রতীশচন্দ্র দাস তালুকদার
আগস্ট মাস নিয়ে আমরা অনেকেই খুব আবেগতাড়িত হয়ে পড়ি। আগস্ট মাসে আমাদের দেশে যেসব শোকাবহ ঘটনা ঘটেছে, তা নিয়ে আবেগাক্রান্ত হওয়া খুবই স্বাভাবিক, তবে আমার মনে হয় এসব ঘটনা নিয়ে নির্মোহ পর্যালোচনা এবং দেশি-বিদেশি যারাই হউক সব ষড়যন্ত্রকারীর মুখোশ উন্মোচন আরও জরুরী। আমরা স্বীকার করি আর নাই করি, এটা স্পষ্ট যে, আগস্ট নিয়ে আমাদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং জনগণের মধ্যে একটি বিভাজনরেখা তৈরি হয়েছে। এ মাসটি নিয়ে আমাদের প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে যে অবিশ্বাসের চারাগাছ রোপিত হয়েছে তা বিভিন্ন অনভিপ্রেত কর্মকান্ডের মাধ্যমে আজ মহীরূপে পরিণত হয়েছে। প্রয়োজন ছিল, চারাগাছ অবস্থাতেই এর মূলোৎপাটন করা। তবে সদিচ্ছা থাকলে যেকোন সময়ই এ বিষবৃক্ষটি অপসারণ করা যায়। দেশের সচেতন জনগণ অবশ্য বিশ্বাস করে, আমাদের দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে শুভ ইচ্ছা জাগ্রত হবে। আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে যে অস্বাভাবিক Tension বিরাজ করছে এর মূলে কিন্তু সেই অবিশ্বাসের বীজটি। সুতরাং এ বীজটি অপসারণ করা আজ সময়ের দাবি। এ বক্তব্যের সাথে অনেকেই ভিন্নমত পোষণ করবেন এটা ঠিক, তবে লক্ষ্য করলে আমরা দেখব, যতই দিন যাচ্ছে ইতিহাসের মোড় ঘুরানো আগস্টের সেই শোকাবহ ঘটনাবলী আরও ভাস্বর হয়ে উঠছে এবং রাজনৈতিক অঙ্গনের বিভাজন রেখাটি প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। সুতরাং জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সব রাজনৈতিক দলকেই এই নির্মম ঘটনাবলী সম্পর্কে তাদের নিজ নিজ অবস্থান পরিষ্কার করতেই হবে এবং কিছু কিছু মৌলিক বিষয়ে সহমত পোষণ করতে হবে।
বিশ্বের অনেক জননন্দিত নেতাই আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছেন। এখানে প্রথমেই উল্লেখ করা যায়, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীর নাম। নাথুরাম গডসে নামক এক ‘আরএসএস’ নেতা অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় মহাত্মাকে হত্যা করে ১৯৪৮ সালে। পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জনপ্রিয় মুসলিমলীগ নেতা লিয়াকত আলী খানকে ১৯৫১ সালে হত্যা করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় এবং তরুণ প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডী ডালাস শহরে আততায়ীর হাতে নিহত হন ১৯৬২ সালে। মানবাধিকার কর্মী ও বিশ্বনন্দিত কৃষ্ণাঙ্গ নেতা এবং শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জয়ী মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র নৃশংস হত্যাকান্ডের শিকার হন ১৯৬৮ সালে। আমাদের জনপ্রিয় মুক্তিযোদ্ধা প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় ১৯৮২ সালে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে। বিশ্বের অনেক জননন্দিত রাষ্ট্রনায়ক ও নেতাই এমনি চরম নৃশংসতার বলি হয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। তবে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি ও আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে এবং প্রায় সকল নিকট আত্মীয়সহ যে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়, তার উদাহরণ বিশ্বের ইতিহাসে নেই একটি গভীব পরিকল্পনা ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে এ পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। আমরা দেখেছি এ চরম পাশবিক ঘটনার অব্যবহিত পরে পাকিস্তান সহ বেশ কয়েকটি দেশ যারা প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, তারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। যে আদর্শকে ধারণ করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার থেকে ঠিক একশ আশি ডিগ্রি ঘুরিয়ে দেওয়া এবং মুক্তিযুদ্ধে যে দলটি নেতৃত্ব দিয়েছিল সে দলকে পুরোপুরি নেতৃত্বশুন্য করাই ছিল এ নৃশংস ঘটনার মূল উদ্দেশ্য। তাই বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে উনার পরিবার ও নিকটাত্মীয়য়ের মধ্যে যারা দলের হাল ধরতে পারতেন এবং ১৯৭১ সালের বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারান্তরীণ থাকা অবস্থায় যে চার নেতা দেশকে বিজয়ের বন্দরে পৌঁছে দিয়েছিলেন তাদের সবাইকে সুগভীর পরিকল্পনার মাধ্যমে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ বর্বরতম হত্যাকান্ডগুলোর বিচার রহিত করার লক্ষ্যে Indemnity ordinancr জারি করা হয় এবং পরবর্তীকালে এটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে ১৯৭২ সালে যে সংবিধান রচিত হয়েছিল তাতে কালিমা লেপন করা হয়। শুধু তাই নয়, আত্মস্বীকৃত খুনীদের নিরাপদে বিদেশ পাঠিয়ে তাদের অনেককেই বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুনর্বাসিত করা হয়।
