মৃত্যুঞ্জয় বঙ্গবন্ধু!-ঝরনা বেগম

 
বাঙালি জাতি শত-সহ¯্র বছর ছিল অন্ধকারে। পরাধীনতার শিকলে বাঁধা। এই বন্দিদশা থেকে মুক্তি দিয়েছেন যিনি, জাতির ত্রাণকর্তা হিসেবে যাঁর আবির্ভাব তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর নেতৃত্বে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি স্থান পেয়েছে জাতির জীবনে। জাতিকে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি উপহার দিয়েছেন একটি স্বাধীন মানচিত্র, স্বাধীন দেশ। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কিছু বাঙালি পাষাণ-পিশাচদের হাতেই তাঁর জীবন প্রদীপ নিভে যায়। তো, তাতে কি হয়েছে? ৪৩ বছর সংগ্রাম করে, ত্যাগ স্বীকার করে তাঁরই মেয়ে আজ বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। পিতার সাহস ও দর্শন বুকে নিয়ে বিপুল মনোশক্তিতে ভর করে এগিয়ে যাচ্ছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা।
১৫ আগস্ট বাঙালির ইতিহাসে সবচেয়ে শোকাবহ দিন-জাতীয় শোক দিবস। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ভোরের কিছু পূর্বে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত দেশি-বিদেশি কুচক্রী মহলের ষড়যন্ত্রে একদল ঘৃন্য খুনি কর্তৃক ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসায় সংঘটিত হয় মানব ইতিহাসের এক নির্মম-পৈশাচিক হত্যাকান্ড! আর এই হত্যাকান্ডের নির্মম শিকার সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালির ইতিহাসের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ঘাতকদের প্রধান টার্গেট ছিলেন শেখ। কিন্তু তাদের নিষ্ঠুর বুলেট শিশু রাসেল সহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের উপস্থিত কোনো সদস্যকে রেহাই দেয়নি। গর্ভবতী মহিলাও তাদের হাত থেকে বাঁচতে পারেনি। তারা মাকে মেরেছে পেটের ভিতরে থাকা নিষ্পাপ বাচ্চাসহ। পশুকেও তারা হার মানিয়েছে! তাই সেদিন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে প্রবাহিত রক্ত¯্রােতে বাংলায় যেন প্রবাহিত হয় নতুন এক লোহিত সাগর। বাঙালির জীবনে রচিত হয় ‘গ্রিক ট্রাজেডি’র আরেক উপাখ্যান। আর আমাদের বঙ্গবন্ধু হয়ে যান সেই ট্রাজেডির ‘ট্রাজিক হিরো’।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছিল যে ঘাতকেরা তাদের পাঁচজনের ফাঁসি কার্যকর হলেও বাকিদের শাস্তি এখনো দিতে পারেনি বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুকে এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যাকারী ছয় ঘাতক এখনো পলাতক রয়েছেন বিভিন্ন দেশে। ২০১০ সালের ১৯ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত রায়ে ১২ জনের মৃত্যুদন্ড ঘোষিত হয়। এই ১২ জনের মধ্যে পাঁচজনের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। এই পাঁচজন হলেন-সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা, মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি) ও একেএম মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার)। এবং খুনি আজিজ পাশা’র স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু খুনি আব্দুর রশিদ, শরীফুল হক ডালিম, রাশেদ চৌধুরী, নূর চৌধুরী ও আব্দুল মাজেদ এখনো পলাতক।
এদিকে, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিবরণে জানা যায়, নূর চৌধুরী ও বজলুল হুদা সরাসরি বঙ্গবন্ধুকে গুলি করেন। সেই নূর চৌধুরীই কানাডায় পালিয়ে আছেন অনেক বছর ধরে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকে অনুরোধ করেছেন নূর চৌধুরীকে দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু হত্যার আরেক খুনি মোসলেহ উদ্দিন খান রয়েছেন জার্মানিতে। রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে, আব্দুর রশিদ পাকিস্তানে অথবা লিবিয়ায়, শরীফুল হক ডালিম পাকিস্তানে এবং আব্দুল মাজেদ সেনেগালে রয়েছেন বলে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। শোনা যায়, পলাতক খুনিদের জন্য ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারি করা আছে।
পরিতাপের বিষয় এই যে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে একটি সমস্যা হলো, খুনিদের আশ্রয়দাতা দেশগুলোর অনেক দেশই মৃত্যুদন্ডের বিরুদ্ধে। তাই বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য দরকার ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা। এমন সমস্যায় পড়তে হতো না মুজিব কন্যাদের! কারণ, ’৭৫-পরবর্তী সরকার বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিদেশে চাকরি দিয়ে পুরস্কার করেন। আর এই সুযোগে তারা পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক দর্শন সমকালীন ও প্রাসঙ্গিক। ইতিহাসের অমোঘ সত্য এই যে, যথার্থ ও প্রকৃত বীরের নাম ষড়যন্ত্র, অপশাসন এবং মিথ্যাচার করে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলা যায় না। ইতিহাস তাঁকে বুকে ঠাঁই দেয়। যে কারণে, ১৯৭৫-পরবর্তী প্রায় দুই যুগ শত চেষ্টা করেও বঙ্গবন্ধুর নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যায় নি। প্রগতিশীল, মুজিব সৈনিক বাঙালিরা তাঁদের মনে বঙ্গবন্ধুর স্থান চিরস্থায়ী করে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু দীর্ঘ একুশ বছর সংগ্রাম, সততা, সারল্য, দূরদৃষ্টি ও সুন্দর পার্সোনালিটি দিয়ে অর্জন করে ছিলেন প্রায় সকল বাঙালির ভালোবাসা ও আস্থা, বিশ্বাস। যার জন্য তিনি যেমন, বাঙালিদের বিশ্বাস করতেন, সাড়ে সাত কোটি বাঙালির প্রায় সকলেও তাঁকে বিশ্বাস করে ১৯৭০-এর নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে ভোট দিয়েছিলো। আর সেই বিপুল ভোটে নৌকা মার্কা জিতেছিল। বিজয় হয়েছিল আওয়ামীলীগের। একাত্তরের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুই হয়েছিলেন। আর কেউ নয়।
‘সেদিন আকাশে শ্রাবণের মেঘ ছিলো, ছিলো না চাঁদ! সেদিন আকাশে .... অর্থাৎ, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার রাতে আকাশ ও শোকে মূহ্যমান ছিলো বোধ হয়? যার কারণে, বৈরী আবহাওয়ায় খুনিদের মিশন শেষ হতে প্রায় ভোর হয়ে যায়। শেষ! শেষ!-বলে খুনিরা সে রাতে হয়তো উল্লাস করেছিলো!’ কিন্তু নিয়তি বড়ই নিষ্ঠুর! বঙ্গবন্ধু মরে গিয়েও আজ তাঁর সমর্থকদের কাছে অমর। অর্থাৎ, মৃত্যুঞ্জয় বঙ্গবন্ধু! কে বলে সে-ই ছোট্ট শেখ রাসেল-এর বাবা শেখ মুজিবুর রহমান নেই!
‘মুজিবর আছে / বাংলার ঘরে ঘরে / বাঙালির অন্তরে! / মুজিবর আছে / বাংলার ঘরে ঘরে .....।
জয় বাংলা! জয় বঙ্গবন্ধু!
লেখক : আইনজীবী, কলামিস্ট।

SUMMARY

1873-B2.jpg