রক্ত দিয়ে কেনা স্বাধীনতা-ঝরনা বেগম


ব্রিটিশ শাসকরা আমাদের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে বিপথে পরিচালিত করে কৃত্রিম পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিল। আর পাকিস্তানের শাসকরা সা¤্রাজ্যবাদী নয়া ঔপনিবেশিক শোষণ অব্যাহত রাখার পাশাপাশি নিজেরাও বাঙালির ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল নির্মম ও তীব্র জাতিগত শোষণের এক্সট্রা বোঝা। বিজাতীয় শোষণের জাঁতাকলে পিষ্ট বাঙালি তাঁদের এই করুণ পরিণতি মেনে নেয়নি। ধীরে ধীরে তাঁরা গড়ে তুলেছিল গণপ্রতিরোধ। ভাষা, ভোটাধিকার, গণতন্ত্র, শোষণমুক্তি, সা¤্রাজ্যবাদের শৃঙ্খলের অবসান ইত্যাদি নানা দাবিতে রচিত হয়েছিল বীরত্বপূর্ণ আন্দোলনের উজ্জ্বল অধ্যায়।
স্বাধীনতা মানুষের আজন্ম পিপাসা। আর এ পিপাসা থেকেই জন্ম নেয় সংগ্রামই চেতনার। এই সংগ্রামই চেতনাবোধই মানুষের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির পথকে সুগম করে এবং স্বাধীনতা অর্জনে উদ্বুদ্ধ করে। ’৭১-এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১০ লাখ লোকের ঐতিহাসিক সমাবেশে ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ঘোষণার পর আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ হয় ২৬ মার্চ। পাকিস্তানি হানাদারদের অত্যাধুনিক অস্ত্রের কাছে এদেশের মুক্তিকামী বাঙালিরা লাঠি, ফলা, তীর-ধনুকসহ হালকা ধরণের অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তবে তাঁদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র ছিলো মনোবল।
জনগণের অধিকার আদায়ের বহুমুখী সংগ্রামী কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ গড়ে ওঠে বহু আগে থেকে, বছরের পর বছর ধরে। ব্রিটিশ আমলে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালিসহ গোটা ভারতবাসী যে সংগ্রাম করেছিল, তাও ছিল আমাদের মুক্তি সংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সূর্যসেন, ক্ষুদিরাম, প্রীতিলতা, বাঘা যতীনসহ যাঁরা অকাতরে জীবন দিয়ে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন, তাঁদেরও মুক্তি সংগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা বলে বিবেচনা করা উচিত।
১৯৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালিরা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও গণরায় অনুযায়ী ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিস্তানি শাসকরা ’৭১-এ সংঘটিত করেছিল নিষ্ঠুরতম গণহত্যা। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কামান, বন্দুক, মর্টার, ট্যাংক, জঙ্গিঁ বিমান ইত্যাদি দিয়ে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামকে রুদ্ধ করা যায়নি। সশস্ত্র প্রতিরোধে গর্জে উঠেছিল সাড়ে সাত কোটি বাঙালি। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে উঠেছিল। বাঙালির সে লড়াই হঠাৎ শুরু হওয়া কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ছিলো না। তা ছিলো দীর্ঘকাল ধরে পরিচালিত সা¤্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের ধারায় পরিচালিত। অর্থাৎ মার্চে শুরু হওয়া সশস্ত্র প্রতিরোধের নয় মাসের পর্বটি ছিলো বহু বছর ধরে চলতে থাকা জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের শীর্ষ অধ্যায়। 
’৭১-এর মার্চ মাস হয়ে উঠল রক্ত ঝরা মার্চ। মার্চের শেষ ক’দিন আমরা দার্শনিক ড. জি সি দেব, ড. জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতাসহ অনেক শিক্ষক, বুদ্ধিজীবীকে হারালাম কিন্তু তার দ্বারা বাংলাদেশের জনগণকে প্রতিহত করতে পারলো না পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসক গোষ্ঠির লেলিয়ে দেওয়া সেনাবাহিনী। পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ ও নিপীড়নে নিষ্পেষিত বাঙালি জাতি মুক্তির লক্ষ্যে দীর্ঘ নয় মাসের সংগ্রামের মাধ্যমে এক রক্তক্ষয়ী পথ পাড়ি দিয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনলো। তারপর থেকে আমাদের নিরন্তর পথ চলা শুরু।
অনেক রক্তের বিনিময়ে, অনেক ত্যাগের মধ্য দিয়ে আমরা লাভ করেছি বাংলাদেশের স্বাধীনতা। সে-ই স্বাধীনতা নামের পাখিটি নিঃশংক চিত্তে ডানা মেলুক অপার সম্ভাবনার আকাশে। স্বাধীনতা উল্কাপিন্ডের মতো ক্ষণস্থায়ী নয়, ধূমকেতুর মতো হঠাৎ আবির্ভাব নয়, বাঙালির হৃদয়ে নক্ষত্রের মতোই পরিক্রমায় স্বাধীনতা থাকবে। বঙ্গবন্ধুর সেই অমর ভাষণ থাকবে। শুধু এই প্রজন্মের জন্য নয়, আরও শত বছর পরেও এদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব গাঁথা লোকের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়ে প্রজন্মকে প্রেরণা দিয়ে যাবে। আমরা যেভাবেই সকাল দেখি না কেন সূর্য কিন্তু একটাই। তাই প্রজন্মের পর প্রজন্ম আসুক না কেন স্বাধীনতা কিন্তু একটাই। 
রক্ত দিয়ে কেনা আমাদের বাংলাদেশের ঠিকানা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা। এই প্রজন্মের মাঝে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতা যেন স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়ে থাকে। অর্থাৎ ¯িœগ্ধতায় ফুটুক স্বাধীনতার সবুজ ফুল। পত্ পত্ করে বাতাসে উড়–ক বাংলাদেশের পতাকা। স্বাধীনতার পরিপূর্ণতা অর্জনের পথে আমাদের সকল সীমাবদ্ধতাগুলো দূর হোক। স্বাধীনতা উপভোগ করি আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে। 
লেখক : আইনজীবী, কলামিস্ট।

SUMMARY

1876-1.png