৭৫’র ১৫ আগস্ট স্বাধীন বাংলাদেশের প্রায় সূচনালগ্নেই অর্থাৎ দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় বাঙালি জাতির কলঙ্কময় এক অধ্যায় রচিত হয়। সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলার বুকে বিপথগামী কিছু সেনা সদস্য জাতির সমস্ত অর্জনকে ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে। বাঙালি জাতির দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের ফসল বহুকষ্টের অর্জিত স্বাধীনতা ও স্বাধীনতার ইতিহাস রচনাকারী, সোনার বাংলার রূপকার আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের সব অর্জন সমূহকে চিরতরে বাংলার সীমানা থেকে মুছে ফেলার হীনস্বার্থের নীলনক্সা চরিতার্থ করে ফেলার চেষ্টা করে।
ইতিহাস ইতিহাসই। ইতিহাস কখনো ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে যায় না। যতই ইতিহাস বিকৃত করার চেষ্টা করা হয় না কেন; ইতিহাস তার আপন গতিতেই চলে। বহু ভুল, বিকৃতি, বিভ্রান্তি ’৭৫’র পরে হয়েছে কিন্তু তা ধোপে টিকেনি। বরঞ্চ এ বাংলায় ইতিহাস বিকৃতিকারীর স্বরূপই উন্মোচিত হয়েছে।
পথভ্রষ্ট ও উচ্ছন্নে যাওয়া সেনাবাহিনীর কিছু সদস্যদের উচ্চবিলাসী চিন্তা চেতনার ফলে দেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার পরিবার পরিজন সহ রক্তে রঞ্জিত হতে হয়েছে ১৫ আগস্ট ধানমন্ডি ‘বঙ্গবন্ধু হাউজের ৩২ নম্বর বাড়িটি।
বিদেশীরা যে বঙ্গবন্ধুকে তাঁর দেশের মানুষ ফুল দিয়েও কোনদিন ঢিল মারবে না জানতেন; সেই মানুষকে এই বাঙালিরাই বুলেটের আঘাতে বুক ঝাঝরা করে দিল! এটা বিশ্বাস করা যায় না, বিশ্বাস করাটা কঠিন। আর যতই কঠিন হোক এই কঠিনকেই খুব সহজ করেছে হত্যাকারীরা। ঘাতক ঘাতকই ঘাতকের হাত কোন দিন কাঁপে না।
পৃথিবীর মানুষ জানে বাঙালি ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করে ইতিহাস গড়েছে, সেই বাঙালিই আবার তাদের অকুতোভয় নেতাকে রাতের অন্ধকারে সপরিবারে মেরে ইতহাস রচনা করলো তবে এবার বীরের নয় কলঙ্কময় অধ্যায়ের ইতিহাস গড়লো অকৃতজ্ঞ কিছু বাঙালি।
পৃথিবীব্যাপি সবাই শ্রেষ্ঠ রাজনীতিক হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে জানে, মানে। কোন এক কাগজের একটি কলামে একবার পড়েছিলাম জর্জ ওয়াশিংটন ও জন এফ কেনেডির চেয়েও বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ঊর্ধ্বে ছিল।
বঙ্গবন্ধুর মত নেতা যুগে যুগে জন্মায় না। ক্ষণজন্মা পুরুষ বঙ্গবন্ধু। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সে কারণেই বলা হয় হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। বঙ্গবন্ধুকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বললে এক শ্রেণির মানুষের গায়ে আচড় লাগে। এই বিধ্বেষীরাই বঙ্গবন্ধুর নাম তাঁর সুনাম গুণগান সহ্য করতে পারে না। বঙ্গবন্ধু যে সোনার বাংলার প্রকৃত রূপকার বা স্থপতি তা তারা মানতে চায় না। তারা বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতাও মানে না! কেউ মানুক বা না মানুক লক্ষ কোটি বঙ্গবন্ধুর অনুসারীদের কিছু যায় আসে না; বঙ্গবন্ধুই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলার প্রকৃত রূপকার, বাংলার স্থপতি। ইতিহাস যতদিন আছে বঙ্গবন্ধুর নামও থাকবে ততদিন ইনশাল্লাহ। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্ন ধুলিস্যাৎ হতে দেখে স্থম্ভিত ও মুষড়ে পড়া বঙ্গবন্ধু অনুসারীরা পুনরায় আবার সম্বিত ফিরে পায় আর বঙ্গবন্ধুর অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বাণী স্মরণ করে আবার জেগে উঠে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন-তোমরা ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, তোমাদের যারা যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। তিনি তাঁর অমর ভাষণে আরো বলেন-‘মনে রাখবা, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি তোমরা ঘাবড়াবানা। তোমরা তোমাদের শত্রুর উপর ঝাপিয়ে পড়বা-এতেই বাংলার মানুষের মনে সাহস সঞ্চয় হল আর দুর্বার গতিতে আন্দোলনে নেমে গেলো। দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করে কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেছিলেন-তোমার