ভারতবর্ষকে ইংরেজের করমুক্ত করতে প্রায় দু’শ বছর লেগেছিল। স্বাধীনতার এ যাত্রাপথে ভারতবর্ষের জনগণকে রক্ত দিতে হয়েছে প্রচুর। বিশ্বের ইতিহাস ঘাটলে আমরা দেখব, কোন দেশই বিনা রক্তপাতে ঔপনিবেশিক শক্তির নিগঢ় থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। নেতাজী বলতেন, ‘আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা এনে দেব’। ত্রিশ লক্ষ লোকের প্রাণ এবং প্রায় চার লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমরাও নব্য ঔপনিবেশিক শক্তি পাকিস্তানকে পরাস্ত করেছি। এক্ষেত্রেও প্রায় চব্বিশ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। এ যাত্রাপথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর অনুসারীরা দেশের জনগণকে স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে উজ্জীবিত করার লক্ষ্যে অক্লান্ত সংগ্রাম করেছেন। বঙ্গবন্ধুর ৫৫ বছর জীনবকালের প্রায় ৪০% সময় তিনি কারান্তরালে ছিলেন। হিসেব করলে আমরা দেখতে পাবো, প্রায় ২২ বছর তিনি জেলে অবস্থান করেছেন। ব্রিটিশ আমলে তিনি কারাগারে গিয়েছিলেন বলে আমাদের জানা নেই, সুতরাং ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ২৪ বছরের মধ্যে ২২ বছরই তিনি জেলে কাটিয়েছেন বলে ধরে নেওয়া যায়। এদেশের জনগণের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে শত নির্যাতন সহ্য করে জীবনের মূল্যবান ২২টি বছর তিনি পরিবার বিচ্ছিন্ন অবস্থায় কারান্তরালে ছিলেন। অথচ তাঁকেই কিনা স্বাধীন বাংলাদেশে সপরিবারে অত্যন্ত পাশবিকতার সাথে হত্যা করা হলো। এর চেয়ে কৃতঘœতার উদাহরণ আর কি হতে পারে? শুধু তাই নয়, দীর্ঘ ২১ বছর চেষ্টা চালানো হয়েছে তাঁর নাম বাংলার ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে। ২১ বছর পর বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে পুনরায় স্বীকৃতি দেওয়া হলো, Indemnity ordinancr বাতিল করে হত্যাকান্ডের বিচার করা হলো। অথচ দুঃখের সঙ্গে আমরা দেখেছি, ২০০১ সালে বিচারপতি লতিফুর রহমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হয়ে যখন রাতারাতি অনেক পদস্থ সরকারি কর্মকর্তাকে বদলি করে দিলেন, ঠিক এর পর পরই সারাদেশের অফিস কাছারি থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি অপসারণের হিড়িক পড়ে যায় এবং পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের রায় কার্যকর করাও অজ্ঞাত কারণে থমকে যায়। ১৯৪৮ সালে ভারতের জাতির পিতা মহাত্মাগান্ধীকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের (আরএসএস) নেতা নাথুরাম গডসে। ভারতের বর্তমান ক্ষমতাসীন দল বিজেপি ঐ ‘আরএসএস’ এরই রাজনৈতিক ভাবাদর্শ অনুসারী। কিন্তু তারাও মহাত্মাকে ভারতের স্বপ্নদ্রষ্টা জাতির জনক হিসেবে যথাযথ সম্মানপ্রদর্শন করে থাকে। পাকিস্তানের জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। সামরিক বা বেসামরিক যে সরকারই সেদেশে ক্ষমতায় আসুক জিন্নাহর প্রতি অশ্রদ্ধা ও অসম্মান প্রদর্শন করার কথা কেউ ভাবতেই পারে না। আসলে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে মহাত্মা গান্ধীর, পাকিস্তান আন্দোলনে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে অস্বীকার করা রাজনৈতিক অপরিপক্কতা ও অকৃতজ্ঞতারই নিকৃষ্ট উদাহরণ।
