কান্নার মাস-বেলাল আহমদ চৌধুরী

 
তুমিতো কেবল নওগো ছবি/ বাঙালি জাতির পিতা/ তোমার কথা ভুলিব কেমনে/ বুকে জমাট ব্যাথা।
আগস্ট এলেই বঙ্গবন্ধু ফিরে আসেন বাংলার ঘরে ঘরে। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া তিনি ফিরে আসেন বাঙালির হৃদয়ে হৃদয়ে। ১৫ আগস্ট জাতির জীবনে এক কলঙ্কময় দিন। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ১৫ আগস্টের ভোর রাতে বিশ্বাসঘাতকদের হাতে সপরিবারে শহীদ হন। ৪৩ বছরে পড়লো জাতি হারিয়েছে বঙ্গবন্ধুকে। পৃথিবী যতদিন থাকবে বাঙালির হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু ততদিন জীবিত থাকবেন।
টুঙ্গিপাড়ার খোকা, গোপালগঞ্জের মুজিব-কলিকাতা, দিল্লী, করাচি ছাপিয়ে সারা দুনিয়ার বঞ্চিত নিপীড়িত মানুষের হৃদয় জয় করে নিলেন। বঙ্গবন্ধু বলতেন- দুনিয়াতে দুই রকম মানুষ আছে। এক হলো ‘শাসক’, আর অন্য হলো শোষিত। আমি হলাম শোষিতের দলে।
ইতিহাস অত্যন্ত সবাক, ইতিহাস কথা বলে। মনে পড়ছে ১৯৪৭ সালের ৩রা জুন বৃটিশ সরকার ভারত ও পাকিস্তানকে স্বাধীনতা দানের কথা ঘোষণা করার পর পরই তিনি ইসলামিয়া কলেজের সিরাজদ্দৌলা হলে ছাত্র ও যুব নেতাদের নিয়ে বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। তিনি পূর্ব বাংলার মুসলিমলীগ বিরোধী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ছাত্র, যুবক ও রাজনৈতিক কর্মীদের সংগটিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এই সভায় শেখ মুজিব বিশ্লেষণ করে বলেছিলেন মুসলিমলীগ ধর্মকে হাতিয়ার হিসাবে গ্রহণ করলেও জনগণ চায় অর্থনৈতিক মুক্তি। আরও বলেছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য বাংলাদেশের পবিত্র মাটিতে যেতে হবে। কেননা আমার আশংকা হচ্ছে এ স্বাধীনতা সত্যিকারের স্বাধীনতা নয়। হয়তো বাংলার মাটিতে নতুন করে আমাদের সংগ্রাম শুরু করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর ভবিষৎ বাণী অক্ষরে অক্ষরে পূর্ণতা পেয়েছে।
ভাষা আন্দোলনে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ সকালে সেক্রেটারীয়েট গেটে পিকেটিং করে শেখ মুজিব জেলে প্রেরিত হয়েছিলেন। একটি জাতি অন্য জাতির উপর আধিপত্য করার ফলেই দু’দেশের সম্পর্কের অবনতি চরম আকার ধারণ করে। শেখ মুজিব ১৯৪৫ সাল থেকে ক্রামগত রাজনৈতিক সংগ্রামে লিপ্ত থেকে বহু বাধা বিঘœ ডিঙিয়ে অভিজ্ঞতার ভান্ডার সঞ্চয় করেছিলেন। তারই প্রতিফলন, আমাদের বাঁচার দাবী ৬ দফা কর্মসূচী। এই ৬ দফা তদানিন্তন পূর্ব বাংলার সাত কোটি শোষিত, বঞ্চিত মানুষের অন্তরে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল। ১৯৬৬ সালের ১৮ মার্চ ঢাকার মতিঝিলে ইডেন হোটেল প্রাঙ্গনে পূর্বপাকিস্তান কাউন্সিল অধিবেশনে আমাদের বাঁচার দাবি ৬ দফা কর্মসূচী দিয়েছিলেন। যা ছিল স্বায়ত্বশাসনের দাবী। 
১৯৬৮-৬৯ সালে আয়ুব বিরোধী গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। যার ফলে আয়ূবশাহীর পতন হয়েছিল। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বাংলার চিরন্তন বন্ধু শেখ মুজিব লাভ করেন “বঙ্গবন্ধু” উপাধি। ১৯৭০ এর নির্বাচনের মাধ্যমে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের নেতা হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। এই বিজয়ের পর থেকেই ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে সামারিক জান্তা ইয়াহিয়া খান ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিলে এর প্রতিবাদে পূর্ব বাংলায় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। ধানমন্ডির ৩২নং বাড়ীটি পরিণত হয় বৃটেনের প্রধানমন্ত্রীর ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের অনুরূপ। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে ১৯৭১ সালের ০৭ মার্চ তদানিন্তন রেককোর্সের ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী) জনসমুদ্রে জাতির উদ্দেশে স্বাধীনতার দিক নির্দেশনা পূর্ণ ঐতিহাসিক ভাষনে বলেছিলেন- যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। মনে রাখবেন রক্ত যখন দিয়েছি আরও দিব তবু এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইন্শাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