সেনাবাহিনী, তোমার মন্ত্রীসভার সবাইকে এক সভা ডেকে সবাইকে এক সাথে শেষ করে দাও! বঙ্গবন্ধু ক্যাস্ট্রোর কথায় রেগে গেলেন; বললেন-এটা কি করে সম্ভব। না না আমি এটা কিছুতেই করতে পারবো না আমার বাংলার মানুষের সাথে। এটা কিছুতেই সম্ভব নয়। আর এরা মরে গেলে আমি দেশ চালাবো কি করে? নাহ আমি এদের সাথে বেঈমানী করতে পারবো না। তখন প্রেসিডেন্ট ফিদের ক্যাস্ট্রো বঙ্গবন্ধুকে বললেন-শুনো শেখ মুজিব; তুমি দেশ চালাবে তোমার দেশের ডাক্তার, উকিল, ইঞ্জিনিয়ার, স্কুল-মাস্টারদের দিয়ে-এরা বারবার ভুল করবে কিন্তু তোমার সাথে বেঈমানী করবে না। বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন তার দেশের মানুষেরা তাঁকে ফুল দিয়েও ঢিল মারবে না। মেরে ফেলাতো দূরের কথা। পরবর্তীতে ’৭৫’র ১৫ আগস্ট প্রেসিডেন্ট ক্যাস্ট্রের কথাই সত্য প্রমাণিত হল। বঙ্গবন্ধু যদি তাঁর কথামত চলতেন তাহলে জীবন দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে পরাজয় বরণ করতে হত না।
বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষকে জানপ্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন, ¯েœহ করতেন, বিশ্বাস করতেন, তাদের অভাব অভিযোগের কথা শুনে ঝাপাইয়া পড়তেন। সাধ্য দিয়ে চেষ্টা করতেন তার নিরীহ বাংলার জনগণের কষ্ঠ লাঘব করতে। নিষ্ঠুর বাঙালি তা বুঝলো না।
ফিদেল ক্যাস্ট্রো সাংবাদিকদের বলেছিলেন আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে দেখেছি। হিমালয় সম উচ্চতা ছিল বঙ্গবন্ধুর কিন্তু অকৃতজ্ঞ কিছু বাঙালি তাঁকে চিরতরে দুনিয়া থেকে তুলে দিল। বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন তবে তিনি কমিউনিস্ট ছিলেন না। তিনি পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে শোষণের যন্ত্র হিসেবে দেখতেন। বঙ্গবন্ধু আরো বলেন, পৃথিবীতে পুঁজিপতি সৃষ্টির অর্থনীতি যতদিন থাকবে ততদিন দুনিয়ার উপর থেকে শোষণ বন্ধ হবে না।
প্যারিসের বহুল আলোচিত ও প্রচারিত পত্রিকা লা মঁদ-এ (খব সড়ৎফব) ১৬ আগস্ট ১৯৭৫ সালে প্রথম পাতায় একটি বক্তব্য ছাপা হয়। লেখক রবার্ট এসকারপি। তিনি লিখেন ‘বড় নেতা তিনি যিনি সময়ের সাথে সাথে আরো বড় হতে থাকেন। তাকে খুন করে সমাজ থেকে দেশ থেকে নির্বাসিত করা যায় না। তিনি ফিরে আসেন বারবার। সদ্য প্রয়াত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান সেই মাপের নেতা। আন্তর্জাতিক জুলিও কুরি পুরস্কার প্রদানের সময় যখন তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু নয়’ বিশ্ববন্ধু হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল, তখন তিনি সবিনয়ে বলেছিলেন আমি বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের অবশ্যই বন্ধু কিন্ত আমাকে বঙ্গবন্ধু থাকতে দিন। আমি জীবনে-মরণে একজন খাঁটি বাঙালি হিসেবে থাকতে চাই। বাঙালির হাজার বছরের যে সভ্যতা ও সংস্কৃতিক ঐতিহ্য, সেই শাশ্বত ঐতিহ্যের রূপকার হওয়ার চাইতে অন্য কোন বড় পরিচয় আমার দরকার নেই। সে কারণেই বঙ্গবন্ধুকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির আসনে অধিষ্ঠিত করা হয়েছে।
আরেকটি ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ করছি; ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে সরকারি কাজে রাজশাহী গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। রাজশাহীতে তাঁকে রাত্রি যাপনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল সার্কিট হাউজের দোতলায়। রাত তখন গভীর, নীচের তলায় স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতা কর্মীদের শোরগোলে বঙ্গবন্ধুর ঘুম ভেঙ্গে গেলে তিনি নিচে নেমে আসেন বিছানা ছেড়ে এবং নিচে এসে দেখতে পান কর্তব্যরত পুলিশরা শীতের মধ্যে ডিউটি করে যাচ্ছেন। তিনি সেন্ট্রিদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা এখানে কি করছো? সেন্ট্রিরা উত্তর দিল ডিউটি করছি স্যার আমরা। তখন বঙ্গবন্ধু বললেন আমি শীতে ঘুমাতে পারছিনা আর তোমরা রাত জেগে আমাকে পাহারা দিচ্ছ তা কি করে হয়। তোমরা যাও গিয়ে ঘুমাও। পাহারা দেওয়ার দরকার নেই। পুলিশ অফিসাররা বললেন, স্যার তা কি করে সম্ভব। আর আপনার নিরাপত্তা? বঙ্গবন্ধু বললেন দেশে কেউ আমাকে মারবে না!
