মূল্যায়ন : বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ভাষণ-অ্যাডভোকেট আনসার খান

১৯৭১ সালের মার্চ, বাঙালির জাতিসত্বার ইতিহাসে গৌরবদীপ্ত এক অধ্যায়। মার্চে বাঙালির জাতীয় জীবনের স্বাধিকার আন্দোলনের দীর্ঘ পথপরিক্রমার চুড়ান্ত লড়াই শুরু হয়েছিলো এবং এ লড়াই ছিলো পাকিস্তানি কায়েমী শাসন ও দীর্ঘ ২৩ বছরের ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জনের জন্য সশস্ত্র লড়াই ও যুদ্ধ। 
মার্চের এ সময়টায় বাঙালির জাতীয় ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য তিনটি ঘটনা ছিলো লক্ষণীয়। এর একটা হলো, সাত মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনন্য ঐতিহাসিক ভাষণ, দ্বিতীয়টা বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ২৬ শে মার্চে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা এবং তৃতীয়টা হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য চূড়ান্ত সশস্ত্র যুদ্ধ। মার্চ মাস তাই অখন্ড পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য যেমন, তেমনি মুক্তিকামী বাঙালি জনতার জন্য ছিলো ‘ঐতিহাসিক এক ক্রান্তিকাল।’ 
১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের আইন সভা জাতীয় পরিষদের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের রাজনীতিতে এক নব অধ্যায় রচিত হয়। নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মার্চের প্রথম সপ্তাহে আহুত হওয়ার কথা থাকলেও তখনকার পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পহেলা মার্চে এক বেতার ঘোষণা জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে দেন। তাঁর এ স্থগিতকরণের ঘোষণা পাকিস্তানের বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিমন্ডলে নতুন এক পরিস্থিতি ও আবহ সৃষ্টি করে। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতকরণের ঘোষণা মূলতঃ অখন্ড পাকিস্তানের ভিত্তিমূলকে নাড়িয়ে দেয় এবং বাংলাদেশ ও বাঙালির স্বাধীনতার যুদ্ধকে অনিবার্য করে তোলে।
১লা মার্চে ইয়াহিয়া খান কর্তৃক পরিষদের অধিবেশন স্থগিতকরণের ঘোষণার পর থেকেই পূর্ব বাংলার বাঙালি জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে বাঙালির স্বাধীকার ও আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রামকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে রূপান্তরের জন্য বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি ব্যাপক দাবি জানানো হতে থাকে। এ সময়কালে মূলতঃ বঙ্গবন্ধুই রাজনীতির মধ্যমণিতে পরিণত হন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তখন কার্যতঃ পূর্ব পাকিস্তানে সমান্তরাল সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কর্তৃত্ব পূর্ব পাকিস্তানে অচল হয়ে পড়েছিলো সে সময়টায়। 
পাকিস্তানি রাজনীতির; বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানে সে সময়টায় পাকিস্তানি কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনীতির প্রায় চুড়ান্তকাল চলছিলো এবং একই সাথে পাকিস্তানি রাষ্ট্র কাঠামো ও দ্বিখন্ডিত হওয়ার পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলো। চুড়ান্ত দ্বিখন্ডিত হওয়ার ক্ষেত্রে যেটুকু অবশেষ বাকী ছিলো সেটা ছিলো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা। আনুষ্ঠানিক ঘোষণাটাও এসে যায় ৭ মার্চ ও ২৬ শে মার্চ-১৯৭১ সালে। 
