বঙ্গবন্ধুর ভাষণ এবং স্বাধীনতা-গোলাম সারওয়ার

 
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার প্রায় ৯ বৎসর বয়স। তখন গ্রামে থাকতাম এবং ২য় শ্রেণিতে পড়তাম। আমাদের ঘাগটিয়া গ্রামে যুদ্ধ আংতক থাকলেও যুদ্ধ সংগঠিত হয়নি। তাহিরপুর থানা পর্যন্ত পাকিস্তানি মিলিটারী আসতে পেরেছিল। গ্রাম থেকে থানার দূরত্ব প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে থাকায় সেখানকার তান্ডব আমি দেখিনি। তবে আমার বাড়িতে বড় ধরনের তান্ডব হয়েছিল। বন্দুকের গুলিতে তিনটি তাজা প্রাণ ঝরেছিল। না, বর্বর পাকিস্তানি কর্তৃক এ সর্বনাশ ঘটেনি। দুঃখ এবং অতীব ক্ষোভের সঙ্গে বলতে হয় মুক্তিযোদ্ধা নামধারী কিছু সংখ্যক দুর্বৃত্ত, লুটেরা, বেঈমান কর্তৃক লোমহর্ষক এ ঘটনাটি ঘটে। 
পুরো গ্রামের মধ্যে আমাদের পরিবার ছিল অগ্রসর, সমৃদ্ধ এবং শিক্ষিত। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল আমাদের বাড়ি প্রায়ই আসত খাওয়া-দাওয়া করতে। দিনের বেলা না এসে সাধারণত এরা সন্ধ্যার পর আসত। খাওয়া দাওয়া সেরে ওরা বেশ তৃপ্ত মনে ফিরে যেত। 
বৃহস্পতিবার দিনগত রাত অর্থাৎ ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ শুক্রবার ফজর নামাজের আগ মুহুর্তে আমাদের বাড়িতে ঘটে যায় এক মহা তান্ডব। চিরচেনা সেই মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা বিভ্রান্ত হয়ে গেল। দুর্বৃত্তায়নের পথ বেছে নিয়ে ঘর থেকে সোনা-দানা, নগদ অর্থ নেয়ার পাঁয়তারা করল। সেদিন সন্ধ্যায় না এসে ওরা মাঝরাতে এলো। বাড়ির নৈশ প্রহরী আবু চাঁনকে সাথে নিয়ে ওরা ছোট চাচা এবং বড় চাচার দরজায় এসে ডাকা শুরু করল। খাবার খেতে এসেছে ভেবে আমার বড় চাচা মঈনুদ্দিন সাহেব তড়িগড়ি করে দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন বসার ঘরে। বসার ঘরটি ছিল মূল ঘর থেকে একটু আলগা। সেখানে গেলে পরে দুস্কৃতকারীরা আমার বড় চাচাকে বেঁধে ফেলল। একইভাবে বড় চাচার বড় ছেলে হারুণ ভাইকে ডেকে নিয়ে বাঁধল। ছোট চাচা এনামুদ্দিন বিষয়টি টের পেলেন কিন্তু পালানোর কথা না ভেবে এদের থেকে রক্ষা পাওয়ার চিন্তাই হয়তো করছিলেন। তাই হয়তোবা দরজা খুলতে অনেক দেরী করেছিলেন। দেরি করেছিলেন বলে তাকে বেশি আঘাতও করা হয়েছিল। রাইফেলের আগায় লাগানো বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে উনার দুই হাতের দুই বাহুকে থেঁতলিয়ে দেয়া হয়েছিল। রাতের অন্ধকারে গ্রামের পাশে সরকারি মাটির সড়কে তাঁদের ওপর ফায়ার করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শী আবু চাঁন থেকে আমরা এসব জেনেছিলাম। আবু চাঁনকেও ওরা বেঁধেছিল কিন্তু ওর প্রতি বিশেষ নজর না থাকায় সবার পেছন থেকে রশির বাঁধ ধীরে ধীরে খুলে ফেলে এবং দ্রুত জঙ্গঁলের ভেতর প্রবেশ করে প্রাণ বাঁচায়! এখনও বেঁচে আছে সেই আবু চাঁন কালের সাক্ষী হয়ে!
৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটির কথা আমাদের গ্রামের সাধারণ মানুষ হারুণ ভাইর মুখেই প্রথম জেনেছে। হারুণ ভাই তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র এবং গ্রামের একমাত্র উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তি। এখন অবশ্য অনেক শিক্ষিত সজ্জন ব্যক্তি আমাদের গ্রাম থেকে বেরিয়ে দেশ এবং বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান করছেন। গ্রামের মধ্যে একমাত্র হারুণ ভাই-ই ছিলেন ঐতিহাসিক ভাষণটির প্রত্যক্ষদর্শী। যুদ্ধ চলাকালীন প্রেক্ষাপটে গ্রামের মানুষ তাই হারুণ ভাইর কাছে জড়ো হতেন। বর্বর পাকিস্তানিদের প্রতিহত করতে ব্যাপক প্রস্তুতিমূলক দিক-নির্দেশনাও ছিল হারুণ ভাইর। কিন্তু লুটেরা, বেঈমান, দুস্কৃতকারীরা তাঁকে বাঁচতে দিল না। এ হত্যাকান্ডের ফলে সারা গ্রামে শোকের ছায়া এবং হতাশা নেমে এসেছিল। 
স্বাধীনতা অর্জনের ৪৭ বছর পরও আজ সেসব কথা মনে পড়ছে। কারণ মহান মুক্তিযুদ্ধ যেমন আমাদের অনেক ত্যাগের, তেমনিভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গৌরবেরও। মহান মুক্তিযুদ্ধে অনেকেই যেমন প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছেন তেমনি পরোক্ষভাবেও অংশগ্রহণ রয়েছে অনেকে। জাতি চিরদিন তাই মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মনে রাখবে। ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটিও জাতি চিরদিন মনে রাখবে। তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ভুখা-নাঙ্গা জাতিকে জাগিয়ে তোলার জন্য বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত এ ভাষণটি ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এ ভাষণটিতে জাতি সোনার বাংলাদেশ গড়ার দিক-নির্দেশনা পায়, স্বাধীনতা অর্জনের শক্তি, সাহস, প্রেরণা পায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেদিন ৯মার্চ কৃষিবিদ ইন্সটিটিউশনে যথার্থই বলেছে-৭ই মার্চের ভাষণ কোনো লিখিত ভাষণ নয়, কোনো রিহার্সেল দিয়ে তৈরি করাও কোনো ভাষণ নয়। এ ভাষণ দীর্ঘ ২৩ বছরের লাঞ্ছনা-বঞ্চনা ও প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর। এ ভাষণের আবেদন তাই যুগ যুগ ধরে থাকবে। 
ইউনাইটেড নেশনস এডুকেশনাল, সাইন্টিফিক এন্ড কালচারাল অর্গ্যানাইজেশন (টঘঊঝঈঙ) ভাষণটির বিষয়বস্তু অনুধাবন করে গত বছর এ ভাষণটিকে স্বীকৃতি দিয়েছে। 
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এ ভাষণটি ছিল আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের বলিষ্ট কণ্ঠস্বর। ভাষণটির কথামতই আমরা যার যা কিছু ছিল তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করে শত্রুকে পরাজিত করতে পেরেছি। অথচ পরবর্তীতে এ ভাষণটিকে আমরা নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছি শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে। ১৯৭৫ থেকে ২১ বছর তাই নতুন প্রজন্মের কাছে ভাষণটির আবেদন-নিবেদন তুলে ধরা যায়নি। ফলে নতুন প্রজন্ম এখনও বিভ্রান্তি কাটিয়ে উঠতে পারছেনা। স্বাধীনতার ঘোষ-ঘোষির বিতর্কে নতুন প্রজন্মকে এখনও পড়ে থাকতে হচ্ছে। অথচ স্বাধীনতার মূল ভিত্তি, মূল ঘোষণা এসেছে ৭ মার্চের ভাষণ থেকেই। ওই ভাষণেই বলা আছে, ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি....তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করো।’ সে ভাষণেই বজ্র নির্ঘোষ কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত: ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম.....এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’-কবিতার ছন্দের মতো এ বলিষ্ট আহ্বান যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য আমাদের উদ্বুদ্ধ করে, প্রেরণা যোগায়। তৎকালীন সেক্টর কমান্ডার জেড গ্রুপের মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর স্বপক্ষে যে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি : ‘ও, গধলড়ৎ তরধ, ফড় যবৎব নু ফবপষধৎব ঃযব রহফবঢ়বহফবহপব ড়ভ ইধহমষধফবংয ড়হ নবযধষভ ড়ভ ড়ঁৎ মৎবধঃ হধঃরড়হধষ ষবধফবৎ ইধহমধনধহফযঁ ংযবরশয গঁলরনঁৎ জধযসধহ-’ পাঠ করেছিলেন এ দেশের বীর বাঙালি সে ঘোষণার অপেক্ষা করেনি বা সে ঘোষণার জন্যেই শুধু যুদ্ধ করেনি। ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে পাক-হানাদার বাহিনী যখন নির্বিচারে এদেশের নিরীহ মানুষের ওপর গুলি চালায় তখন এদেশের মানুষ রুখে দাঁড়াতে বাধ্য হয়। শত্রুমুক্ত করতে এবং স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে অস্ত্র ধরে। সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের। 
এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের চিত্র আজ ভিন্ন। এতো বছরে ঠিক যেভাবে এগিয়ে যাবার কথা ছিল দেশটা ঠিক সেভাবে এগিয়ে যেতে পারেনি। সুবিধা বঞ্চিত মানুষেরা চিরদিন সুবিধা বঞ্চিতই থাকছে। এখনও অনেক মানুষকে ফুটপাতেই থাকতে হচ্ছে। অফিস-আদালতে ঘুষ-দুর্নীতি প্রতিযোগিতামূলকভাবে বেড়ে চলেছে। চোর, বাটপার, মিথ্যাবাদীর সংখ্যা আশংকাজনক হারে বাড়ছে। জাতির মেরুদন্ড শিক্ষাব্যবস্থায় প্রশ্নফাঁস সহ নানাবিধ সমস্যা চরমভাবে বিরাজ করছে। ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর কি অনেক শিশু-কিশোর আজ এতোটা বছরেও ঠিকভাবে বলতে পারে না, গুলিয়ে ফেলে!! সবচেয়ে বড় সমস্যা, রাজনীতি এখন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর হয়েছে। এখন বছরে ১০ হাজার কোটি টাকার অবৈধ ইয়াবা বাণিজ্য হচ্ছে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের কারণেই। 
কোনো সরকারই চিরদিন ক্ষমতায় থাকে না, থাকবেনা এবং থাকতে পারে না। দেশ পরিচালনার জন্য কোনো না কোনো দলকে সরকার গঠন করতে হয়। এক সরকারের পর আরেক সরকার-এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সরকার পরিবর্তনে প্রবলেম হচ্ছে বিগত সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ড নতুন সরকার এসে কন্টিনিউ মানে ধারাবাহিকতা বজায় রাখে না। আপট্রেন্ড ভেঙে দেশকে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়। বিগত সরকারের আপট্রেন্ড ভেঙে দেয়াই যেন নতুন সরকারের পুরনো সংস্কৃতি। আমরা এ সংস্কৃতির অবসান চাই। আমরা চাই ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জ্বরা, অগ্নি¯œানে সূচি হোক ধরা।’ দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণকর, মঙ্গলময় বার্তা এবং সুস্থধারার সংস্কৃতি-ই আমাদের কাম্য। সাত মার্চের ভাষণ আমাদের ঐতিহাসিক সংস্কৃতি। নতুন প্রজন্মের কাছেও এ ভাষণটি পুরনো চাওয়া-পাওয়ার এক নতুন সংস্করণ। সাত মার্চের ফলে একটা স্বাধীন দেশ-বাংলাদেশ অর্জিত হয়েছে, তাতেই বা কম কি?
লেখক : কলামিস্ট।

SUMMARY

1878-1.png