গণভবনে অফিস করাকালীন সময়ে অফিস কক্ষে এয়ারকন্ডিশনের ব্যবস্থা ছিল। স্বাভাবিক কারণে জানালাগুলি বন্ধ ছিল। বঙ্গবন্ধু বললেন জানালাগুলি খুলে দাও। বাইরের বাতাস আমার ভাল লাগে। এসব এসি টেসির দরকার নেই। কর্তব্যরত পুলিশের স্মৃতিচারণ থেকে কাগজে এ গুলা লেখা ছিল। বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষকে অকৃত্রিমভাবে ভালোবাসতেন তার ছোট একটি উদাহরণ দেই। এক বিদেশী সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ডযধঃ রং ুড়ঁৎ য়ঁধষরভরপধঃরড়হ? আপনার যোগ্যতা কি? উত্তরে এই নেতা বলেছিলেন ও ষড়াব সু ঢ়বড়ঢ়ষব আমি আমার দেশবাসীকে ভালোবাসি। সেই সাংবাদিক আবার তাঁকে প্রশ্ন করলেন ডযধঃ রং ুড়ঁৎ ফরংয়ঁধষরভরপধঃরড়হ অর্থাৎ আপনার অযোগ্যতা কী? বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের অত্যন্ত শান্ত স্বরে জবাব দিলেন ও ষড়াব ঃযবস ঃড়ড় সঁপয আমি তাদের বড্ড বেশি ভালোবাসি।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বিদেশ থেকে সাত কোটিরও বেশি রিলিফ কম্বল এসেছিল। অনেক বেশি পরিমাণে কম্বল আসার পরও অনেকে কম্বল পাননি। তখনকার রেডক্রসের চেয়ারম্যান ছিলেন গাজী গোলাম মোস্তফা। বঙ্গবন্ধু তাকে ইশারা করে বললেন গাজী সাহেব আমার কম্বলটি কই? বঙ্গবন্ধু বললেন আমি কাকে দোষ দিব, কাকে মারবো-আমার সামনে চোর, পিছে চোর, ডানে চোর, বামে চোর। এই চোরদের নিয়ে আমাকে চলতে হচ্ছে। এরা এদেশেরই সন্তান! এরা আমাকে দিনে বঙ্গবন্ধু বলে, রাতে চুরি ডাকাতি করে। তিনি ক্ষমা করে দিতে জানতেন। তাই অনেকে এই দুর্বলতার সুযোগ নিত। এবং পার পেয়ে যেত।
আল কোরআনে সুস্পষ্ট ঘোষণা আছে, ‘যে জাতি নিজেদের চরিত্রের পরিবর্তন করে না, আল্লাহতায়ালা সেই জাতির পরিবর্তন করেন না। উক্ত আয়াত থেকে এই তত্ত্ব পাওয়া যায় যে, চরিত্রহীন জাতি আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হয়ে যায়। তখন সেই জাতির প্রতিটি পদক্ষেপ ও কর্ম তাদেরকে পথভ্রষ্টতার দিকে ঠেলে দেয়। ইতিহাসে এর অসংখ্য প্রমাণ আছে। আজ আমরা একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক। আল্লাহতায়ালার এই নিয়ামতকে মর্যাদা দিতে হবে। এই নিয়ামতকে অবমাননা করলে কঠোর শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে আমাদেরকে। আজ আমাদেরকে বঙ্গবন্ধুর জীবন ইতিহাস থেকে উপদেশ নেওয়া প্রয়োজন।
বঙ্গবন্ধু নশ্বর এই পৃথিবীর অবিশ্বর মানব। তারপরও কোন মানুষই ভুল-ভ্রান্তির ঊর্ধ্বে নয়। বঙ্গবন্ধুও ভুল ভ্রান্তির উর্ধ্বে ছিলেন না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি সর্বক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করতে পারেননি। এর জন্য অবশ্যই তিনি একা দায়ী নন। দায়ী যুদ্ধবিধ্বস্ত ধ্বংসলীলা, ভঙ্গুর অর্থনীতি, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ইত্যাদি। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির ন্যায় সঙ্গত দাবির জন্য মৃত্যুর পরওয়ানা করেননি। স্বাধীনতা সংগ্রামে তার ভূমিকা ছিল অম্লান। তিনি বাংলাদেশের স্থপতি। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তাঁর অবদান এতই গগণচুম্বি যে শত চেষ্টা করলেও ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলা সম্ভব নয়।