বঙ্গবন্ধু ও ১৫ই আগস্ট ট্র্যাজেডি-মো. রফিকুল হক

 
১৫ই আগস্ট স্বাধীন বাংলার প্রতিষ্ঠাতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর শাহাদত দিবস। বাংলা ও বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি কলঙ্কময় দিন। যে জাতিকে অন্যায়-অত্যাচার, জালুম-নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করতে গিয়ে স্বাধিকার স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত শত সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। জীবন-যৌবনের স্বর্ণালী দিনগুলো কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্টে কাটাতে হয়েছে ২৩টি বছর। সেই ইতিহাসের রাখাল রাজা, বাংলার মুকুটহীন স¤্রাটের সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশে নিজ বাড়িতে আঠারো জন সদস্যকে উশৃঙ্খল বিপথগামী সেনা সদস্য, দেশী-বিদেশী হায়েনাদের স্বার্থ কায়েম করতে গিয়ে নির্মমভাবে নিহত হতে হলো। যা কখনোও চিন্তা কি কল্পনাতেই আসে নাই। যেখানে পাকিস্তানের লৌহ মানবরা সেই সাহস করে নাই। অথচ পরাধীন বাংলায় নয়-স্বাধীন সার্বভৌম বাংলায় তা ঘটানো হলো। ক্ষতি তো এই উশৃঙ্খল বিপথগামী কুলাঙ্গারদের হয় নাই। হয়েছে গোটা জাতির, গোটা বাংলাদেশের তাকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি আখ্যা দেওয়া হয়। তিনি শুধু বাংলার বঙ্গবন্ধু ছিলেন না, তিনি বিশ্বের নির্যাতিত সকল দেশের বন্ধু ছিলেন। সে কারণে জাতিসংঘে বিশ্বের নেতারা বঙ্গবন্ধুকে বিশ্ববন্ধু উপাধি দিয়েছিলেন।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা এই উপমহাদেশে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি ডোমিনিয়ন সৃষ্টি করে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে। তখন পাকিস্তান নামক ডোমিনিয়নের আওতায় পড়েছিল আমাদের বাংলাদেশ। বাংলাদেশের নামকরণ হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান। ব্রিটিশের দুইশত বৎসর গোলামীর পর পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের অধীনে আরো চব্বিশ বৎসর পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকার পর ১৯৭১ সালে শত আন্দোলন সংগ্রাম করার মধ্যে দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের দ্বারা স্বাধীনতার লাল সূর্যকে ছিনিয়ে আনা হয়। তাতে ত্রিশ লক্ষ মুক্তিযুদ্ধার প্রাণের ও দু’লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে এদেশ পায় স্বাধীনতা। প্রায় এক কোটি সাধারণ মানুষ শরণার্থী হয়ে পাশের দেশ ভারতে আশ্রয় নিতে হয়। পাক হানাদার বাহিনীর নির্মম-নিষ্ঠুর হত্যার সামনে টিকে থাকা দায় হয়েছিল। বাংলায় নিরন্ন জনগণ শেষ পর্যন্ত পাক বাহিনীর নিষ্ঠুরতার বদলা নিতে গিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণের আহবানে সাড়া দিয়ে ইস্পাত কঠিন শপথ নিয়ে এসব হানাদারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় নিজের জীবনের বিনিময়ে, দীর্ঘ নয় মাস খেয়ে-না খেয়ে মরণপণ যুদ্ধ করে মিত্র বাহিনীর সহযোগিতায় লৌহ মানব ইয়াহিয়া খানের লেলিয়ে দেওয়া নিয়াজী ও টিক্কা খানের দল ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ঐতিহাসিক ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ৬৬ সালের ৬ দফা, ৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন থেকে শুরু করে স্বাধীকার, স্বাধীনতা আন্দোলন পর্যন্ত লড়াই সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে আইয়ুব-ইয়াহিয়া খানকে এদেশ থেকে বিদায় দিয়েছিলেন। সারা বিশ্বে ঝড় উঠেছিল কিভাবে নয় মাসে একটি দেশের স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হয়েছিল। শুধু তাই নয়, মিত্র বাহিনীর মতো সাহায্যকারীরা কিভাবে তিন মাসের মাথায় এদেশ ছাড়তে হয়েছিল। বিস্ময়কর এ জাদুকরকে সম্মান দেওয়ার জন্য গোটা পৃথিবীর রাষ্ট্রনায়করা উদগ্রীব হয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের সভ্য পদ লাভ করেন। পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রনায়কের সংস্পর্শে যাওয়ার পর সবাই তাঁকে বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখেছে। তার আজীবন শোষিতের পক্ষে সংগ্রামকে বাহবা দিয়েছে।
বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চল্লিশের দশকের শেষ দিক থেকে পঞ্চাশের দশক, ষাটের দশক এবং সত্তর দশকের প্রথমে এসে স্বাধীনতা লাভ করা খুবই ত্যাগের, দুঃখের এবং কষ্টের। বিশেষ করে এই বাংলায় অনেক মহান নেতার জন্ম হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বেই স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল। পাকিস্তানী শাসকদের কাছে একমাত্র মাথা-ব্যথার কারণ ছিলেন শেখ মুজিব। সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। যখনই জনসাধারণকে সংগঠিত করতে উদ্বুদ্ধ করতেন, তখনই শাসনযন্ত্রের স্টীম রোলার তাঁর উপর নেমে আসত। কিন্তু কোন দিনই তিনি সেই আন্দোলন থেকে সরে আসেননি বিধায় বাংলার মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন তাঁর প্রতি ছিল। তাই ৭ই মার্চের ভাষণের পর মানুষ আর পিছনে ফিরে তাকায়নি। তাঁর মূল উক্তি ছিল ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম-এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ‘যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা কর’। এই বাণীগুলো সারা বাংলায় মন্ত্রমুগ্ধের মতো কাজ করে। ফলশ্রুতিতে সাত কোটি বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দেশ মাতৃকাকে স্বাধীন করতে অকাতরে প্রাণ দিয়েছেন। কোথাও কোন সংশয় ছিল না, সন্দেহ ছিল না। ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি বীরের বেশে লন্ডন-ভারত হয়ে তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলায়-স্বাধীন বাংলায় ফিরে আসেন। এটাই ছিল তাঁর আজীবন সংগ্রামের লালিত ফসল। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে নানা সুবর্ণ সুযোগ দানে পাকিস্তানীরা তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। কারাগারের প্রকোষ্টের সামনে কবর খুঁড়ে নিক্ষেপের উদ্যোগও নিয়েছিল আইয়ুব-ইয়াহিয়া খানরা। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি মুসলমান মুসলমান একবারই মরে। আমি বাঙালি বাংলা আমার ভাষা। আমার বাঙালিকে কোনদিন খাটো করব না। ফাঁসির মঞ্চে যেতে আমি প্রস্তুত। তবে আমার লাশটা যেন আমার বাংলাদেশের মানুষের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।’ এসব অনড় উক্তিতে পাকবাহিনী ভড়কে যায়।
কিন্তু পরিতাপের বিষয় যে মানুষটি জীবনের ২৩টি বছর জেল-জলুম, অত্যাচার সহ্য করে বাংলার স্বাধীনতা এনেছিল, তাঁকে কেন হত্যা করা হলো। এমনকি শিশু মাছুম বাচ্চাকে পর্যন্ত। বাংলার মানুষের সাথে সুসম্পর্ক রাখতে তিনি সুরক্ষিত বঙ্গভবনে না থেকে নিজ বাসা ধানমন্ডির ৩২নং বাসায় থাকতেন। যাতে মানুষ সহজে তাকে পায়। বিশ্বাস করতেন প্রতিটি বাঙালিকে। আর শেষ পর্যন্ত কিনা বাংলার এ নরপিশাচরা বিদেশী প্রভুদের স্বার্থে ইতিহাসের নিকৃষ্টতম আচরণ করল। শুধু বাংলা নয়, সারা বিশ্ব অবাক হয়ে গেল। বাঙালিকে তখন বিদেশীরা আর বিশ্বাস করতে পারছিল না। বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশকে নিয়ে নানা মন্তব্য করতে লাগল। বঙ্গবন্ধু যখন তিল তিল করে গড়ে তুলতে লাগলেন, গোটা পৃথিবীকে বাংলাদেশকে সাহায্য করার আহবান জানালেন। সাজাতে লাগলেন সোনার বাংলাকে। প্রতিটি স্তরে, প্রতিটি বিভাগে, প্রতিটি কাহিনী মনের মাধুরী দিয়ে গড়ে তুলতে লাগলেন। প্রথমেই প্রাথমিক শিক্ষাকে সাহসের সহিত জাতীয়করণ করলেন, সামরিক বাহিনীকে অত্যাধুনিক বাহিনী করে গড়ে তুলতে লাগলেন। ইসলামী ফাউন্ডেশন থেকে শুরু করে তুরাগ নদীর তীরে বিশ্ব ইজমেতার জায়গা নির্ধারণ করে দিলেন। কিন্তু এ সকল পদক্ষেপ পরাজিতরা মেনে নিতে পারে নাই। নয় আজ থেকে বিশ বছর পূর্বে এদেশ এশিয়ার অন্যতম দেশে রূপান্তরিত হতে পারত।
বঙ্গবন্ধুর ৪৪তম শাহাদত বাষির্কীতে প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে নিষ্ঠুর পাষানরা দেশ শত্রুরা এ হত্যাকান্ড করেছিল, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এসব কুলাঙ্গাররা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে-তাদেরকে ধরে এনে মৃত্যুদন্ড বহাল করতে হবে। কানাডায় নূর চৌধুরীকে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে দেশে আনতে হবে। প্রধানমন্ত্রী কানাডায় গিয়ে একবার রাষ্ট্র প্রধানকে বলে এসেছিলেন ওকে ফেরত দেওয়ার জন্য। তিনি সেদেশে আমাদের লোকজনকে বলেছিলেন তোমরা সেদেশের সরকারকে চিঠি দিয়ে বুঝিয়ে দাও, মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আগামী কানাডায় আশ্রয় দেওয়া তার দেশের জন্য সমীচিন নয়। কিন্তু কে শুনে কার কথা। এরপর ভারত ও পাকিস্তানে মুসলিম ও ডালিমরা রয়েছে। তাদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বন্দী চুক্তির মাধ্যমে দেশে এনে ফাঁসি কার্যকর করতে হবে। ইতিহাসের দায় থেকে মুক্ত হতে হবে। না হলে মুজিবের বাংলায় শহীদদের আত্মায় শান্তি পাবে না।
লেখক : কলামিস্ট।

SUMMARY

1871-B3.jpg