মৃত্যুঞ্জয়ী বঙ্গবন্ধু-দুলাল শর্মা চৌধুরী

 
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধুমাত্র ব্যক্তি নন। একটি প্রতিষ্ঠান। একটি আন্দোলন। একটি বিপ্লব। একটি স্বাধীন জাতি নির্মাণের কারিগর। একটি সার্বভৌম স্বাধীন রাষ্ট্রের রূপকার। মহাকাব্যের অমর গাথা একটি ইতিহাস। এই ইতিহাসের ব্যাপ্তি হাজার বছর। তাই সমকাল তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে। 
যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, যতদিন বাঙালি জাতি থাকবে ততদিন বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে অক্ষয় ধ্রুবতারার মতো অম্লান গরিমায় ভাস্বর হয়ে থাকবেন। তার স্বপ্ন, তার স্মৃতি বাঙালি জাতিকে চির জাগ্রত করে রাখবেন। 
জনগণের কাছে তিনি বন্ধু। জাতির কাছে তিনি পিতা। বিদেশীদের কাছে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা। তার সম্পর্কে বিদেশী সাংবাদিক সিবিল ডান বলেছেন, ‘বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে শেখ মুজিবই একমাত্র নেতা যিনি রক্তে, বর্ণে, ভাষায়, কৃষ্টিতে এবং জন্মসূত্রেও ছিলেন খাঁটি বাঙালি। তার দীর্ঘ শালপ্রাংশু দেহ, বজ্রকন্ঠ মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করার বাগ্মিতা এবং জনগণকে নেতৃত্বদানের আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও সাহস তাঁকে এ যুগে এক বিরল এক মহানায়কে রূপান্তর করেছে’। যুক্তরাষ্ট্রের ‘নিউজ উইক’ পত্রিকা বলেছে শেখ মুজিব চড়বঃ ড়ভ চড়ষরঃরবং রাজনীতির কবি। নতুন মিশরের শ্রেষ্ঠ সাংবাদিক হাসনাইন হাইকেল বলেছেন, নাসের কেবল মিশরের নন, সারা আরব জাতির মুক্তিদূত। তেমনি শেখ মুজিবুর রহমান শুধু বাংলাদেশের নন বাঙালি জাতির মুক্তিদূত। তার জাতীয়তাবাদ বাঙালির সভ্যতা ও সংস্কৃতির নব অভ্যুদয় মন্ত্র। মুজিব বাঙালির অতীত ও বর্তমানের শ্রেষ্ঠ মহানায়ক। ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে জোট নিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করে কিউবার নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় পর্বত দেখিনি, শেখ মুজিবকে দেখলাম। ব্যক্তিত্বে ও সাহসে এই মানুষটি হিমালয়। আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম।’ বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর খবর শুনে বৃটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসন লন্ডনের এক বাঙালি সাংবাদিকের কাছে লেখা শোক বাণীতে বলেন, ‘এটা আপনাদের কাছে অবশ্যই এক বিরাট ন্যাশনাল ট্র্যাজেডি। আমার এক পরম শোকাবহ পার্সোনাল ট্র্যাজেডি।’
বঙ্গবন্ধুই জাতিকে ধ্বংস করার পাকিস্তানি শাসকদের চক্রান্তের বিরুদ্ধে প্রথম সাহসের সঙ্গে প্রতিবাদ জানান। ১৯৫৫ সালের ২৫ আগস্ট তারিখে পাকিস্তান গণপরিষদে তিনি বলেন, স্পীকার মহোদয়, ওরা (সরকার) পূর্ব বাংলার নাম বদল করে পূর্ব পাকিস্তান রাখতে চায়। আমরা বারবার দাবী জানাচ্ছি, আপনারা ‘বাংলা’ এই নাম ব্যবহার করুন। বাংলা নামের ইতিহাস আছে। আছে নিজস্ব ঐতিহ্য। এই নাম পরিবর্তন করতে হলে বাংলার জনগণের কাছে আগে জিজ্ঞেস করতে হবে, তারা এই নাম বদল করতে রাজী আছে কিনা। বঙ্গবন্ধুর এই সুস্পষ্ট প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে এবং বাংলাদেশের জনগণের কোন রকম মতামত না নিয়ে পাকিস্তানি শাসকরা বাংলা নাম মুছে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান নামটি ছাপিয়ে দিয়েছিলেন। ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনে বঙ্গবন্ধু কারান্তরাল থেকে বেরিয়ে এসে বাঙালির কপাল থেকে এই দাসত্বমূলক পরিচয় মুছে ফেলার পদক্ষেপ নেন। এ বছর ৫ ডিসেম্বর তারিখে তিনি ঘোষণা করেন, এক সময় এ দেশ থেকে, এ দেশের মানচিত্র থেকে বাংলা কথাটার সর্বশেষ চিহ্নও চিরতরে মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে। শুধু বঙ্গোপসাগর ছাড়া আর কোথাও নামটির চিহ্নও খুঁজে পাওয়া যায়না। বাংলার মানুষের পক্ষ থেকে আমি ঘোষণা করছি, আজ থেকে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের নাম পূর্ব পাকিস্তানের বদলে ‘বাংলাদেশ’ হবে। 
প্রকৃতপক্ষে এই ক্রান্তিলগ্নের স্বাধীন বাংলাদেশের নবজন্মের প্রথম প্রকাশ্য ঘোষণা বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকেই উচ্চারিত হয়। এই ঘোষণা বাঙালির ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতির অবরুদ্ধ ¯্রােতের ও মুক্তি লাভের ঘোষণা। বাংলাদেশ ও বাঙালি এই দুটি লুপ্ত নামের পুনঃ প্রতিষ্ঠা যার হাতে, বাঙালির নিজস্ব দেশ প্রতিষ্ঠার যার দীর্ঘ চব্বিশ বছরের আন্দোলন ও সংগ্রামের ফল তাঁকে বাঙালি জাতির জনক, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা পিতা ছাড়া আর কি নামে ডাকা যায়। 
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই বঙ্গবন্ধু আধুনিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র দেশের অর্থনৈতিক ও শোষিতের মুক্তির লক্ষ্যে দুঃসাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তার আগেই ঘাতকের হাতে পনর আগস্ট সপরিবারে নিহত হন। যা বাঙালি জাতির কাছে কালরাত শোকের দিন হিসেবে পালিত হয়।
বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন বাংলাভাষা যেন হয় বিশ্বসভায় বাঙালির সভ্যতার শ্রেষ্ঠ পরিচয়। তিনিই সর্বপ্রথম বাংলা ভাষায় জাতিসংঘে ভাষণ দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের নোবেল সাহিত্য পুরস্কার লাভের পর এটাই বাংলা ভাষার আনুষ্ঠানিক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। 
বঙ্গবন্ধু তার স্বপ্ন-সাধনা, সংগ্রামের মধ্যেই আত্মাহুতি দিয়েছেন। নিজের বুকের রক্তে, নিজের স্বজন পরিজনের রক্তে তিনি বাংলার নতুন ইতিহাস লিখে রেখে গেছেন, স্বাধীন বাংলার নতুন প্রজন্মের জন্য। তিনি আজ বাংলার জাতীয় পতাকার রক্ত সূর্য। বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু এই দুটি নাম আজ অভিন্ন। বাংলার স্বাধীনতা, ভাষা, সমাজ, সংস্কৃতি ও সভ্যতার মধ্যে বঙ্গবন্ধু চিরকালের জন্য চিরজাগ্রত। তাঁর মৃত্যু হয়নি। তিনি মৃত্যুঞ্জয়। 
বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর শ্রেষ্ঠ কীর্তি। তিনি তো আবহমান বাংলার চিরকালের প্রাণ প্রবাহ। বাংলার পাখির গানে কলতানে বাঙালির হাসি-কান্না, প্রেম, ভালোবাসায়, মিলনে-বিরহে তিনি চিরদিনের জন্য চিরকালের জন্য জাগ্রত, জীবন্ত। তিনি আরও বেশি জীবিত চিরকালের বাঙালির মনে ও মননে। মৃত্যুর তুচ্ছতা অতিক্রম করে যে মহানায়ক নিজের স্বপ্ন ও সংগ্রামের আলোকে আজ আলোকিত। তার সেই আলোকেই আমরা ভবিষ্যতের পথ চিনে নিতে চাই। তিনি আমাদের মুক্তিদাতা, আজকের এবং আগামী দিনেরও। তার আদর্শের উত্তরাধিকার বাঙালির সবচেয়ে বড় সম্পদ ও পাথেয়। তাই বঙ্গবন্ধু মৃত্যুঞ্জয়ী, তার স্মৃতি অক্ষয় ও অমর।

SUMMARY

1867-B3.jpg