১৯৭১ সালের ৭ মার্চ আমি ঢাকাতে তো ছিলামই না, তৎকালীন কোন জেলা, মহকুমা বা থানা সদরেও ছিলাম না। ৭ মার্চ ছিলাম সুনামগঞ্জ মহকুমার শাল্লা থানার আঙ্গাউড়া গ্রামে। ঐ গ্রামের গিরিধর হাইস্কুলের প্রতিষ্ঠাতা মহোদয়ের দু’তলা বিল্ডিং-এর দু’তলাতে থাকতাম। ৭ মার্চও ছিলাম। রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ চলছে। দু’তলায় বসে ভাষণ শুনছিলাম। চারদিকে উন্মুক্ত মাঠ। মাইলের পর মাইল হলুদ ধানের ক্ষেত। স্বচক্ষে না দেখলে ভাটি বাংলার ধান ক্ষেতের অপরূপ রূপ কারো পক্ষে অনুধাবন করা সত্যিই মুস্কিল। ধানের ক্ষেতে কি যেন এক ঢেউ খেলে যায়। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে শুনতে মাঠের দিকে দৃষ্টি দিতেই দেখা গেল অন্য এক রূপ। জন¯্রােত। মাঠে-ঘাটে ধানক্ষেতে শুধুই মানুষ আর মানুষ। সবার হাতে কাস্তে-কুদাল-লাঠিসহ আরো কতো কি। বঙ্গবন্ধুর সেই নির্দেশ “তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে” এর মতোই যেন সবাই তৈরী। এদেশের রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রাম, মিটিং-মিছিল সবই দেখেছি রাজধানীসহ বিভিন্ন শহর-বন্দর কেন্দ্রীক। এর আগে এমন জনসমুদ্র কখনো দেখেনি ভাটিবাংলার হাওরে হাওরে। ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ এমনি অনেক সুদৃঢ় আওয়াজে বাংলাদেশের ফসলের মাঠ মুখরিত হতে কখনো দেখিনি। যেমনি দেখেছি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনার সাথে সাথে।
এখানে আর একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, ১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামীলীগ, ন্যাপ, মুসলিম লীগ, পিডিপিসহ অনেক রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করেছিলো। আর সে নির্বাচনে ‘দিরাই-শাল্লা’ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন ন্যাপ-এর প্রার্থী সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত। অর্থাৎ জনগণ নৌকা মার্কায় ভোট না দিয়ে ‘কুঁড়ে ঘর’-এ ভোট দিয়েছিলেন। অন্যান্য দলের প্রার্থীরাও কিছু কিছু ভোট পেয়েছিলেন। একেক দলের একেক রকম রাজনৈতিক বক্তব্য ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর সব কিছু পাল্টে গেল। সবার মুখে একই ধ্বনি ‘জয় বাংলা’। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বঙ্গবন্ধুর বজ্রকন্ঠের মতো প্রতিটি বাঙালির কন্ঠে ধারণ করতে দেখা গেলো। অবশ্য গুটিকয় পাকি প্রেমীর কথা আলাদা।
আমরা যখন শরণার্থী হয়ে ভারতের মেঘালয় রাজ্যে আশ্রয় নিলাম, সেখান থেকে বঙ্গবন্ধুর ডাকে বাংলার দামাল ছেলেরা অস্ত্র হাতে তুলে নিল, আমরা মুক্তিযোদ্ধা হলাম তখন দেখেছি শিলং-গৌহাটির জনগণ আমাদেরকে পূর্ব পাকিস্তানের লোক বলেননি। তখন আমাদের একটাই পরিচয়-জয় বাংলার লোক। অর্থাৎ জয় বাংলা তখন শুধুই বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বের কাছেই পরিচয় হয়ে গেলে আমাদের ‘জয় বাংলার লোক’ এবং এর পেছনে একটিই কথা এবং শেষ কথা হলো বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ। বাঙালি জাতির মুক্তি সনদ বঙ্গবন্ধুর কন্ঠে উচ্চারিত সেই রাজনৈতিক কবিতা-বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ। আর ৭ই মার্চের পর থেকেই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আর কোন দলের রইলো না। হয়ে গেল বাংলাদেশের সকল বাঙালির। এ ভাষণের গর্ভ থেকেই জন্ম নিল বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু রইলেন না আর কোন দলের, হয়ে গেলেন সমগ্র জাতির সম্পদ। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি হলো বিশ্ব সম্পদ। যেমনি সম্পদ আমাদের ২১ শে ফেব্রুয়ারি। স্বীকৃতি পেল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের।
