বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু এবং আমাদের জাতীয় ঐক্য-ব্রজেন্দ্র কুমার দাস


অবসর নেয়ার বেশ ক’বছর পরও কেন জানি জনতা ব্যাংক তথা ব্যাংকের কর্মকর্তা, নির্বাহীগণ আর সকল স্তরের কর্মচারী ভাইদের আশে পাশে ঘুরতে, তাদের সঙ্গে সময় কাটাতে বড়োই সুখ পাই। শুধু সুখই বা বলবো কেন, তখন মনে হয় আমিও বুঝি জনতা ব্যাংকেরই এক গর্বিত কর্মচারী। এর প্রমাণ পাই লজ্জা-ঘৃণা আর অকৃজ্ঞতায় ভরা বাঙালি জাতির শোকের দিন ১৫ আগস্টে সিলেটের কেন্দ্রিয় শহীদ মিনারে। অনেক সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কর্মচারী ভাইরা শোক র‌্যালী নিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু তথা জাতির জনকের স্মৃতির উদ্দেশ্যে। প্রচন্ড ভীড়ের মধ্যে হঠাৎ চোখে পড়লো জনতা ব্যাংক বিভাগীয় অফিসের একটি ব্যানারের দিকে। জনতা ব্যাংকের জেনারেল ম্যানেজার জনাব রিয়াজুল ইসলাম হাত তুলে ডাকছেন। ডাকছেন ডিজিএম আব্দুল ওয়াদুদ, ডিজিএম বাবু সন্দীপ কুমার রায়। যোগ দিলাম। শোক র‌্যালীতে। জাতির জনকের প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। এক কালের আমার প্রিয় সহকর্মী আব্দুল হাই, আতিক, আলমসহ অনেকের সাথেই দেখা হলো। অজান্তেই ফিরে গেলাম অতীতের চাকুরি জীবনে। আমার গর্ব আর কাকে বলে! এ গর্ব কোথায় রাখি! নতুন প্রজন্মের এতো সব মুজিব সৈনিকদের সাথে ১৫ আগস্ট শোক জানাতে পেরে নিজেকে খুবই ধন্য মনে করলাম। আর শোকের মধ্যেও শক্তির সন্ধান পেলাম। আর বার বার মনে হলো ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের আগেও তো এমন মুজিব সৈনিকের অভাব ছিলো না এদেশে। কিন্তু ৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর একমাত্র কর্নেল জামিল ছাড়া আর ক’জনকে আমরা পেয়েছি বঙ্গবন্ধুর জন্য বুলেটের মুখে বুক পেতে দিতে? এ প্রশ্নটি নিয়ে আজ আমরা, নতুন প্রজন্মের মুজিব সৈনিকরা যেন অন্তর দিয়ে চিন্তা-ভাবনায় নিয়ে আসি। 
শহীদ মিনার চত্ত্বরে আরো দেখা হলো অনেক মুক্তিযোদ্ধা ভাইদের সাথে। দেখা সিলেটের সাংবাদিক আজিজ আহমদ সেলিম, আমার অনুজ প্রতীম সিলেটের পরিচিত মুখ সাংবাদিক আল আযাদের সাথে। আলাপ চারিতার এক পর্যায়ে তাদের কাছে জানতে চাইলাম কোন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ এবং কোনো কোনো প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠনের সদস্যবৃন্দ জাতির জনকের উদ্দেশ্যে শোক এবং শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে ফুলের তোড়া নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। তারা যেটুকু জানালেন তা মোটেই আশাপ্রদ বা সুখকর নয়। এসব কথা নিয়ে ভাবতে ভাবতে ঘরে এসে টেলিভিশনের বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানগুলো দেখতে লাগলাম। সিলেটের শহীদ মিনারের মতো টেলিভিশনেরও একই অবস্থা। আওয়ামী লীগ আর এর অঙ্গ সংগঠন ছাড়া আর কোনো রাজনৈতিক দলের কাউকে দেখা যায়নি। বাংলাদেশ আর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী কারো দেখা মেলেনি। মনে মনে ভাবলাম একি হলো! জাতির জনক তো শুধু আওয়ামী লীগের নয়! জনক তো সমগ্র জাতির। জাতির জনকের সেই আহবান ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে’ এটা তো শুধু আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্য নয়! এ আহবান ছিল সাড়ে সাত কোটি বাঙালির প্রতি। এবং পাকি চেতনায় বিশ্বাসী গুটি কয় বিপথগামী ছাড়া এ আহ্বানে তো সমগ্র জাতিই একাট্টা হয়েছিলো শত্রু নিধনে। দুঃখ লাগে, ভেবে পাইনা আজ কেন এমন হলো। কি যেন এক অজ্ঞাত কারণে জাতির জনকের শোক দিবসে শোক মিছিলে শুধুই আওয়ামী লীগ বা এর অঙ্গসংগঠনগুলোকেই দেখা যায়! এ দায় কার? পিতার? না জাতির? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের না করা পর্যন্ত কি জাতীয় ঐক্যের কথা চিন্তা করা যায়?
