাহার, জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং গুলি চালিয়ে বাঙালি হত্যার বিচারের দাবিতে বঙ্গবন্ধুর অটল অবস্থানের খবরে তাঁর প্রতি আরো দৃঢ় হয় দেশবাসীর আস্থা। সাংবাদিকদের অনুরোধে নিজ বাসভবনে তাদের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, আমাদের সংগ্রাম অব্যাহত আছে এবং লক্ষ্যে উপনীত না হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। একাত্তরের ১৭ মার্চ জন্মদিন উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন জানাতে সকাল থেকে তাঁর ধানমন্ডির বাসার অভিমুখে ছিল জনতার ঢল। বিকেলে জনতার উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, এদেশের জনগণ সত্য ও ইনসাফের পক্ষে সংগ্রাম করছে। তাদের দাবির প্রশ্নে কোনো আপস হতে পারে না। বঙ্গবন্ধুর এসব বক্তব্যে পরিষ্কার হয়ে উঠে অসহযোগ আন্দোলনের গন্তব্য। ওইদিনের সূর্যোদয়ে সংলাপকে কেন্দ্র করে জেগে ওঠা আশার আলো ধূমায়মান অন্ধকারে নিমজ্জিত হয় সূর্যাস্তের পূর্বেই। সাময়িক শৈথিল্য ভেঙে দেশজুড়ে আবারো দেখা দেয় মহাসমুদ্রের গর্জন। স্বাধীনতার জন্য জীবনদানে সংঘবদ্ধ বাঙালির প্রত্যয়ী উচ্চারণে প্রকম্পিত হয় বাংলার বাতাস। মুহূর্তে মুহূর্তে পাল্টাতে থাকে রাজপথের রূপ। চট্টগ্রামে জনসভায় মওলানা ভাসানী দৃঢ়কন্ঠে উচ্চারণ করেন, শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। এহিয়া এখন সম্পূর্ণরূপে ক্ষমতাহীন। এদেশে সব ক্ষমতা এখন জনসাধারণ এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে। তিনি দেশবাসীকে ঐক্য অটুট রেখে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য আহবান জানান। আগুনঝরা মার্চের এই দিনে সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল টিক্কা খান পূর্ববর্তী ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে সেনাবাহিনী তলব এবং তাদের কার্যক্রম তদন্তে একটি কমিশন ঘোষণা করেন। একজন বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত এই কমিটিতে বাকি সব সদস্যই ছিলেন সেনাবাহিনীর। এখানে থেকেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পিপিপি নেতা ভূট্টোকে এদেশে আসার আমন্ত্রণ জানান। এসব ঘটনায় দেশজুড়ে জনমনে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। মুক্তিপাগল মানুষের এদিনের আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সার্ভিসেস এসোসিয়েশন, স্টেট ব্যাংক কর্মচারী পরিষদ, চামড়া ব্যবসায়ী সমিতি, প্রতিরক্ষা বিভাগের বেসরকারি কর্মচারী সমিতিসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন। সরকারি নির্দেশ লঙ্ঘন করে তারা দলে দলে এসে শামিল হয় মিছিলের কাতারে। ঢাকায় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের সমাবেশে ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসের দিনে ‘প্রতিরোধ দিবস’ পালনের ডাক দেয়া হয়। একই দিনে ঢাকায় আর্মি রিক্রুটিং সেন্টারে ককটেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। জেনারেল টিক্কা খান, জেনারেল খাদিম রাজা এবং রাও ফরমান আলী গোপন বৈঠকে বসে চূড়ান্ত করেন অপারেশন সার্চলাইট পরিকল্পনা। এই দিনে পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় সেখানকার অনেক সংগঠনের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি সমর্থনের বিবৃতি প্রকাশ পায়। লাহোরে প্রবীণ কয়েকজন নেতা এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, সাধারণ নির্বাচন গোটা দেশের জন্য হয়েছে, দুই অংশের জন্য পৃথক পৃথক নির্বাচন হয়নি। কাজেই জাতীয় পরিষদে একটি মেজরিটি পার্টি থাকবে। ভূট্টোর প্রস্তাব পাকিস্তানকে বিভক্ত করার ষড়যন্ত্র ছাড়া কিছু নয়। ওই ঘটনায় এদেশের মুক্তি আন্দোলনের পালে হাওয়া লাগে তীব্র বেগে।

SUMMARY

1894-1.jpg