আমরা এখন যে ভূখন্ডে বাস করছি, চার দশক আগে হঠাৎ করে আকাশ থেকে সেটি খসে পড়েনি নিশ্চয়। এই ভূখন্ড হাজার বছর আগেও এই স্থানেই ছিলো। এই পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, সুরমা ছিলো। একই আকাশ ছিলো। পাহাড়-পর্বত ছিলো। নতুন করে কিছুই সৃষ্টি হয়নি। ১৯৭১-এ এই ভূখন্ডের জন্যে আমরা নির্ধারণ করলাম একটি নাম ও পতাকা। রক্ত নদী পেরিয়ে ১৬ ডিসেম্বর থেকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আভির্ভূত হলো বাংলাদেশ।
এই ভূখন্ড আর পতাকার নামই কি তবে স্বাধীনতা! নিশ্চয় নয়। একটি ভূখন্ড আর স্রেফ পতাকাকেই স্বাধীনতা হিসেবে মেনে নিলে পুরোটা বলা হয় না। এমনটা হলে, ভূমি ও পতাকা থাকার পরও দশকের পর দশক ধরে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির জন্যে ফিলিস্তিনী জনগণকে ইসরাইলের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত লড়াই করতে হতো না। নিজ ভূমিতে বসবাসের পরও স্বাধীনতার আকাঙ্খা জাগতো না ভারতের কাশ্মিরবাসী ও শ্রীলঙ্কার তামিলদের অন্তরে। মাথা গোঁজার এক টুকরো জমি আছে বলেই গ্রামের সুবাস চন্দ্রকে আমরা যে কারণে বিত্তশালী বলি না, একই কারণে ভূখন্ডের ‘মালিকানা’কেই স্বাধীনতার সংজ্ঞায় আখ্যায়িত করা যায় না। স্বাধীনতা এর চেয়ে বেশি কিছু। তবে স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্যে ভূমির মালিকানা ও নাম অনস্বীকার্য। তার প্রতিনিধিত্বের জন্যে একটি পতাকাও সমান গুরুত্বের।
অঙ্কে যারা ভালো তারা হয়তো বলেবেন, ভূমি+পতাকা= (‘সমান’) স্বাধীনতা। কিন্তু আমরা এক এক করে গুণতে চাই। এক ভূমি, দুই পতাকা এবং তৃতীয় প্রত্যাশা স্বাধীনতা। এই তিনে মিলে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। ‘‘ভূমি+পতাকা ‘সমান’ স্বাধীনতা’’র ফাঁকিতে আটকে থেকে; আমরা অঙ্ক শেখার তৃপ্তি পেতে চাই না। ৭১-এ লাখো প্রাণ আর ইজ্জতের বিনিময়ে প্রথম দুটো অর্জন করেছি ঠিক, কিন্তু এখনো নাগালের বাইরে রয়ে গেছে স্বাধীনতা। স্বাধীনতা মানে তো ‘স্ব+অধীনতা’। আমরা কি সত্যিকার অর্থে এখনো নিজেদের অধীনে আসতে পেরেছি! পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়েছি? পশ্চিম পাকিস্তানের অধীনতা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যেই তো আমার দেশের কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-শিক্ষক, ব্যবসায়ী-রাজনীতিক, সাহিত্যিক-সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী-পুরোহিত, ওলামা-মাশায়েখ জীবনবাজী রেখেছিলেন। নারী-পুরুষ অকাতরে প্রাণ দিয়েছিলেন। কিন্তু এর বিনিময়ে ‘পুরনো’ ভূখন্ডের সঙ্গে লাল-সবুজের পতাকা ছাড়া; যে লক্ষে মুক্তিযুদ্ধÑ সেই স্বাধীনতা কি আমরা পেয়েছি! নাকি এক পাকিস্তানের কবল থেকে মুক্ত হয়ে, হাজারটা পাকিস্তানের শৃঙ্খলে বাঁধা পড়েছি?
