সেই দিনটির দুঃসহ স্মৃতি-অধ্যাপক মোঃ আহবাব খান

 
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জন্য এক শোকাবহ দিন। ঐ দিনে বিংশ শতাব্দির ইতিহাসকে কলঙ্কিত করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স-পরিবারে হত্যা করে খন্দকার মোস্তাক ও তার দোসররা। আমি তখন রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের সম্মান ১ম বর্ষের ছাত্র। থাকি ঐতিহাসিক মুরারী চাঁদ কলেজের ছাত্রাবাসে। বৃহস্পতিবারে কলেজ ও বিভিন্ন পত্রিকায় সাজ সাজ রব। আগামীকাল শুক্রবার প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পরিদর্শনে আসবেন।
উল্লেখ্য যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের পক্ষ থেকে চ্যান্সেলর ও রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়। বঙ্গবন্ধু সাদরে আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের দৈনিক ইত্তেফাকের ১৫ই আগস্টের পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ‘বঙ্গবন্ধু আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করিবেন’ শিরোনামে। তাতে বলা হয়-‘রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করিবেন। চ্যান্সেলর হিসেবে বঙ্গবন্ধু এই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করিবেন। রাষ্ট্রপতির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করিয়াছেন। বঙ্গবন্ধু প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে অবস্থিত শহীদদের মাজার জিয়ারত ও মাজারে পুষ্পমাল্য অর্পণ করিবেন। মাজার জিয়ারতের পর তিনি কলাভবন প্রাঙ্গণে ইউ ও টিসি কর্তৃক প্রদত্ত অভিবাদন গ্রহণ করিবেন। ইহার পর বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরী স্কুল পরিদর্শনের পর বঙ্গবন্ধুর সহিত অভ্যর্থনা কমিটির সদস্যদের পরিচয় করাইয়া দেওয়া হইবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনকালে রাষ্ট্রপতির অন্যান্য কর্মসূচির মধ্যে রহিয়াছে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের মিউজিয়াম পরিদর্শন, জগন্নাথ হলের গণকবরে পুষ্পমাল্য অর্পণ, সায়েন্স এনেক্স ভবনে ডাটা প্রসেসিং ইউনিট পরিদর্শন, বিজ্ঞান ভবন ও পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ পরিদর্শন। ইহার পর রাষ্ট্রপতি ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে উপস্থিত হইবেন। ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে রাষ্ট্রপতির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধাঞ্জলি পাঠ করা ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ হইতে বঙ্গবন্ধুকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পতাকা ও ক্রেস্ট, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত রচনাবলী, বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রগতির এলবাম উপহার দেওয়া হইবে। এই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মচারীদের পক্ষ হইতে বাকশাল সদস্যদের জন্য আবেদনপত্র পেশ করা হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনকালে বঙ্গবন্ধুর সহিত উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দিন আহমদ, শিক্ষামন্ত্রী ডক্টর মোজাফফর আহমদ চৌধুরী উপস্থিত থাকিবেন।’
দৈনিক বাংলার এক প্রতিবেদন ‘বঙ্গবন্ধুকে আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বাগত জানাবে’ শিরোনামে বলা হয় ‘আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে একটি গৌরবোজ্জ্বল দিন। জাতির পিতা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ সকালে স্বল্পকালীন সফরে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর তিনি আরো একবার এসেছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু সেদিন তিনি শুধু ভাষণ দিয়েছিলেন। আজকের আসার সাথে তার অনেক তফাৎ। আজ তিনি পুরো ক্যাম্পাস ঘুরে ঘুরে দেখবেন। তার সম্মানে বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজন করেছে নানা বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান। তিনি আজ ভাষণ দেবেন দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি নতুন করে ছাত্র সমাজ যখন তাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্পর্কে ভাবছেন, তখন তাদের কাছে আসছেন জাতির পিতা। আজ তিনি নিজে বিশ্ববিদ্যালয়ে বলবেন ছাত্র-ছাত্রীদের দায়িত্ব কর্তব্যের কথা। দ্বিতীয় বিপ্লবের অগ্রণী সৈনিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রামী ছাত্র সমাজ আজ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য উদগ্রীব। আজ ১৫ই আগস্ট শুক্রবার বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছেন।’
