এম আর মাহবুব ও সালেক নাছির উদ্দিন
আজন্ম মাতৃভাষাপ্রেমী শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৭ সালে ভাষা আন্দোলনের সূচনাপর্ব এবং পরবর্তী সময়ে আইনসভার সদস্য এবং রাষ্ট্রপতি হিসেবে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই কলকাতার সিরাজউদ্দৌলা হোটেলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পরবর্তী কর্তব্য নির্ধারণে সমবেত হয়েছিলেন কিছুসংখ্যক রাজনৈতিক কর্মী। সেখানে পাকিস্তানে একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগঠন করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়। সে প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কর্মী সম্মেলনে গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠিত হয়। ওই সম্মেলনে ভাষা বিষয়ক কিছু প্রস্তাব গৃহীত হয়। সম্মেলনের কমিটিতে গৃহীত প্রস্তাবগুলো পাঠ করলেন সেদিনের ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ভাষা আন্দোলনের শুরুতে তমদ্দুন মজলিসের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সংক্রান্ত কার্যক্রমে তিনি অংশগ্রহণ করেন।
বঙ্গবন্ধুর প্রথম জীবনীকার অধ্যাপক ড. মযহারুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান এই মজলিসকে রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত বহু কাজে সাহায্য ও সমর্থন করেন’ (সূত্র: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, মযহারুল ইসলাম: ঢাকা, আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৩: পৃ. ১০৪)। ১৫০নং মোগলটুলীর ‘ওয়ার্কস ক্যাম্প’ ছিল সে সময়ের প্রগতিশীল ছাত্র-যুবক ও রাজনৈতিক কর্মীদের মিলনকেন্দ্র।
ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের কর্মীরা বাংলাভাষাসহ পাকিস্তানের অন্যান্য বৈষম্যমূলক দিক জাতির সামনে তুলে ধরেন। ভাষা আন্দোলনের সপক্ষে কর্মীবাহিনী এখানে নিয়মিত সমবেত হতো এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার নানা কর্মপরিকল্পনা এখানেই নেয়া হতো। শেখ মুজিব, শওকত আলী, কামরুদ্দিন আহমদ প্রমুখ নেতা ছিলেন এই ক্যাম্পের প্রাণশক্তি।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে এই সংগঠনটির ভূমিকা খুবই স্মরণীয়। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত ছাত্রলীগের ১০ দফা দাবির মধ্যে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার ও সামরিক বাহিনীতে বাঙালিদের নিয়োগ এবং বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষার দাবি ছিল অন্যতম দাবি।
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে পরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলা ভাষাকে উর্দু ও ইংরেজির সঙ্গে গণপরিষদের ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্তির জন্য একটি প্রস্তাব উত্থাপন করলে সেটি প্রত্যাখ্যাত হয়। এ ঘটনায় বিক্ষুব্ধ ভাষা আন্দোলন নেতাদের ডাকে ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়।
১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ফজলুল হক মুসলিম হলের যৌথসভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠন করা হয়। ২ মার্চ ফজলুল হক মুসলিম হলের এই সভায় যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদ, মুহম্মদ তোয়াহা, আবুল কাসেম, রণেশ দাশগুপ্ত, অজিত গুহ প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। ১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে গ্রেপ্তার হওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন জেলে আটক ছিলেন।
১৯৫৩ সালে একুশের প্রথম বার্ষিকী পালনেও বঙ্গবন্ধুর যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। সেদিন সব আন্দোলন, মিছিল এবং নেতৃত্বের পুরোভাগে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আরমানিটোলা ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় তিনি সেদিন একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়ার আহ্বান জানান এবং অবিলম্বে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের বিস্ফোরণের পর ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে কাজে লাগিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের একজন মন্ত্রী হিসেবে সমকালীন রাজনীতি এবং বাংলা ভাষার উন্নয়নে অবদান রাখেন। পরবর্তীকালেও বাংলাভাষা ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের অধিকারের সেই একই দাবি ও কথাগুলো আরো বর্ধিত উচ্চারণে জাতির সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হন।
১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা একাডেমিতে একটি সভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর কথা বলেছিলেন। ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকাকালীন সরকারি পর্যায়ে বাংলা প্রচলন কমিটি গঠন করেন।
১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দৈনিক বাংলায় ‘সরকারি পর্যায়ে বাংলা প্রচলনে কমিটি গঠিত’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয় ‘জানা গেছে বঙ্গবন্ধু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, অফিসের নথি ও অন্যান্য কাগজপত্র বাংলায় না লেখা হলে তাঁর কাছে উপস্থিত করা যাবে না।’
১৯৭২ সালের সংবিধানে তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করেন। এটাই ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম বাংলা ভাষায় প্রণীত সংবিধান।
লেখকদ্বয় ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস গবেষক।