চিন্তার স্বাধীনতার কথা বলি, অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলি, জীবন-জীবিকার অধিকারের কথা বলি কোন ক্ষেত্রে স্বাধীনতার পূর্ণ সুফল আমরা পাচ্ছি? রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণ, অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, বিদেশের সঙ্গে সম্পর্কÑ এসবে পুরোপুরো স্বাধীনতা আসেনি মোটেই। আমরা এখনো আমাদের মত করে বলতে, চলতে পারি না। আমরা এখনো পারি না আমাদের উন্নয়নে জনগণের মতামতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে। গ্রামের মেঠো পথের সংস্কার ও ঋণসহযোগিতার নামে খবরদারি করে বিদেশি রাষ্ট্র ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য ‘লোক দেখানো’ নির্বাচন হয় ঠিকÑ তবে কারা সরকার গঠন করবে তার সিদ্ধান্ত আসে দেশের বাইর থেকে। আর এর সুযোগ করে দেয় আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোই। ‘বিদেশি প্রভুদের’ নানা নেয়াজ-নজর দিয়ে নিজেদের দিকে তাদের দৃষ্টি ফেরাতে কোনো দলই কসুর করে না। এতোদিন একেক দল একেক দেবতার আরাধনায় থাকলেও এখন আর সেটিতে আটকে নেই তারা। এক দেবতায় কাজ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে গেছে বলেই খোলস পাল্টেছে সকলে। এখন এক সঙ্গে সব দেবতাকে তুষ্ট করতে বেচাইন রাজনৈতিক দলগুলো। প্রত্যেকেই চায় ডান-বাম, সামন-পিছন, ভারত-আমেরিকা, ইংল্যান্ড-কানাডা, চীন-রাশিয়া; সরকারে ফিরতে সকলে কেবল তাকেই সমর্থন করুক। রাজনৈতিক দলগুলোর এমন স্বেচ্ছা দাসত্বের পরও নির্বাচন নিয়ে বিদেশিরা সন্তুষ্ট হতে না পারলে, তারাই সিদ্ধান্ত নেয় দেশে কখন, কবেÑ সেনাশাসন জারি হবে। আমাদের মত রাষ্ট্রগুলোর সেনাপ্রতিষ্ঠান সামগ্রিকভাবে দেশের জন্য আন্তপ্রাণ হলেও তাদের মধ্যে এমন অনেকই থেকে যায়, যারা রাষ্ট্রের প্রতি নিজের অঙ্গীকার ও কর্তব্য ভুলে; পরাশক্তির নির্দেশ পালনের অদৃশ্য শপথই বেশি অনুসরণ করেন। বৈশ্বিক সুযোগ-সুবিধা হাতছাড়া করতে চান না বলেই সে শপথের অন্যথা কখনো তারা করেন না।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অনিবার্য ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে জীবন দিয়েছেন। জীবন দিয়েছেন জেনারেল জিয়াউর রহমানও। এছাড়া দীর্ঘসময় দেশে সেনাশাসন চলেছে। গণতান্ত্রিক পক্রিয়ায় দেশ পরিচালনা শুরুর পর থেকে প্রতিটি নির্বাচনকে ঘিরেই রাজপথ উত্তপ্ত হয়েছে। হরতাল-অবরোধ হয়েছে। মানুষ খুন হয়েছে। একটি বেসরকারি সংস্থার হিসেব বলছে, ১৯৯১ থেকে ২০১৩ অক্টোবর পর্যন্ত আড়াই হাজারের অধিক লোক রাজনৈতিক হিংস্রতার বলি হয়েছেন। এই পরিসংখ্যান এক পেশেও যদি ধরা হয়, তবু প্রশ্ন, কেনো এতোজন মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নেওয়া হলো? রাজনৈতিক এই প্রাণহানী ছাড়াও একমাত্র স্থল প্রতিবেশী ভারতের সীমান্ত রক্ষিবাহিনী বিএসএফের হাতে হাজারো বাংলাদেশি নিহত হচ্ছেন। দিনদিন এই নিহতের সংখ্যা বাড়ছে। যুদ্ধবিগ্রহ চলাকালেও যেখানে প্রতিনিয়ত প্রাণহানীর ঘটনা ঘটে না, সেখানে স্বাভাবিক অবস্থায় প্রতিবেশি রাষ্ট্র আমাদের নাগরিকদের ধরে নিয়ে নির্যাতন করছে। নির্ধিদ্বায় গুলি করে হত্যা করছে। এসবের কোনো বিচার কখনো হয়নি। বিচারের দায়বোধও করেনি কেউ। ফেলানী হত্যার দায়ে একমাত্র আসামির বিচার হলেও তাকে নির্দোষ বলে রায় দিয়েছে বিএসএফের আদালত। এ ব্যাপারে ভারতের উচ্চ আদালতে আপিল হলেও সেটির রায়ে ফেলানীর হত্যাকারীর শাস্তি হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই শূন্যের কোটায়। এই হলো স্বাধীন দেশের নাগরিকদের জীবনের নিশ্চয়তা। এছাড়া, সামাজিক অপরাধের কারণে অহরহ খুনোখুনির ঘটনা তো ঘটছেই। রাষ্ট্র এসব নিয়ন্ত্রণে মোটেই সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের কাছে প্রথম প্রত্যাশাই তো হলো নিরাপদে জীবনযাপন করার নিশ্চয়তা বিধান করা।
৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ যেসব কারণে হয়েছিলো তার অন্যতম ছিলো রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক বৈষম্য। এই অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যে পশ্চিম পাকিস্তান কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে একাই লড়তে হচ্ছিলো তাদের। তাই নিজেদের অধিকার আদায়ে কৃষক-শ্রমিক জনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তারা অর্থনৈতিক মুক্তি চেয়েছিলেন। সুখ-সমৃদ্ধি ও শান্তি চেয়েছিলেন। ‘‘কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে/ আমাদের সব দুঃখ জমা দেবো যৌথ-খামারে,/ সম্মিলিত বৈজ্ঞানিক চাষাবাদে সমান সুখের ভাগ/ সকলেই নিয়ে যাবো নিজের সংসারে।’’ (হেলাল হাফিজ : একটি পতাকা পেলে)।
স্বাধীনতার চার দশক পরেও কি সেই কথা রক্ষা হয়েছে? বৈজ্ঞানিক চাষাবাদে জনগণের জন্যে সমান সুখ সৃষ্টি হয়েছে? হয়নি। যারা সেটি করার কথা, তারা নিজেরাই সুখের বদলে নিয়ত অশান্তির কড়াইয়ে দ্বেষের জ্বালানি সরবরাহ করছেন। কিন্তু যে কৃষক খাবার পাচ্ছে না, পণ্যের ন্যায্য দাম পাচ্ছে না, শ্রমের মজুরি পাচ্ছে না তাদের কথা কেউ বলছে না। যে লাখ লাখ শিশু-কিশোর শিক্ষাবঞ্চিত তাদের দিকে কেউ তাকাচ্ছে না। ঘরে-বাইরে কোটি কোটি নারী অনিরাপদ যে জীবন পার করছে তাদের যন্ত্রণা নিবারণে এগিয়ে আসছে না কেউ। ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতার’ দাবিদারেরা ভিন্নমতকে উৎখাতের জিঘাংসা ব্যক্ত করছে। ভিন্নমতের মিডিয়া বন্ধের পদক্ষেপ নিতে রাষ্ট্রকে প্ররোচিত করছে। এসবই করা হচ্ছে ‘পছন্দের’ লোকদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে। দেশের সবশ্রেণী ও পেশার মানুষের কল্যাণে নয়।
রাষ্ট্রে ভিন্নমত থাকবেই। একে লালন ও বিকাশের পথ দিতে হবে। স্বাধীনভাবে চলার, বলার অধিকার যেমন দিতে হবে, তেমনি স্বাধীনতার নামে বল্গাহীনতাও নির্মোহভাবে রুখতে হবে। মানুষকে জানতে দিতে হবে সব কিছু। আলো ও আঁধারের পার্থক্য তাদের সামনে সম্পষ্টভাবে উপস্থাপন করতে হবে। ঠ্যাঙ্গানোর নীতি দিয়ে মানুষকে কখনো দমানো যায়নি। কখনো যাবেও না। কারণ দমে যাওয়ার ফিতরত মানুষের মধ্যে সৃষ্টিগতভাবেই রাখা হয়নি। আজ আপনি আকাশকে দমন করবেন। আকাশ একটি চরিত্র মাত্র। আরও হাজারটা আকাশ তার চিন্তাকে লালন করে যাবে। এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে অভিভাবকত্বের ভূমিকা নিতে হবে। সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। সব শ্রেণী ও পেশার নাগরিকদের চিন্তা-ভাবনায় ভারসাম্য রক্ষার কাজটি করতে হবে সুনিপুণভাবে। অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার পূর্ণ ক্ষমতা রাষ্ট্রের থাকা যেমন প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষা করা। মানুষের সামগ্রিক প্রয়োজন পূরণে সহায়তা করা। এসব যেকোনো মূল্যে রাষ্ট্রকে করতে হবে। রাষ্ট্রকে কখনো কারো দ্বারা প্রভাবিত হওয়া চলবে না। এটাই স্বাধীনতার মর্মস্পৃহা। বাংলাদেশে সেই স্বাধীনতা কবে আসবে?