বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু বাংলার স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা। তিনি জাতির জনক, বাংলাদেশের স্থপতি, তিনি স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি স্বাধীনতা, বাঙালি ও বাংলাদেশের প্রতীক পুরুষ। তিনি গরিব-দুঃখী নির্যাতিত-নিষ্পেষিত অসহায় মানুষের অভয়দাতা, ত্রাতা। তিনি ছিলেন পাকিস্তানের শাসক-শোষকের ত্রাস। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের বহুমুখী সফলতা ও কৃতিত্ব, অমিত সাহস, ত্যাগ এবং সাংগঠনিক দক্ষতার অনন্য ও অতুলনীয় গুণাবলী তার নামের সঙ্গে উপরোল্লিখিত অভিধাগুলো যুক্ত করেছে।
বঙ্গবন্ধুকে পৃথক পৃথক অভিধায় পৃথক করে মূল্যায়ন করলে সেটি হবে খন্ডিত এবং সার্বিকভাবে বঙ্গবন্ধুকে পাওয়া যাবে না। সার্বিকভাবে পূর্ণ বঙ্গবন্ধুকে পেতে হলে কোনো গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ করে নয়-বরং বৃহত্তর উপলব্ধি ও চেতনায় তাঁকে দেখতে হেব। সেটাই নিয়ম।
বঙ্গবন্ধুকে মানুষ দেখে, বিচার করে নিজ নিজ আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে সর্বোচ্চ ভালোবাসায় ও শ্রদ্ধায়। এভাবেই মানুষ সন্তুষ্টি পায় এবং স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে তার প্রিয় নেতাকে অন্যের কাছে উপস্থাপন করতে। নিজ নিজ জ্ঞানবুদ্ধি মতে নিজ উপলব্ধি জগতের বাইরেও মহান নেতাকে সবাই মহান করে রাখতে চায়। সকলের দৃষ্টিভঙ্গি এক রকম নাও হতে পারে। একজন শিক্ষকের দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধু যেমন, একজন ছাত্রের দৃষ্টিভঙ্গি সে রকম হবে না। তেমনই একজন ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, পেশাজীবীর দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। একজন শ্রমিকের বা একজন কৃষকের বঙ্গবন্ধুর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে সাজুষ্য থাকতেও পারে আবার না থাকতেও পারে।
বঙ্গবন্ধুর যারা কঠোর সমালোচক, যারা তার রাজনীতি, দর্শন বা পথ চলাকে পছন্দ করে না কিংবা সহ্য করতে পারে না, তাদের সকলের এক জায়গায় মিল রয়েছে। তারা সবাই নেতিবাচক দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধুকে দেখে। কারণ সুস্পষ্ট। কারণ তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের শত্রু। তারা বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রগতি-প্রগতি চায় না, তারা নিজেদের বাঙালি ভাবে না। তাই আমাদের আলোচনায় এরা পরিত্যাজ্য।
একজন মুক্তিযোদ্ধার দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধু এ রকম দৃষ্টিভঙ্গিতে রয়েছে অন্যদের চেয়ে স্বাতন্ত্র্যের ছোঁয়া এবং নতুনত্ব। শিক্ষিত ও সচেতন মুক্তিযোদ্ধারা ঢালাওভাবে বা খন্ডিতভাবে কিংবা ভাসাভাসা দৃষ্টিতে জাতির জনকে বিচার করেন না। একজন মুক্তিযোদ্ধা সর্বাগ্রে সকল বিতর্কের ও দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে রাখতে চেষ্টা করেন বঙ্গবন্ধুকে। তেমনেই বাঙালি জাতির জনক বা বাঙালির শীর্ষ নেতার আসনে বঙ্গবন্ধু বিনা অন্যকোনো নামের উল্লেখের সুযোগ দিতে চান না কোনো মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতার ঘোষণা ও ঘোষক প্রশ্নে একজন মুক্তিযোদ্ধার তড়িৎ জবাব : একাত্তর সালের ৪ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। কিন্তু নির্ধিদ্ধায় বলা যায় বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান-সৈয়দ নজরুল ইসলাম নন। তেমনই বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার বার্তাটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ঘোষণা করেছিলেন মাত্র মেজর জিয়াউর রহমান। সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হয়ে যেমন রাষ্ট্রপতি হওয়ার তালিকায় প্রথম হতে পারেন না, তেমনই বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার বার্তাটি ঘোষণা করে কেউ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক হতে পারেন না। এমনটি কেউ করবেও না। যদি কেউ এমনটি করে তবে জেনে-শুনে সচেতনভাবে করবে, ইতিহাস বিকৃতির জন্য।