১৯৭২ সালের ১৪ এপ্রিল মন্ত্রীসভার বৈঠকে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রখ্যাত গান আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি এর প্রথম দশ চরণ বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসাবে গৃহীত হয়।
ধর্ম নিরপেক্ষে রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী হয়েও ১৯৭৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামী সম্মেলনে যোগ দান করেছিলেন। অমিত বিক্রম বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে খোলা-খোলিভাবে সা¤্রাজ্যবাদ বিরোধী বলিষ্ঠ বক্তব্য দিয়েছিলেন। সম্মেলনে বক্তৃতার পর ফিদেল ক্যাস্ট্রো বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন- ‘শেখ’ পৃথিবীময় আপনি শত্রু সৃষ্টি করলেন। এমনকি আমাদের মধ্যেও। অনেক দেশ নাম কাওয়াস্তে জোট নিরপেক্ষ, আসলে সামাজ্যবাদের লেজুড়। (শওকত ওসমান- ‘ইতিহাসে বিস্তারিত’) 
১৯৭৩ সালে ২৮ আগস্ট দিল্লীতে বাংলাদেশ ভারত নেতৃবৃন্দের সঙ্গে পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দ বৈঠকে মিলিত হন এবং এক চুক্তি বলে (দিল্লী চুক্তি নামে খ্যাত) আটক বাঙালিদের মুক্তি দানে স্বীকৃত হন এবং বিনিময়ে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী ছাড়া সকল সৈন্যকে তারা ফেরৎ পান। পাকিস্তানে আটক বাঙালিদের ফিরিয়ে আনার জন্যই ছিল বঙ্গবন্ধুর এত ব্যকুলতা।
অধ্যাপক রেহমান সোবহান লিখেছেন ১৯৭৪ সালের মে/২৯ পর্যন্ত মাত্র ৫৬ হাজার টন মজুত খাদ্যশস্য নিয়ে বাংলাদেশ বন্যার আশংকা করছিল। সেই মুহূর্তে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড বোষ্টার বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা: কামাল হোসেনের সাথে সাক্ষাৎ করে বলেছিলেন বাংলাদেশ কর্তৃক কিউবায় কয়েক লাখ ডলার মূল্যের চটের বস্তা বিক্রয় বন্ধ করার জন্য চাপ দেন। পি/এল ৪৮০ অধীনে খাদ্য সাহায্য পাবার পক্ষে এটা প্রতিবন্ধক বলে তিনি জানান। তিনি আরও জানান কিউবা ও ভিয়েতনামের সাথে বাণিজ্যরত কোন দেশকেই সাহায্য না করার ব্যাপারে মার্কিন কংগ্রেসের সুষ্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে, এর মূল লক্ষ ছিল বাংলাদেশকে প্রগতিশীল অর্থনৈতিক প্রকল্প ও জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি থেকে সরিয়ে আনা। 
পরিশেষে বলতে চাই- বঙ্গবন্ধুর দেশবাসীর প্রতি অসীম দয়া, ¯েœহ মায়া ও মমতাই ছিল তার একমাত্র সম্বল। ৫৫ বছরের ছোট জীবনটায় ৩২ বছর সংগ্রাম করেছেন এবং ২২ বার জেল খেটে মোট ৪৬৮২ দিন কারাভোগ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পুরোটাই একটি বেদনাত্মক কালজয়ী গবেষণাগার। প্রতিটি পাতায় গবেষণার উপাদান বিদ্যমান রয়েছে। পাঠক হিসাবে বর্ণিত বই-এ ১৭৬ পৃষ্ঠা থেকে অংশ বিশেষ উদ্বৃত করছিÑ
স্টেশন মাস্টারকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমাদের বাড়ির খবর জানেন কি না? যা ভয় করেছিলাম তাই হল। পূর্বের রাতে আমার মা, আব্বা, রেনু, ছেলে-মেয়ে নিয়ে ঢাকায় রওয়ানা হয়ে গেছেন আমাকে দেখতে। এক জাহাজে আমি এসেছি। আর এক জাহাজে ওরা ঢাকা গিয়েছে। দুই জাহাজের দেখাও হয়েছে একই নদীতে। শুধু দেখা হলো না আমাদের। এক বৎসর দেখি না ওদের। মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল। এই বেদনাত্মক কথাগুলো আমাকে খুবই ব্যথিত করেছে। কবিতার ভাষায় বলতে চাইÑ 
এক জাহাজে রেনু/ আরেক জাহাজে খোকা/ এক নদীতে দুই জাহাজ/ হয় নাই তবু দেখা।
লেখক : কলামিস্ট।

SUMMARY

1872-1.png