শুভ জন্মদিন বাঙালিশ্রেষ্ঠ বঙ্গবন্ধু


মোনায়েম সরকার

১৯২০ সালের ....... দিনে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জন্মগ্রহণ করেন। শেখ মুজিব শুধু একটি নাম নয়, একটি ইতিহাস, একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামী চেতনা। গত পহেলা মার্চ আমি কলকাতার রবীন্দ্র পাঠাগার অঙ্গনে ইন্দিরা গান্ধীর জন্মশতবর্ষে বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলাম। আমার বক্তব্যের বিষয় ছিল ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ইন্দিরা গান্ধী’। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ হতেও আর বেশিদিন বাকি নেই। বাংলাদেশের মানুষও এই মহান নেতার জন্মশতবর্ষে বছরব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করবে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেই আজকের লেখা শুরু করতে চাই।

শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও রাজনীতি, একটি ভৌগোলিক সীমারেখায় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাঙালির হাজার বছরের আশা-আকাক্সক্ষা, বেদনা-বিক্ষোভ ও আবহমান বাংলার ঐতিহ্যকে তিনি নিজের চেতনায় আত্মস্থ করেছেন। তাঁর কণ্ঠে বাঙালি জাতির সার্বিক মুক্তির আকাক্সক্ষা প্রতিধ্বনিত হয়েছে। তিনি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূর্ত প্রতীক; বিশ্বশান্তি আন্দোলনের অন্যতম সেনানী এবং সমকালীন বিশ্বের মানবজাতির মুক্তিসংগ্রামে নিবেদিতপ্রাণ উৎসর্গীকৃত সন্তানদের একজন। শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা ও স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা- জাতির জনক।

বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন বিশ্বের একমাত্র নেতা যিনি অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে সাড়ে সাত কোটি জনগোষ্ঠীর জন্য একটি ডি-ফ্যাক্টো বা কার্যত সরকার গঠন করেছিলেন। মহাত্মা গান্ধী এবং মার্টিন লুথার কিং ডি-ফ্যাক্টো সরকার গঠন করেননি বা করতে সাহসী হননি। শেখ মুজিবের আন্দোলনের স্টাইল, দূরদৃষ্টি ও সাহস একটি পিছিয়ে পড়া জাতির ভাগ্য গড়ে দিতে পেরেছিল। একটি সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে জনসমর্থন সংগঠিত করার ক্ষেত্রে শেখ মুজিবের সম্মোহনী ক্ষমতা অর্থাৎ ক্যারিশমেটিক নেতৃত্ব প্রাচ্য, পাশ্চাত্য ও পাশ্চাত্যের বাইরের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক, সমাজবিজ্ঞানী ও সাংবাদিকরাও মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করে নিয়েছে। এমনকি তাঁর বিরোধীরাও তাঁর এসব অনন্য গুণের স্বীকৃতি দিয়েছে। শেখ মুজিব ৬-দফা কর্মসূচির মাধ্যমে বাঙালির প্রাণের দাবি সূত্রবদ্ধ ও সুনির্দিষ্ট করায় একজন সাধারণ রাজনৈতিক কর্মী থেকে রাজনৈতিক ক্যারিশমাপূর্ণ নেতা ও রাষ্ট্রনায়কে পরিণত হয়েছিলেন।

শেখ মুজিবের স্বকীয় নেতৃত্বের আভাস তাঁর কিশোর বয়সের কয়েকটি ঘটনা থেকে আঁচ করা যায়। তিনি কিশোর বয়সে খ্যাতিমান রাজনৈতিক নেতা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নিকট গোপালগঞ্জে নির্ভীক কণ্ঠে তাঁদের গ্রামের স্কুলের দাবি তুলে ধরেছিলেন। আঠারো বছর বয়সে স্কুলে পড়ার সময় এক ঘটনায় প্রতিবাদী ভূমিকা গ্রহণের জন্য তরুণ শেখ মুজিব গ্রেপ্তার হন এবং সাত দিন হাজতবাস করেন। বিদ্রোহী এই বালক যে একদিন স্বদেশের মুখ উজ্জ্বল করবে এমন সম্ভাবনা অনুধাবন করা গিয়েছিল সেদিন। দেশের মানুষের আর্থিক দুরবস্থা ও সামাজিক বৈষম্য সম্পর্কে শেখ মুজিব কিশোর বয়স থেকেই সচেতন ছিলেন এবং তাঁর বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে তা প্রকাশও পেয়েছে।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দীর্ঘ ২৩ বছর পাকিস্তানি শাসকশ্রেণির বৈষম্য-নীতি, শোষণ ও অগণতান্ত্রিক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমানের সংগ্রামের কথাই বারবার ঘুরে-ফিরে আসে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য। তখন থেকেই তিনি দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, বাঙালি জীবনের বৈশিষ্ট্য নিয়ে চিন্তাভাবনা করতেন। শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান শাসনামলে বাঙালির জন্য ভেবেছেন- কোনো শ্রেণি, সংগঠন, পেশা বা কোনো গোষ্ঠীর কথা আলাদা করে ভাবেননি। কিন্তু এসব সামাজিক-আর্থিক অবস্থানের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের সমস্যাগুলোকে তাঁর কর্মে ও ভাবনায় তিনি স্থান দিয়েছিলেন।

বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পরিচালিত অভূতপূর্ব অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমি ও ব্যাপকতা ভারতে গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে কোনো দিক দিয়েই তুলনীয় নয়। স্থান ও কালের ব্যবধান ছাড়াও শেখ মুজিবের অসহযোগ আন্দোলন একটি সমান্তরাল বেসামরিক সরকার পরিচালনার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল, যা মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের ব্যাপ্তি ও প্রভাব থেকে প্রকৃতিগতভাবেই আলাদা। বাংলাদেশের মানুষ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবের ডাকে ঐক্যবদ্ধভাবে সাড়া দিয়েছে এবং অংশগ্রহণ করেছে। একদিকে সামরিক বাহিনী শত শত লোককে গুলি করে হতাহত করেছে, অপরদিকে বাংলাদেশের মৃত্যুঞ্জয় জনতা বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে শান্তিপূর্ণভাবে অসম সাহসে গুলির মুখে বুক পেতে দিয়ে আন্দোলন করেছে- কার্ফ্যু ভেঙেছে জনগণ, তাদের কানে বেজেছিল বঙ্গবন্ধুর অমোঘ নির্দেশ : ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এই অসহযোগ আন্দোলনকে সঙ্গতভাবেই বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায় হিসেবে অভিহিত করা যায়। তিন সপ্তাহব্যাপী একটি সমান্তরাল সরকার পরিচালনা করে বঙ্গবন্ধু তাঁর নেতৃত্ব ও সাহসের এমন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, যার উদাহরণ ইতিহাসে নেই। তারপরই শুরু হয়েছিল সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রাম ও স্বাধীনতা যুদ্ধ- বাংলাদেশের অবিসংবাদী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নামে।

একজন মানুষ হিসেবে শেখ মুজিবের মহত্ত্ব এখানে যে, বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য তিনি লড়াই করেছেন। তিনি চেয়েছেন এই দেশের মানুষ যেন খেয়ে-পরে সুখে-শান্তিতে বাঁচতে পারে, আত্মমর্যাদা নিয়ে বিশ্বের দরবারে নিজেদের ন্যায্য স্থান পেতে পারে। আর এ জন্য বঙ্গবন্ধু তাঁর সমগ্র জীবন, চিন্তা-ভাবনা ও শ্রম উৎসর্গ করেছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি একজন আদর্শবাদী ও নীতিবান মানুষ হিসেবে এ দেশের সাধারণ মানুষের একান্ত কাছাকাছি ছিলেন। ২৪ বছরের নিরলস সাধনায় সাফল্য অর্জন সত্ত্বেও তিনি অহঙ্কারী ও উদ্ধত ছিলেন না। বিলাসিতা ও স্বেচ্ছাচারকে তিনি ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনে কখনো প্রশ্রয় দেননি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরও তিনি ঢাকার ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাসায় বসবাস করতেন।

বাসাটি একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মতোই আড়ম্বরহীন, বাহুল্যবর্জিত ছিল। সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের অংশীদার হিসেবে তিনি অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। তাঁর পত্নীও তাঁরই আদর্শের অনুসারী ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই নির্দ্বিধায় বলা সম্ভব হয়েছে সমগ্র দেশবাসীকে, এ দেশের প্রতিটি বাঙালিকে, প্রতিটি মানুষকে- ‘আমি তোমাদেরই লোক’। কোনোরূপ উচ্ছ্বাস বা অতিশয়োক্তির স্থান ছিল না এই উচ্চারণে। মন-মানসিকতা ও চিন্তা-চেতনায় শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অত্যন্ত উঁচু মাপের মানুষ। শেখ মুজিবের রাজনীতি প্রাসাদ চক্রান্তের সূতিকাগারে জন্ম নেয়নি, ক্ষমতার প্রলোভনে পুষ্ট হয়নি। এ রাজনীতির গোড়াপত্তন হয়েছে বঞ্চিত বাংলার সুদূর গ্রামাঞ্চলে, নীরব নিভৃত পল্লীতে, প্রতারিত শোষিত বাঙালির পর্ণকুটিরে। যে ক্ষমতার উৎস জনগণের সমবেত ইচ্ছায়, সহযোগিতায় ও সমর্থনে নিহিত, সে সুপ্ত ক্ষমতার পুনর্জাগরণই মুজিব রাজনীতির মূলমন্ত্র।

বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে আজ আমাদের শপথ নিতে হবে- আমরা মনে-প্রাণে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করব তাঁর দেখানো পথে অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাব। ব্যক্তিগত স্বার্থকে নয়, রাষ্ট্রীয় স্বার্থকে বড় করে দেখব, দলের ঊর্ধ্বে উঠে দেশ সেবা করব, মুক্তিযুদ্ধের ধারায় এগিয়ে নিয়ে যাব আগামী দিনের বাংলাদেশ। তাহলেই বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত স্বপ্ন সার্থক হবে। গড়ে উঠবে সত্যিকার সোনার বাংলা।

মোনায়েম সরকার : গবেষক ও লেখক।

SUMMARY

187-1.jpg