ক্ষমা করো পিতা-বিশ্বজিত রায়

 
রক্তক্ষরণের মাস আগস্ট। ব্যথায় বিদীর্ণ হওয়ার মাস আগস্ট। ক্রন্দনে ক্রন্দনে নেতিয়ে যাওয়া মাস আগস্ট। আগস্ট মানে জাতির ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া কলঙ্কের চাপ অসহনীয় বেদনাবিধূর বিপন্ন ভারি বোঝা। কলঙ্কিত এই আগস্টে রচিত হয়েছিল ইতিহাসের নির্মম নৃশংসতম কালো অধ্যায়। জাতির কিছু কুরুচিপূর্ণ ক্ষমতালিপ্সু নরপশু স্বাধীনতা ও স্বাধীন বাংলার স্থপতি, বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে পৃথিবীর বুকে জন্ম দিয়েছিল দুঃসাহসিক এক দ্রোহ দৃষ্টান্ত। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘৃন্য নজির আর কোনো জাতিগোষ্ঠির ললাটে লেখা নেই। বাঙালি পরিচয়ভূক্ত বর্বর ঘাতকরা আমাদের কপালে লিখে দিয়ে গেল সর্বজন নিন্দিত কলঙ্কের চিরন্তন দুর্নাম। যে দুঃখ, কষ্ট, বেদনা, বদনাম আমাদের বয়ে বেড়াতে হবে আজীবন। তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ ও একটি বীরত্বপূর্ণ জাতিকে তমসাচ্ছন্ন অশনি পথে পতিত করেছিল। জাতিকে করেছিল অভিভাবকশূন্য।
ঘুমন্ত বাংলাদেশ তখনও নিশিবসানের নিদ্রিত প্রতীক্ষায় নিঃশ্বাস ফেলছে। কেউ কি জানত তাদেরকে ঘুমে রেখেই হত্যা করা হবে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। না, বঙ্গবন্ধুর প্রিয় বাঙালি কখনো আঁচ করতে পারেনি এমনটি। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট নিরবনিশির শেষলগ্নে বিদঘুটে বুলেট শব্দে প্রকম্পিত হয় ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বরের আকাশ-বাতাস। জলপাই রঙা সেনা রাইফেলের বুলেটবারুদ ঝাঁঝরা করে দেয় রাজনীতি, শান্তি, স্বাধীনতা, মুক্তি ও মানবতার মহাকবি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা সমৃদ্ধ বঙ্গবক্ষ। নিমিষেই নেতিয়ে পড়ে বাংলাদেশ। হু-হু করে কেঁদে উঠে মানবতা, স্তম্ভিত হয়ে পড়ে রাত সমাপন মুহূর্তের শীতল প্রকৃতি পরিবেশের অনুষঙ্গগুলো। সন্তানের প্রাণবধ বেহায়াপনা বেদনায় শোকের অতলে নিমজ্জিত নির্বাক বঙ্গমাতা বারবার মুর্ছা যাচ্ছিলেন। ততক্ষণে রক্তলাল ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়িটি। রক্তবীভৎস হোলি খেলায় উন্মাতাল নিকৃষ্ট বদেরা বিকৃত উল্লাস আর অমার্জিত বাহানায় বেরিয়ে পড়ে রক্তমাখা বঙ্গবন্ধুর নিস্তেজ দেহ ফেলে।