৭ই মার্চ ১৯৭১ সাল, বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতির টালমাটাল অবস্থায় বঙ্গবন্ধু পূর্বাহ্নেই ঘোষণা দিয়েছিলেন ৭ই মার্চে ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে দিকনির্দেশনা মূলক বক্তব্য রাখবেন তিনি। 
৭ই মার্চে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় স্মরণকালের বৃহত্তম জনসভা। প্রায় দশ লক্ষাধিক বাঙালি জনতার উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ উপস্থাপন করেছিলেন ঐ জনসভায়।
বাঙালি মুক্তিকামী জনতার আশা-আকাক্সক্ষা ও প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেছিলো বঙ্গবন্ধুর ভাষণে। বঙ্গবন্ধুর এদিনের বক্তব্যের মধ্যদিয়েই বাংলাদেশের স্বাধীনতার এবং পাকিস্তানি অখন্ড রাষ্ট্র কাঠামোর দ্বিখন্ডায়নের সুরটি অনুরণিত হয়েছিলো। 
৭ই মার্চের ১৮ মিনিটের ঐতিহাসিক বক্তব্যের শেষ প্রান্তে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণা ছিলো বাঙালির প্রাণের দাবি। পরবর্তী নয় মাসে স্বাধীনতার যুদ্ধে প্রতিটি বাঙালির মনে ও প্রাণে বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণা প্রেরণা যুগিয়েছিলো স্বাধীনতার যুদ্ধের বিজয় ছিনিয়ে আনার ক্ষেত্রে। 
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের উপস্থাপন, শব্দ চয়ন সবকিছুই ছিলো অনন্য, যা বাঙালির ইতিহাসে, তেমনি বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসের অনবদ্য এক ভাষণ হিসেবে ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে নানাভাবে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। তবে আমি তাঁর ভাষণকে চারটা অংশে গড় করে আলোচনা করবো। 
ভাষণের প্রথম অংশে চোখ বোলালে দেখা যায়, তিনি অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত অথচ সাবলীল ভাষায় ১৯৪৭ সাল থেকে তাঁর বক্তব্য উপস্থাপনকালীন সময় পর্যন্ত পাকিস্তানি কায়েমী শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক বাঙালি জনগণকে শোষণ, বঞ্চনা, অত্যাচার-নির্যাতনের বিবরণ তোলে ধরেছিলেন। ভাষণে তিনি বলেন ‘আমি বাঙালির করুণ ইতিহাস, বাংলাদেশের মানুষের রক্তের ইতিহাস.... মানুষের করুণ আর্তনাদ.... মানুষের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস বলতে এসেছি।
পরক্ষণেই তিনি বাঙালি জনগণকে কীভাবে রাজনৈতিক অধিকার ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কাঠামো থেকে দূরে রাখার জন্য বার বার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন এবং সংগ্রাম গড়ে তোলার যৌক্তিকতা ও ন্যায্যতা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেন। 
বক্তৃতার তৃতীয়াংশে পূর্বাহ্নে শুরু করা সামরিকজান্তা বিরোধী অসহযোগ আন্দোলন আরো বিস্তৃত এবং প্রসারিত করার আহবান জানিয়ে বললেন, ‘আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাচারী...শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে।’ বক্তৃতার এ অংশে কোন কোন ক্ষেত্রে হরতাল চলবে, আবার কী কী ক্ষেত্রে কোন কোন বিষয় হরতালের আওতামুক্ত থাকবে তাও নির্দেশনা প্রদান করেন। 
বক্তৃতার এ অংশটি ছিলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যময়। কারণ পাকিস্তানের অখন্ডতা, পাকিস্তানের বিদ্যমান প্রেসিডেন্ট, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও তার সরকারকে চ্যালেঞ্জ দিয়েই মূলতঃ বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে পূর্ব পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা তুলে নিয়েছিলেন। একমাত্র পাকিস্তানি সামরিক ছাউনি ছাড়া, সারা পূর্ব পাকিস্তানে ইয়াহিয়া খানের সরকার অকার্যকর হয়ে পড়ে, পাকিস্তানী শাসন অচল হয়ে পড়েছিলো এবং পরিবর্তে পূর্ব পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুর শাসন কার্যকর হয়েছিলো। 
৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের চতুর্থ অংশকে বলা যায়, গেরিলা ও জনযুদ্ধের দিক নির্দেশনা ও কৌশল সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল বিশেষ। বঙ্গবন্ধু এটি উপলব্ধি করেছিলেন যে, প্রচলিত প্রথাগত যুদ্ধের পরিবর্তে অপ্রচলিত যুদ্ধের মাধ্যমেই পাকিস্তানি সামরিক জান্তাকে মোকাবিলা করতে হবে এবং অপ্রচলিত যুদ্ধ বলতে তিনি গেরিলা যুদ্ধের প্রতিই গুরুত্বারোপ করেছিলেন। 
অপ্রচলিত এ যুদ্ধে সকল বাঙালি জনগণকে অংশগ্রহণের আহবান জানিয়ে তিনি বলেন- শত্রুর যে কোন হামলা ও আগ্রাসন প্রতিহত করার জন্য ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে হবে এবং যার যা কিছু আছে তা নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। রাস্তাঘাট যা কিছু আছে বন্ধ করে দিতে হবে।’ 
বক্তৃতার এ অংশটুকু বিশ্লেষণ করলে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য গেরিলা ও জনযুদ্ধের একটা সার্থক-সুন্দর রূপরেখার দিকে নির্দেশনার চিত্র পাওয়া যায়। তিনি এটি উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, বাংলার প্রতিটি ঘর, প্রতিটি ব্যক্তি যদি শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয় তাহলে দেশের স্বাধীনতা দমিয়ে রাখার সাধ্য কারো হবে না। তাই স্বাধীনতার যুদ্ধ জয়ের জন্য প্রতিটি ঘর, পরিবার ও প্রতিটি ব্যক্তি মানুষকে গেরিলা যুদ্ধে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্য নিয়েই ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহবান জানিয়েছিলেন। এখানে তিনি রূপক এবং প্রতীকি অর্থেই দুর্গের কথা বলেছেন। 
তিনি আরো বলেছিলেন ‘আমরা ভাতে মারবো, পানিতে মারবো।’ আরো বলেন, আমি যদি হুকুম দেবার না-ও পারি, আপনারা শত্রুর মোকাবিলা করবেন।
শত্রু পক্ষ যাতে বাঙালি জনগণের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে না পারে সেজন্য তিনি দেশবাসীকে সতর্ক করে দিয়ে বললেন, ‘শত্রু পেছনে ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে।’
প্রকৃতপক্ষে সম্পূর্ণ বক্তব্যটাই ছিলো অনবদ্য। অলিখিত ভাষণ হলেও প্রথম থেকে শেষ লাইনের মধ্যে ছিলো অপূর্ব এক সমন্বয়, যেনো ছন্দোবদ্ধ এক কাব্য-মহাকাব্য যেখানে সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করা হলো না, অথচ স্বাধীনতার জন্য আসন্ন যুদ্ধটায় জয় লাভের জন্য সকল করণীয় ও দিকনির্দেশনা স্পষ্ট করে তুলে ধরলেন। এভাবে পুরো বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধভাবে আসন্ন স্বাধীনতার যুদ্ধে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ এবং অনুপ্রাণিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এটাই তাঁর নেতৃত্বের গভীরতা ও বিশালতা। 
৭ মার্চের ভাষণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ঐতিহাসিক দলিল এবং অনুপ্রেরণা বিশেষ। তাঁর এই ভাষণই শত্রুকে পরাজিত করতে বাঙালি জনগণকে অনুপ্রাণিত করেছিলো। সাহস যুগিয়েছিলো। 
বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ পৃথিবীর স্বাধীনতাকামী মানুষজনদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে যুগ যুগ ধরে। আর আমরা বাঙালি জনগণও তাঁর এই ভাষণের যথার্থতা উপলব্ধি করে বাঙালির রাজনৈতিক-গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলস কাজ করে যাবো। বাংলাদেশে সত্যিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণে সাহস যোগাবে তাঁর ভাষণ। 
লেখক : কলামিস্ট।

SUMMARY

1882-1.png