ঘরে টেলিভিশনের দর্শক আমরা স্বামী-স্ত্রী দু’জনই। জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠান দেখছি। বিশিষ্ট জনের বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আলোচনা। ফাঁকে ফাঁকে গান। ‘শোন একটি মজিবরের থেকে লক্ষ মজিবরের কণ্ঠ স্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে উঠে রনি, বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ’ শুনেই স্ত্রীধনটি আমার একটু নড়েচড়ে বসে বলেন ‘একাত্তরে শিলং-এ গানটি বরুণ কাকা আমাদেরকে শিখিয়েছিলেন।’ ‘আমাদেরকে’ বলতে তিনি তার আরো পিসাতো দু’বোন শিবানী, সিউলীকে বুঝাতে চেয়েছেন। তখন তারা শিলং এ থাকতেন। তাদের বরুণ কাকাও মুক্তিযুদ্ধের বিশিষ্ট সংগঠক হিসেবে মাঝে মধ্যে শিলং গেলে তাদের বাসায় যেতেন। আর সেখানেই তিনি এগানটি তাদেরকে শিখিয়েছেন। কথাটা শুনে আমার প্রথমে একটু খটকাই লাগলো। কারণ, বরুণ রায়তো কমরেড অর্থাৎ বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রিয় নেতাদের একজন ছিলেন। আওয়ামী লীগের কেউ কেটা নন! তাঁর মুখে এ গানটি উচ্চাতির হবে সেটি কি ভাবা যায়। কিন্তু আমার স্ত্রী বেচারীরতো এ নিয়ে অসত্য কথা বলার কোনো যুক্তি নেই! তার কোনো লাভ-লোকসান চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। তাই আমার বিশ্বাস করে নিতেই হলো তাদের গভীর শ্রদ্ধা-ভালোবাসার বরুণ কাকা সত্যি-সত্যিই নিজে এ গানটি গেয়ে গেয়ে তাদেরকে শিখিয়েছিলেন।
কিন্তু আজ কিছুটা হলেও আমরা দেশে ভিন্ন চিত্র দেখছি। যার সংগ্রামী নেতৃত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। সংবিধানে যাকে জাতির পিতা বলে স্থান দেয়া হলো। দেশী-বিদেশী কিছু চক্রান্তকারীর চক্রান্তে কিছু দলীয় বিশ্বাসঘাতক জল্লাদ কর্তৃক আমাদের জাতির জনক নির্মমভাবে সপরিবারে নিহত হলেন। দিনটি ছিল ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট। এটিকে আমরা বলি জাতীয় শোক দিবস। রাজনৈতিক দল হিসেবে যদি বলি তাহলে শুধু আওয়ামী লীগকে নিয়েই তো শুধু জাতীয় শব্দটি সম্পৃক্ত নয়। দেশে কেউ যদি আমাদের স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধ মনে প্রাণে বিশ্বাসী না হয়ে থাকেন তাদের কথা না হয় বাদই দিলাম কিন্তু দেশের যে সকল দলগোষ্ঠী বা সাংস্কৃতিক শিল্পীগোষ্ঠী কাউকে তো ১৫ আগস্টে শোক জানাতে দেখা যায় না। 
পত্র পত্রিকায় ও কোনো রাজনৈতিক দল এবং দলীয় নেতৃবৃন্দকে শোক দিবসে শোক জানাতে দেখা যায় না। যদিও সেটি আমাদের জাতীয় শোক দিবস। যে পাকিস্তান থেকে আমরা আলাদা হয়ে এসেছি সেই পাকিস্তানেও দেশের সকল রাজনৈতিক দলই তাদের জাতির জনক কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র প্রতি শ্রদ্ধা জানায়। ভারতের বর্তমান দল বিজেপির প্রধানমন্ত্রী মোদিজি ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর প্রতি নতমস্তকে শ্রদ্ধা জানান। শুধু প্রধানমন্ত্রীই নন, অন্যান্য দল মতের মানুষও গভীর শ্রদ্ধা জানান। দুঃখজনক হলেও আমাদের বলতে হয় আমরাই বোধ হয় এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। কিন্তু কেন? এই ‘কেন’ এর উত্তর আমরা যতোদিন খুঁজে বের করতে পারবো না ততোদিন বোধ হয় সবার মুখে বহুল কথিত চর্বিত জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা সম্ভব নয়। আমরা এমন দুর্ভাগা যে, যে ভাষণের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির জন্ম হলো বঙ্গবন্ধুর সেই কালোজয়ী ৭ মার্চের ভাষণকেও এদেশেরই কেউ কেউ বিকৃত করার মতো অপচেষ্টায় লিপ্ত হই এবং এ নিয়ে পত্রিকার পাতায় শিরোনাম ‘ফেঞ্চুগঞ্জে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বিকৃত করার অভিযোগে ছাত্রদল নেতা গ্রেফতার’ (দৈনিক সিলেটের ডাক, ২১ আগস্ট ২০১৮)। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী কোন দলের নেতা ছিলেন সেটা কিন্তু সে দেশের মানুষ বিচার করেন না। বিচার করেন জাতির জনক হিসেবেই-দলীয় পরিচয় এখানে মুখ্য নয়।
১৫ আগস্ট নিয়ে দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন শিরোনাম দেখা যায়। অনেকেই লিখেন ‘আজ জাতীয় শোক দিবস, আজ জাতির শোকের দিন’, কালের কণ্ঠ লিখে ‘বাঙালির কান্নার দিন আজ’। কিন্তু প্রশ্ন হলো-দলমত নির্বিশেষে সব বাঙালি এই দিনে কি কাঁদতে পেরেছেন? আর সব কান্নাকে কি কান্না বলা চলে! শুনেছি জাতির জনকের মৃত্যুর পর কবরে নেমে বিশ্বাসঘাতক মোস্তাক নাকি অঝোরে কেঁদেছিলেন। তার কান্নাকে কি কান্না বলা যায়? যায় না। অন্য কিছু। তাই এরকম কোনো কান্নার সুর আজকে শুনা যায় কি না সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় দেখলাম ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি ‘বঙ্গবন্ধু স্মরণে’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছেন। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছেন আমাদের জাতির জনককে। বাংলাদেশেরও তো এরকম অনেক ‘সাবেক’ রয়েছেন। উনারা বঙ্গবন্ধুকে এমনিভাবে স্মরণ করেছেন কি? বলা হয়ে থাকে বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ এবং মুক্তিযুদ্ধ সমার্থক। যদি তাই হয় তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠে যারা বিচরণ করেন তাদেরকে অবশ্যই অন্তর থেকে এই শব্দ তিনটিকে শ্রদ্ধা জানাতে হবে অন্তত জাতীয় ঐক্যের ব্যাপারে। সারা বিশ্ব স্বীকার করে যে, বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধু এক সূতোয় গাথা। তাই শত চেষ্টা করেও এ গাথুনি কেউ ছিঁড়তে পারবে না। কবি অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছেন-‘যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান/ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।’ আমি বলি, যেভাবে দেশের নদনদী শুকিয়ে যাচ্ছে, পদ্মা মেঘনা যমুনা গৌরীর বহমানতা শেষ হয়ে গেলেও বঙ্গবন্ধুর কীর্তি রয়েই যাবে।
সবশেষে বলি বঙ্গবন্ধুকে অন্তর থেকে সম্মান দিলে আমরা নিজেরাই সম্মানিত হবো। আর আমার বিশ্বাস একাত্তরে কমরেড বরুণ রায় শিলং এ তিনটি ছোট্ট মেয়েকে ‘মুজিবের কণ্ঠস্বর’ নিয়ে যে গান শিখিয়ে ছিলেন তাতে তিনি তার আদর্শ-বিশ্বাস-দর্শন থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্ছুত হননি। বরং উদারতার পরিচয় দিয়েছেন। কোনো সংকীর্ণতার জালে আবদ্ধ হননি। তাই আসুন, জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে সকলই সকল সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে বঙ্গবন্ধুকে বুকের ভেতর ধারণ করি।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, কলামিস্ট ও সাবেক ব্যাংকার।

SUMMARY

1886-1.jpg