বাঙালি বাংলাকে অভিভাবকশূন্য করে হন্তারক দল ফিরে গেছে তাদের আপন গন্তব্যে। প্রাণশূন্য বঙ্গবন্ধু তখনো পড়ে আছেন বত্রিশ নম্বরের রক্তাক্ত মেঝেতে। অবশেষে জাতির জনকের নিথর দেহটি কড়া প্রহরায় নিয়ে যাওয়া হয় টুঙ্গিপাড়ার পল্লীতে। শোকে স্তব্ধ আলো বাতাসের নিঃশব্দ কান্নায় ভারি টুঙ্গিপাড়ার মৃত্তিকা ময়দানে নামানো হয় হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর বিপন্ন দেহ। তখন অযতœ অবহেলার চরম বাস্তবতা দেখে টুঙ্গিপাড়ার মাটি, মানুষ ও প্রকৃতি। বাংলার মাটি মানুষের কল্যাণে প্রাণ উৎসর্গকারী শুচিশুদ্ধ আত্মার দীর্ঘদেহী মানুষটির সাথে বাঙালির নি¤œশ্রেণিভূক্ত ঘৃণ্য গোষ্ঠীর অসহনীয় আচরণে ‘মানবতার দেবী’ মুখ লুকিয়ে লজ্জা নিবারণের চেষ্টা করেন। পরাধীন বাংলা ও মুক্তিকামী বাঙালির জন্য নিজেকে আজন্ম সঁপে দেওয়ার অপরাধ এবং মুক্ত স্বাধীন ভূমের বিধ্বস্ত বাংলায় শান্তিসুখের চিরস্থায়ী কল্যাণ কামনান্তে ব্যতিব্যাস্ততার অপরাধই হয়তো বঙ্গবন্ধুকে দস্যুপনার দুর্দান্ত প্রতিযোগিতায় প্রাণ বলিদান করতে হয়েছে।
বাঙালি এমনটি করতে পারে তা কখনো বিশ্বাসই করতেন না মানবতার বিস্ময় বঙ্গবন্ধু। তাঁর সাহস, প্রজ্ঞা, বীরত্বের কাছে চিরশত্রু পাক ভুট্টো-ইয়াহহিয়া ও বৈশ্বিক শক্তিধর ক্ষমতা মাথা নত করলেও কেবল বাঙালি ঐ সারমেয় শাবকেরাই বিশ্বাসঘাতকতার চূড়ান্ত নজির স্থাপন করল। হাজার বছরের শৃঙ্খল ভেঙ্গে বঙ্গবন্ধু বাঙালির জন্য যে শাশ্বত মুক্তির ভিত রচনা করেছিলেন সেই কৃতজ্ঞতাবোধকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বঙ্গবন্ধুর সমগোত্রীয় জাতির অকৃতজ্ঞ অসুরেরা বিশ্বাস ভালোবাসার সুপরিপক্ক ভিতকেই নাড়িয়ে দেয়নি চিরতরে স্তব্ধ করে দিয়েছে একটি জাতি তথা মানববিশ্বের মহামহিম বাংলা গড়ার অন্যতম কারিগর নিপুণ মানুষটিকে। যার কোমল মনের বিস্তৃত অঙ্গনে শুধু বাঙালির বসতই ছিল না, আপন অস্তিত্বে তিনি শোষিত বাংলার সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধির স্বপ্নই সর্বদা লালন করে গেছেন। বাঙালির আস্থা, বিশ্বাস, ভরসার প্রতিদানও দিয়েছিলেন নিজেকে মৃত্যুর অগ্নিকু-লীতে ছুড়ে দিয়ে। মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় রেখে শত্রুপক্ষের প্রতি একটি অনুরোধের কাতর উক্তি তুলে ধরে মৃত্যুমুখী বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমাকে মেরে ফেলে দাও বাধা নেই, তবে মৃত্যুর পর লাশটা আমার বাঙালির কাছে পৌঁছে দিও।’
একটি জাতিকে কতখানি ভালোবাসলে, কতটুকু বিশ্বাস করলে, কতটুকু আপন ভাবলে একজন নেতা এমন কথা বলতে পারেন। বঙ্গবন্ধু বাঙালিকে বিশ্বাস করেছিলেন বলেই প্রাণবধের চতুর চক্রান্ত বিষয়ক বৈদেশী গোয়েন্দা তথ্য পেয়েও প্রাণপ্রিয় জাতিকে অবিশ্বাস করা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে সম্ভব হয়নি। বিশ্বাস, ভালোবাসা ও প্রগাঢ় মমত্ববোধের আস্তাশীল অঙ্গনে