কিন্তু ১৫ আগস্ট ঘুম থেকে উঠে রেডিও অন করি, শুনি অন্য কথা। কুখ্যাত ডালিমের কণ্ঠস্বর ঃ আমি মেজর ডালিম বলছি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে। আমি ৫ম ব্লকের ৫০৯ নং রুমের আবাসিক ছাত্র। আমাদের ছাত্রাধিনায়ক নওয়াব মজুমদার ভাইকে বলি রেডিও থেকে এভাবে ঘোষণা করতেছে। নওয়াব ভাই আমার কক্ষে এসে একই ঘোষণা শুনেন। নওয়াব ভাই ৫০৯নং কক্ষের বাহিরে রেডিও নিয়ে আসেন। ইত্যবসরে ছাত্রাবাসের ছাত্ররা জড়ো হয়েছেন। একই ঘোষণা বারবার বলছে। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করতে পারছেন না। এ হতে পারেনা, নিশ্চয়ই রেডিও’র ভুল। ইতিমধ্যে প্রায় সব ব্লকের ছাত্ররা জড়ো হয়েছে। ১ম ব্লকের ছাত্রাধিনায়ক ইমরান ভাই, ২য় ব্লকের ছাত্রাধিনায়ক জালাল ভাই, ৩য় ব্লকের ছাত্রাধিনায়ক (নাম মনে পড়ছে না), ৪র্থ ব্লকের ছাত্রাধিনায়ক শফিক ভাই, ৫ম ব্লকের ছাত্রাধিনায়ক নওয়াব ভাই, শ্রীকান্ত ছাত্রাবাসের ছাত্রাধিনায়ক ফনি ভূষণ চৌধুরী দাদা সবাই জড়ো হয়েছেন। সবার একই প্রশ্ন কি শুনলাম রেডিওর ঘোষণায়, এ হতে পারেনা। ছাত্রাধিনায়কবৃন্দ সকল ছাত্রকে বললেন তোমরা যার যার ব্লকে যাও আমরা দেখি কি হয়েছে। প্রতমে ছাত্রাধিনায়কবৃন্দ হোস্টেল কেন্টিনে যান, দেখেন কেন্টিনের ফোন বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে ঘাতকরা। ৩য় ব্লকের তত্ত্বাবধায়ক কলেজ উপাধ্যক্ষ মোঃ আব্দুল মতিন চৌধুরী স্যারের বাসায় একটি ফোন আছে। ফনিদা গং ছাত্রাধিনায়কবৃন্দ ফোনে খবরা-খবর নেওয়ার জন্য স্যারের বাসায় যান। গিয়ে দেখেন স্যারের ফোনও ঘাতকরা বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। ইতিমধ্যে সব ব্লকের তত্ত্বাবধায়ক স্যারেরা আমাদের সতর্ক করে দিয়ে বললেন আমারা যেন কেউই হোস্টেলের বাহিরে না বেরুই।
ইত্যবসরে রেডিওতে ঘোষণা জুম্মা’র নামাজের জন্য এক ঘন্টা কারফিউ শিথিল করা হয়েছে। আমরা দেখতে পেলাম আমাদের হোস্টেলের সামনের রাস্তা দিয়ে আর্মির গাড়ি অস্ত্র তাক করে ঘোরাঘুরি করছে। আমরা খুবই আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম। জুম্মার নামাজ পড়ার জন্য শিবগঞ্জ মসজিদে গেলাম। উদ্দেশ্য ওখানে লোকমুখে আরো কিছু জানতে পারবো। ওখানে গিয়ে লোক মুখে যা শুনলাম তা রীতিমত লোমহর্ষক ঘটনা। স-পরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করেছে ঘাতকরা। জননেতা আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, যুব সমাজের আপনজন শেখ ফজলুল হক মনিকে হত্যা করে ঘাতক দল। শুনেছি ছোট্ট শিশু রাসেল নাকি বাঁচার তাগিদে কাকুতি মিনতি করে বলেছে আমাকে মেরোনা কিন্তু ঘাতকরা তাকেও নৃশংসভাবে হত্যা করে। একমাত্র বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশের বাহিরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান এক বুক জ্বালা নিয়ে। বঙ্গবন্ধুর শাহাদত বার্ষিকীতে ঘাতকদের জানাই ধিক্কার, তারা বাংলাদেশের শত্রু, তারা বাংলাদেশ চায়নি। এখনো বাংলাদেশকে মনে প্রাণে মেনে নিতে পারছেনা।
আজকের এই দিনে আমাদের শপথ নিতে হবে বঙ্গবন্ধুর শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের মুখে হাসি ফুটানোর জন্য বঙ্গবন্ধুর তনয়া বাংলার নয়নমণি জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ‘দিন বদলের সনদ’ বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করতে একযোগে কাজ করে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এতেই বঙ্গবন্ধুর আত্মা শান্তি পাবে। আমি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি এবং বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিদের দেশে ফিরিয়ে এনে ফাঁসি কার্যকর করার জোর দাবি জানাই। তবেই জাতি কলঙ্কমুক্ত হবে।

SUMMARY

1865-1.png