আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান তখন ছিলো রেসকোর্স ময়দান। একাত্তরের ৭ই মার্চ বিকেলবেলা, বাংলার নিপীড়িত মানুষের পদভারে রেসকোর্স ময়দান পরিণত হয় জনসমুদ্রে। মুক্তিকামী মানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এসে মঞ্চে দাঁড়ালেন। সফেদ-সাদা পাঞ্জাবীর উপর কালো কোর্ট গায়ে নেতা হাত উচু করে তার উপস্থিতি জানান দিলেন। স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে চারপাশ। নেতা তার জনগণের চোখের ভাষা এবং তাদের বুকের ভেতরে পোষা যন্ত্রণা অনুভব করতে পারলেন। সে দিন, সেই ঐতিহাসিক বিকেলবেলা মুক্তির জন¯্রােতে তিনি ঘোষণা করলেন স্বাধীনতার ইশতেহার।
শুরু হল সংগ্রাম। জালিমের আঘাতের জবাবে মজলুমের পাল্টা আঘাত। টানা নয় মাসের দীর্ঘ যুদ্ধ শেষে নিপীড়িত জনপদে ফিরে এলো শান্তি ও স্বাধীনতা। বিশ্বের মানুষ দেখলো একাটি ভাষণের কতখানি শক্তি। কতোটুকু অনুপ্রেরণা দিতে পারে একজন নেতার সাহসী কণ্ঠস্বর।
৭ই মার্চের পটভূমি যদি আমরা লক্ষ করি, তাহলে দেখবো ওই সময়ে এমন ভাষণ দেওয়া কম সাহসিকতার ব্যাপার নয়। রাষ্ট্রদ্রোহীতার মত ব্যাপার এতে ছিলো। কিন্তু সেই সময়ে যদি বঙ্গবন্ধু এমন ভাষণ না দিতেন, তাহলো হয়তো কখনোই বাঙলার আকাশে স্বাধীনতার সূর্যোদয় হতো না।
সে সময়, সেই সংকটময় মুহূর্তের জন্য ৭ই মার্চের ভাষণটি ছিলো অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিপদসংকুল পথ পেরিয়ে মুক্তির মোহনায় ফেরার জন্য ভাষণটি ছিলো পথরেখা। ভাষণের মধ্যে যেমন নির্যাতিতদের জন্য ছিলো সাহস যোগানো কথামালা, তেমনি পাকিস্তানের শাসকদের জন্য ছিলো এই জনপদের মানুষের দাবির কথা। বঙ্গবন্ধু সেদিন স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণের জন্যে ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় সাপ্তাহিক নিউজউইক তাকে ‘পোয়েট অব পলিটিকস’ হিসেবে আখ্যায়িত করে।
১৯ মিনিটের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ এখন ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য’। গত বছরের অক্টোবরে ইউনেসকো বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী ভাষণকে ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য’ স্বীকৃতি প্রদান করে। যে ভাষণটি এই জনপদের ইতিহাসে জায়গা পেয়েছিলো তা এখন বিশ্বের ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে।
টুঙ্গিপাড়া থেকে ঢাকা হয়ে পাকিস্তান থেকে বাঙলাকে মুক্ত করে নিয়ে আসাটা খুব সহজ ছিলো না। বঙ্গবন্ধুর মত সাহসী নেতার দ্বারাই এটা সম্ভব ছিলো।
আজ প্রায় অর্ধশত বছর পরে এসেও আমাদেরকে সেই ভাষণটি নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে। একজন মানুষের আর কী সার্থকতা হতে পারে! একজন মানুষের আর কী সফলতা হতে পারে!
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আলোচনা করতে গেলেই কিউবার সেই বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রোর কথাটি মনে পড়ে। বঙ্গবন্ধুকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন ‘আমি হিমালয় দেখিনি বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি।’ কাস্ট্রো ছাড়াও বঙ্গবন্ধুকে বিশ্বের অনেক বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ মূল্যায়ন করেছেন।
বৃটেনের রাজা যখন মারা যায়, তখন তারা বলে ‘করহম রং ফবধফ, ষড়হম ষরাব ঃযব করহম’ যারা অর্থ হচ্ছে রাজার মৃত্যু হয়েছে, রাজা দীর্ঘজীবী হোন। তার মানে মৃত্যুই শেষ কথা নয়। ’৭৫ এর পনেরো আগস্ট হত্যা করা হয় মুক্তির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। কিন্তু তার মৃত্যু তাকে মুছে নিয়ে যায়নি ইতিহাস থেকে। ঘাতকেরা হয়তো জানতো না কথাটা। বঙ্গবন্ধু এখনো বেঁচে আছেন। এখনো তাকে মানুষ ভালোবাসে, স্মরণ করে। আর যারা থাকে মুছে দিতে চেয়েছিলো মানুষ তাদের ধিক্কার করে। অভিশাপ দেয়। বঙ্গবন্ধু দীর্ঘজীবী হোন।