বলা হয়-অস্ত্রের চেয়েও শক্তিশালী হচ্ছে জনমত। আর জনমতের পেছনে থাকে মনোবল ও প্রেরণা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের অনুষ্ঠানমালা ছিল সেই প্রেরণা ও মনোবলের উৎস। রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রযাত্রায় অমূল্য অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র। মুক্তিকামী স্বদেশে অবরুদ্ধ জনগণকে দিয়েছে অভয় বাণী, যুগিয়েছে সাহস ও বিশ্বাস। এভাবে স্বাধীন বাংলা বেতার আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অনিবার্য অঙ্গ হয়ে আছে। যুদ্ধের সময় প্রচারিত অনুষ্ঠান আজও প্রবীণদের স্মৃতিতে সজীব রয়েছে।
পাকিস্তান আমলে আজকের মতো গণমাধ্যমের এত বৈচিত্র্য ছিল না। শিক্ষার হারও ছিল কম। বেতার তখন সহজ মাধ্যম। তাই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বেতার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আমাদের বিজয় ত্বরান্বিত করেছে। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র ছিল একটি অস্থায়ী সম্প্রচারকেন্দ্র। মুক্তিযুদ্ধে সাহস জোগানো এবং একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই ছিল এর লক্ষ। এ লক্ষ অর্জনে কার্যকর ভূমিকা পালন করে অস্থায়ী বেতারকেন্দ্রই ইতিহাসে স্থায়ী চিহ্ন রাখতে সক্ষম হয়েছে।
১৯৭১ এর ২৫ মার্চ রাতে হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র জনগণের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু করে গণহত্যা। এমনি দুঃসময়ে রেডিও পাকিস্তান চট্টগ্রাম কেন্দ্রের স্ক্রিপ্ট রাইটার বেলাল মোহাম্মদ, ফটিকছড়ি কলেজের উপাধ্যক্ষ আবুল কাসেম এবং কয়েকজন বেতারকর্মী এক সাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু এবং স্বাধীনতার পক্ষে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে বেতারের মাধ্যমে কিছু প্রচার করতে চান তাঁরা। এর প্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম বেতারকেন্দ্রকে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে এর নাম দেন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতারকেন্দ্র। তবে নিরাপত্তার কারণে আগ্রাবাদ কেন্দ্রের পরিবর্তে শহর থেকে কিছু দূরে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে চলে যান। ২৬ মার্চ সন্ধ্যা ৭-৪০ মিনিটে প্রথম প্রচার শুরু করেন। এ কেন্দ্র থেকেই বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হয়। নাম থেকে বিপ্লবী শব্দটি বাদ দেয়া হয়। কেন্দ্র চালুর পর চট্টগ্রাম কেন্দ্রের কয়েকজন কর্মী যোগ দেন। প্রথমে কালুরঘাট, পরে আগরতলা এবং তৃতীয় পর্যায়ে মুজিবনগর সরকারের অধীনে কোলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের একটি বাড়ি থেকে কার্যক্রম পরিচালিত হয়। প্রবাসী সরকারের আবেদনে ভারত একটি শক্তিশালী ট্রান্সমিটার ৫০ কিলোওয়াট মিডিয়াম ওয়েভ প্রদান করে। ২৫ মে থেকে সুষ্ঠু এবং নিয়মিত অনুষ্ঠান প্রচার হতে থাকে।
সেই সময়টি ছিল দেশবাসীর জন্য বড়ই দুঃসময়। স্বদেশে সবাই অবরুদ্ধ। স্বজন, কারো ছেলে, কারো পিতা বা স্বামী ও ভাই গেছে মুক্তিযুদ্ধে। নেই যোগাযোগ। এদিকে দেশে স্থানে স্থানে চলছে হত্যা নির্যাতন। হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসররা চালাচ্ছে লুণ্ঠন। মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িঘরে আগুন দিচ্ছে। কেউ জানে না-এই দুঃসহ অন্ধকার কখন কিভাবে দূর হবে। যার ডাকে শুরু হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ, সেই নেতা বঙ্গবন্ধু ও কোথায় আছেন, কেমন আছেন জানে না মানুষ। সভা-সমাবেশ করে নেতারা আশার বাণী শোনাবেন-এটি কল্পনাও করা যায় না। কে শোনাবে আশার বাণী? এমনি অবস্থায় মানুষ প্রতিদিন অধীর আগ্রহে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের অনুষ্ঠান শোনার জন্য অপেক্ষা করতো। সংবাদ শোনার জন্য সেই সময়ে যে প্রবল আগ্রহ ছিল তা অতীতে এমনকি পরেও আর দেখা যায়নি। প্রচারিত সংবাদ মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়তো। বেতার শোনা হতো লুকিয়ে, সতর্ক হয়ে। কারণ হানাদার বাহিনী জানতে পারলে আর রক্ষা ছিল না।
স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের অনুষ্ঠানমালা ছিল সুপরিকল্পিত এবং অত্যন্ত সময়োপযোগী। যুদ্ধকালীন সেই শব্দ তরঙ্গ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তো সর্বত্র। শুধু সংবাদ নয়-ছিল বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠ, রক্তস্বাক্ষর, দর্শন, জাগরণী ঐকতান, ‘চরমপত্র’ শীর্ষক অনুষ্ঠান। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, ভাষণের অংশ বিশেষ এবং এম আর আখতার মুকুলের লেখা ‘চরমপত্র’ সহ দেশাত্মবোধক গান শ্রোতাদের উদ্দীপ্ত করতো। মুক্তিযোদ্ধাদের রণাঙ্গনে যোগাতো সাহস। ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ সংগীতটি ছিল বেতারকেন্দ্রর সূচনা সংগীত।
স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র ঐ সময়ের প্রয়োজন পূরণে যথাযথ ও কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। শব্দসৈনিকদের মেধাকে সঠিকভাবে সর্বোচ্চ মাত্রায় ব্যবহার করেছে। হানদার বাহিনীর মর্টার, মেশিনগান ও বন্দুকের গুলির মোকাবেলায় শব্দাস্ত্র দিয়ে মানুষকে স্বাধীনতার পক্ষে উদ্বুদ্ধ করেছে। হাজার হাজার সৈন্য, আধুনিক সমরাস্ত্র হাতে বন্দি শিবিরে পরিণত করেছিল বাংলাদেশকে অবরুদ্ধ দেশবাসীর মনে সংশয় সন্দেহ প্রায়ই উঁকি দিয়েছে। সত্যিই কি দেশ স্বাধীন হবে? মুক্তিযোদ্ধারা কি বিজয়ী হতে পারবে? এসব প্রশ্নের উত্তরে বেতারকেন্দ্রের অনুষ্ঠানমালা, সংগীত, খবর ও বিচিত্র কথামালা দিয়েছে সাহস। মুক্তিযোদ্ধারাও জান বাজি রেখে লড়াই করতে অনুপ্রাণিত হয়েছে। যার ফলে আমাদের বিজয় ত্বরান্বিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র প্রমাণ করেছে সমরাস্ত্রের চেয়ে শব্দাস্ত্রের শক্তি কোনো অংশেই কম নয়।