বঙ্গবন্ধু ফেরেশতা ছিলেন না, ছিলেন আমাদেরই মত রক্ত মাংসের মানুষ। আর মানুষের ভুল হওয়া তো খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। জনশ্রুতি আছে ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে খোন্দকার মোস্তাক আহমদ দাউদকান্দি আসনে ইঞ্জিনিয়ার আব্দুর রশিদের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন কিন্তু হেলিকপ্টারে করে ব্যালট বাক্স ঢাকায় এনে তাঁকে জিতিয়ে দেওয়া হয়। এ বিষয়টি বঙ্গন্ধুর অজ্ঞাতে ঘটেছিল বলে বিশ্বাস হয় না। আবার মোস্তাক আহমদ ও তাঁর অনুসারীদের পরামর্শেই বিশ্বস্ত সঙ্গী ও বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদকে মন্ত্রীসভা থেকেও সরিয়ে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। অন্যদিকে আজীবন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করলেও ১৯৭৫ সালে তিনি একদলীয় শাসন চালু করেছিলেন। এটিও অনেকের কাছে বঙ্গবন্ধুর একটি মারাত্মক ভুল। কোন জাতীয় নেতার সমালোচনা করার সময় তাঁর জীবনের সামগ্রিক কর্মকান্ড বিবেচনায় নিতে হবে। আজকাল ঐ ভুলগুলো উল্লেখ করে কেউ কেউ ‘টক শো’ বা অন্যত্র বঙ্গবন্ধুর নিন্দামন্দ করেন। তাদের কাছে প্রশ্ন, যে অবস্থানে দাঁড়িয়ে উনারা বঙ্গবন্ধুকে সমালোচনায় বিদ্ধ করছেন, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা না পেলে কি এ অবস্থানে আসতে পারতেন? বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ায় বর্তমানে অনেকের জীবনেই অপ্রত্যাশিত অনেক প্রাপ্তিযোগ ঘটেছে। তাই সমালোচনা করতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলেন। বাঙালিরা পাকিস্তানের কবলমুক্ত হয়ে এক সময় অবশ্যই একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করতো। কারণ এক হাজার মাইল ভৌগোলিক দূরত্বে অবস্থিত ভিন্ন ভাষাভাষী ও সংস্কৃতির জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত দু’টি ভূ-খন্ড মিলে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র বেশিদিন স্থায়ী হতে পারে না। তবে এটা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা যায়, বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে অন্তত ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন পূর্ণ হতো না।
১৯৭১ সালের বিধ্বস্ত বাংলাদেশ ও তখনকার পশ্চিম পাকিস্তান এবং বর্তমান বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, বাংলাদেশ অনেক উন্নয়নসূচকেই পাকিস্তান থেকে এগিয়ে আছে। তাই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী প্রখ্যাত ক্রিকেটার ইমরান খানের কাছে কোন কোন ‘টকশো’ বক্তা তাদের দেশকে বাংলাদেশ বানিয়ে দেওয়ার আহবান জানাচ্ছেন। আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে যেসব মর্মস্পর্শী ঘটনা ঘটেছে এবং যেভাবে মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন সৃষ্টি করা হয়েছে, এসব না ঘটলে হয়ত আমরা আরও অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারতাম। মালয়েশিয়া, কোরিয়া, সিঙ্গাপুরসহ দূরপ্রান্তের দেশগুলো সত্তর দশকে কেমন ছিল তা আমাদের জানা আবার এখন তারা কোথায় পৌঁছেছে তাও আমাদের অজানা নয়। সব সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারলে আমরাও এতদিনে এদের কাছাকাছি পৌঁছতে পারতাম নিঃসন্দেহে। আমাদের অন্যতম Plus Point হচ্ছে Population Divident, অর্থাৎ আমাদের দেশে কর্মক্ষম লোকের সংখ্যা বয়স্ক লোকের তুলনায় অনেক বেশি। যদি মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করে আমরা দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে পারতাম, তবে বহির্বিশ্বে যেমন এদের চাহিদা বাড়ত, আবার দেশে চালু কলকারখানার সাথে আরও নতুন নতুন শিল্প স্থাপনা তৈরি করে এদের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা সম্ভব হতো। দেশের বিভিন্ন শিল্প কারখানা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও সেবাখাতে বিদেশের অনেক দক্ষ কর্মী নিয়োজিত আছে এবং এর ফলে আমাদের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হয়। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দেশের জনসম্পদকে কাজে লাগাতে পারলে বিদেশি কর্মী নিয়োগের প্রয়োজন হতো না। তবে প্রত্যাশা করি, আমরা যেমন MDG বাস্তবায়ন করেছি, তেমনি SDG বাস্তবায়ন করতে পারবো যদি দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে এবং সুশাসন নিশ্চিত করে দুর্নীতি বশে আনা যায়।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, এম.সি কলেজ, সিলেট।