একজন মু্িক্তযোদ্ধার দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধু যথার্থই বঙ্গবন্ধু; তিনি জাতির পিতা, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি এবং সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। ইতিহাসের পাতায় এবং বিশ্বের কোটি মানুষের মানসপটে এটাই বঙ্গবন্ধুর পরিচিতি। বঙ্গবন্ধু যেমন আছেন, তেমনভাবেই যেনো থাকেন; বিতর্কের উর্ধ্বে রাখতে হবে এই পরিচয় এবং বিকৃতি বা বিতর্কের সুযোগ যেনো না হয় কোনোক্রমেই।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের জন্য তাঁকে বিশ্বের অন্যতম খ্যাতনামা ঝঃধঃবংসধহ এবং যুদ্ধ বিশেষজ্ঞ মনে করা যায়। পৃথিবীর ইতিহাসে একজন রাজনীতিবিদের এ রকম সমৃদ্ধ ও মেপে মেপে কথা বলার ভাষণ আর আছে কিনা সন্দেহ। ৭ মার্চের ভাষণকে অনেকে ভাষার মাধুর্য ও শব্দ চয়নের জন্য কবিতা বলেছেন। কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধার দৃষ্টিতে ৭ মার্চের ভাষণের বক্তা যুদ্ধের মাঠের একজন অভিজ্ঞ ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন সর্বাধিনায়কও বটে। ভাষণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধ জয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ও সতর্কতার সকল নির্দেশ দিয়েছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি, যুদ্ধের সূচনা, জনগণের প্রতি আহবান সবই সুনিপূণভাবে তিনি উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন ক্স এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম ক্স যার যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থেকো ক্স শত্রুদের প্রতিরোধ করো এবং শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে লড়াই চালিয়ে যাও ক্স ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল-প্রভৃতি নির্দেশের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করার সুযোগ দেননি। একজন মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণের সঙ্গে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ এ্যাড্রেস-এর মিল খোঁজে পান।
বঙ্গবন্ধু দেশবাসী ও জনগণের কাছে স্বাধীনতার ঘোষণা পৌঁছিয়ে দিয়ে অবশেষে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে গ্রেফতার বরণ করেন। দেশকে ছারখার ও পোড়ামাটির ভাগ্যবরণের হাত থেকে রক্ষাকল্পে একজন মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতার বরণকে অসমসাহসিক প্রজ্ঞা বলে মনে করেন এবং বঙ্গবন্ধুর এই পদক্ষেপকে অত্যন্ত উচ্চ মূল্যের সম্মান দেন।
একজন মুক্তিযোদ্ধা অন্য সব কিছু বাদ দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে একজন উঁচুমানের অনুপ্রাণক হিসেবে দেখেন। তাঁরই উদ্দীপ্তপূর্ণ অনুপ্রেরণার ফল হিসেবে পাকিস্তানিদের বিতাড়ন করে দেশকে স্বাধীন করার জন্য দেশের তাবৎ মানুষ আর আপামর জনসাধারণ তাঁকে নেতা মেনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলো। অন্য কেউ ২৪ বছরের পরাধীন জীবনে এমন ঐক্য সৃষ্টি করতে পারেননি।
বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত মহৎ ও নরম হৃদয়ের মানুষ ছিলেন। মানুষের দুঃখ-কষ্ট দেখলে তিনি বিচলিত হয়ে পড়তেন। পূর্বাপর ঘটনা না জেনেই শুধু দুঃখী মানুষটির মুখের কথা শুনে তার দুঃখ লাঘবে তিনি তৎপর হতেন। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিশক্তির দিকটিও মুক্তিযোদ্ধাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতো গভীর উৎসুকের সঙ্গে। তাঁর স্মৃতিশক্তি এমনই প্রখর যে, জীবনে একবার যাকে দেখেছেন ও তার নাম জেনেছেন, তা তিনি আজীবন মনে রাখতে পারতেন। দেখা-সাক্ষাতে যত গ্যাপ বা বিলম্ব হোক না কেনো, বঙ্গবন্ধু তাঁর পূর্বপরিচিত লোকটিকে তার নাম ধরেই সম্বোধন করতেন। এমনই ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
লেখক : সাবেক শিক্ষক, প্রবন্ধকার ও সিনিয়র কলামিস্ট