আবদ্ধ বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপ্রধানের সরকারি বাসভবন ছেড়ে নিরাপত্তাহীন নিজস্ব বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। বঙ্গবন্ধুর এমন সাদামাটা জীবনযাপনে বিস্মিত ভিনদেশী সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, এখানে যে আপনার নিরাপত্তা বিঘিœত হচ্ছে। সরকারি বাসভবন ছেড়ে আপনি এখানে কেন? বাঙালিপ্রিয় বঙ্গবন্ধু দৃঢ়চিত্তে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমি সাধারণ মানুষের নেতা, নিরাপদ চৌকিতে থাকলে নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করে সাধারণ মানুষ সহজে আমার কাছে ঘেঁষতে পারবে না। এমন পরিবেশই আমার উপযুক্ত স্থান।’
হে জনক মোরা অপরাধী! তোমার অসামান্য অর্জন ও জীবনবাজি ভালোবাসার যৎসামান্য প্রতিদানও দিতে পারেনি অধম বাঙালি। শোষণ বঞ্চনার বিকৃত বেহায়াপনায় বিপন্ন যে জাতিকে চিরমুক্তির সাধ পাইয়ে দিলে সেই জাতির নিমকহারাম সন্তানেরা বুলেটের বিষমাখা নিশানায় ক্ষত-বিক্ষত করল তোমার হার না মানা বিপ্লবী বুক। একটি জাতির দীর্ঘ যন্ত্রণা ঘুচিয়ে স্বাধীনতার সুখ চিনিয়ে আনার মহামানবতুল্য বিরল ক্ষমতাধর মানবতাবাদী মহত্বের মূল্যায়নটুকুও করতে পারিনি আমরা, ছি! ছি! ছি! চরম পৈশাচিকতা, বীভৎস বর্বরতা, নির্মম নষ্টামী ও অযাচিত অসভ্যপনায় ধ্বংস করে দেওয়া হলো তোমার মানবতাবাদী দেহটি।
পিতা তুমি কত বড় অপরাধী! মহাপাপ করে বসলে তুমি! যাদের জন্য, যে ভূমির জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেলে, সেই স্বাধীন ভূখ-ের মুক্ত জাতির বাঙালি বিপথগামী সন্তানেরাই মানবতাহীন মর্মস্পর্শী কায়দায় হত্যা করলো তোমায়। নরকের নোংরা আস্তানায় পাপিষ্ট আত্মাকে কিভাবে শাস্তি দেওয়া হয় জানিনে, তবে তোমার জীবন জয়ের বিশালতার পাওনাস্বরূপ যে প্রাপ্যতা বুঝিয়ে দেওয়া হলো তা নরককু-লীর বহ্নিশিখার ভয়াবহ উত্তাপ থেকেও পীড়াদায়ক। পিতা জুলুমবাজ পাক শত্রুরা তোমায় মৃত্যুকবরের ভয় দেখানো ছাড়া গিরিসম ব্যক্তিত্বের কাছে দাঁড়ানোর সাহস দেখাতে পারেনি সেখানে তোমারই সমজাতির কুপ্রবৃত্তিধারী কিছু উচ্চাবিলাসী বাঙালি প্রেতাত্মার নির্দয় আঘাতে নিঃশেষ তোমার তেজস্বী প্রাণ। এ জাতির কল্যাণ সাধনই যে ছিল তোমার অন্যতম ব্রত। শোষিত বাঙালির বিবর্ণ মুখে হাসি ফুটানোর মহামন্ত্রে ধ্যানমগ্ন মানুষটির পুণ্যময় প্রাণপ্রদীপ নিভিয়ে অন্ধকারে নিমজ্জিত করা হলো বাংলাদেশকে। এ যেন পুত্র হাতে পিতা খুনের নজিরবিহীন বর্বরতা। পরপারে ভালো থেকো পিতা। কায়মনোবাক্যে তোমার সুমহান আত্মার শান্তি কামনা করছি।

SUMMARY

1869-1.png