আজ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ইউনেস্কোর মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টারে স্থান পেলো। পৃথিবীর ৪২৭টি অতি গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট জাতিসংঘে সংগৃহীত রয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের এই ৪২৭টি ডকুমেন্টের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণটির যুক্ত হওয়া সে তো আর একটি ইতিহাস। আর একটি গৌরব গাঁথা ঐতিহাসিক ঘটনা। আমাদের জন্য তো বটেই, আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্যও এক বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ ঘটনা। এতে করে আর কখনো কারো পক্ষে বাংলাদেশের মুক্তি এবং স্বাধীনতার সংগ্রামের ইতিহাস বিকৃতির কোন সুযোগ রইলো না। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটিই যে প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা, জাতির দিক নির্দেশনা এতে দেশি-বিদেশি কারো পক্ষে অস্বীকার করার কোন প্রকার অজর-আপত্তির অবকাশ রইলো না। বাঙালি জাতির সম্পদ আজ বিশ্ব সম্পদে পরিণত হলো বাঙালির জন্য এটা আর এক বিজয়। এ বিজয় ১৬ই ডিসেম্বরের মতোই জাতির বিজয়। এখানে কোন সঙ্কীর্ণতা, কুপমন্ডুকতার স্থান নেই। তাই এ ক্ষেত্রে দলমত নির্বিশেষে উদারতাই দেশপ্রেমের প্রতীক। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তি আর স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের বহিঃ প্রকাশ তখনই ঘটবে যখন আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে ইউনেস্কোর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো। তাদেরকে অন্তর থেকে ধন্যবাদ জানানো। আমরা প্রমাণ করবো জাতি হিসেবে আমরা কখনো অকৃতজ্ঞ নই।
কিন্তু মাঝে মাঝে হতাশ হতে হয় যখন এর ভিন্নতা দেখা যায়। ১.১১.২০১৭ তারিখের দৈনিক জনকন্ঠের একটি বাক্সবন্দী খবরের শিরোনাম “৭ মার্চের ভাষণ বিশ্ব ঐতিহ্যের দলিলের স্বীকৃতি পাওয়ায় আওয়ামী লীগের কৃতজ্ঞতা।” এই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সঠিক কাজটিই করেছে আওয়ামীলীগ। এর জন্য আওয়ামী তথা আ’লীগের নেতৃবৃন্দকে ধন্যবাদ জানানোর কোন দরকার পড়ে না। কারণ এটা আওয়ামীলীগের দায়িত্ব এবং কর্তব্য বটে। সাথে সাথে প্রশ্ন আসে-এ দায়িত্ব তো শুধু আ’লীগেরই নয়। একাত্তর সালে যেসব রাজনৈতিক দল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল এবং বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের আহবানে সাড়াদিয়ে তাদের নেতাকর্মীদের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে নির্দেশ দিয়েছিল আর সবাই এক সাথে পাকিদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সেই সমস্ত দল সমূহকেও তো গভীর আগ্রহভরে ইউনেস্কোর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো সমীচিন ছিল। শুধু তাই নয়, যে সমস্ত দল মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিল এবং স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে মেনে নিল এবং ১৯৭১ এর পর যেসব রাজনৈতিক দলের সৃষ্টি হলো তাদের সবার কাছেই তো বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণটি শ্রেষ্ঠ সম্পদ। যে সম্পদ আজ বিশ্ব সম্পদ হিসেবে স্বীকৃতি, লাভ করলো তাকে বাংলাদেশের সম্পদ হিসেবে স্বীকার না করার তো কোন যুক্তি নেই। যদি তাই হয় তাহলে তো ইউনেস্কোকে ধন্যবাদ জানানো এবং ইউনেস্কোর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো সবার জন্যই যুক্তিযুক্ত। আর ঐক্যবদ্ধভাবে ইউনেস্কোকে ধন্যবাদ জানালে আমাদের জাতীয় ঐক্য শক্ত হবে। বিশ্বে আমাদের মর্যাদাও বৃদ্ধি পাবে। আওয়ামীলীগ কৃতজ্ঞতা জানালো বলে অন্যরা এর থেকে বিরত থাকবেন তাতো হতে পারে না। তবে এক্ষেত্রে উদারতা সবার কাছ থেকেই কাম্য।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ এ সবই আমাদের জাতীয় সম্পদ। আমাদের সবার চিন্তা-চেতনা-মননে-মানসে এই বিশ্ব সম্পদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হলেই আমাদের জাতীয় ঐক্যে সুবাতাস বইবে। জাগ্রত হবে আত্মমর্যাদাবোধ। আমাদের সকলকে গর্বিত চিত্তে নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করতে হবে-সারা বিশ্বে এমন অমূল্য সম্পদ ক’জনার আছে?
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা কলামিস্ট।