বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা-আবদুল হামিদ মানিক


জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন প্রজ্ঞাবান দূরদর্শী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। দূরদর্শিতার ফলেই তার দেখানো পথ ধরে বাঙালি আজ স্বাধীন। সেই সময় বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশ ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত। তাই বাংলার স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হওয়া এবং সেই পথে জাতিকে পরিচালনা করা অত্যন্ত কঠিন এবং ঝুঁকিপূর্ন ছিল। যে কোনো সময় রাষ্ট্র-দ্রোহিতার অভিযোগে বঙ্গবন্ধু কঠিনতম দ-ে দ-িত হতে পারতেন। সেই বিপদসংকল সময়ে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতাই জাতিকে নিয়ে আসে স্বাধীনতার উজ্জ্বল উঠানে। 
বাঙালি হঠাৎ গজেিয় ওঠা কোনো জাতি নয়। এ জাতির আছে হাজার বছরের ইতিহাস ঐতিহ্য। সেই পৌরানিক যুগেও বঙ্গঁভূমির অস্তিত্ব ছিল। আর্য জনগোষ্ঠি যে দৃষ্টিতে বঙ্গঁ ও বাঙালিকে দেখেছে তা হয়তো খুব গৌরবের নয়। কিন্তু এতে এ সত্য নিশ্চিত হয় যে, বাঙালি একটি প্রাচীন জাতি। সংগ্রামী এ জাতির স্বাধীন রাষ্ট্রীয় পরিচয় নিশ্চিত করেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালির পর্যায়ক্রমিক রাজনৈতিক আন্দোলন নির্দিষ্ট লক্ষ্যে এসে স্থির হয় ১৯৭১ সালে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জাতি লাভ করে স্বাধীনতা। এর মূল প্রেরণা এবং প্রধানতম প্রাণপুরুষ হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। 
কোনো রাষ্ট্র আকস্মিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় না। এর পেছনে থাকে দীর্ঘ প্রস্তুতি। জনগোষ্ঠিকে মানসিক ভাবে প্রস্তুত করে তুলতে হয়। সচেতন জনগোষ্ঠিকে ক্রমান্বয়ে নিয়ে যেতে হয় অভীষ্ট লক্ষ্যে। এর জন্য প্রয়োজন সময়, সঠিক দিক নির্দেশনা এবং সংগ্রাম ও আন্দোলন। মূল ব্যক্তির থাকে স্বপ্ন। সেই স্বপ্নের দিকে যাত্রায় জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হয়। এর জন্য প্রয়োজন প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা। বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্নও প্রজ্ঞা ছিল। সে লক্ষ্যে আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন, জেল জুলুম সহ্য করেছেন। অবশেষে সফল হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম পর্যালোচনা করে বলা যায় যে, বাঙালির স্বাধীনতা তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠতম অর্জন। 
বঙ্গবন্ধু শুরু করেছিলেন মুসলিমলীগের রাজনীতি দিয়ে। ছাত্রজীবন থেকেই ছিলেন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। বৃটিশ শাসন থেকে মুক্তির লক্ষ্যে তখনকার প্রধান নেতাদের সঙ্গে তরুণ শেখ মুজিব সংগ্রামী কর্মকা-ে যুক্ত ছিলেন। দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ারদি, শেরে বাংলা ফজলুল হক, মাওলানা ভাসানী প্রমুখ নেতৃবৃন্দের। ১৯৪৭ সালে উপহাদেশ বিভক্ত হলো। কায়েম হলো পাকিস্তান। সেই নতুন দেশটিতে বাঙালির স্বকীয় সত্তা স্বাধীন ভাবে বিকশিত হবে না- এ সত্যটি শুরুতেই শেখ মুজিব বুঝেছিলেন। ১৯৪৮ সালেই অগণতান্ত্রিক শাসকদের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদী হয়ে উঠেন। সভা সমিতি শোভাযাত্রা সংগঠনের অভিযোগে ১৯৪৮ এর মার্চ ও সেপ্টেম্বরে দু’বার তাকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৪৯ সালে মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। তখনই তার সংগ্রামী চেতনা ও প্রত্যয় সুদৃঢ় হয়ে উঠেছিল। পরবর্তীতে ধাপে ধাপে তিনি অগ্রসর হন সেই পথে যে পথ বাঙালির চূড়ান্ত মুক্তি অর্থাৎ স্বাধীনতায় এসে স্থির হয়। ঐ সময় তাঁর স্বপ্নের প্রকাশ্য ঘোষণা হতো আত্মঘাতী, রাষ্ট্রদোহিতা। তাই প্রজ্ঞার সঙ্গে তিনি গ্রহণ করেন পদক্ষেপ। পর্যায়ক্রমে তার নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলনই মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয়। জন্ম হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের । 
বাঙালির মুক্তির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর জীবনের অনেক গুলো বছর কেটেছে কারাগারে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১। অন্যায় অবিচার বৈষম্যের বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রামী শেখ মুজিব ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্রাবস্থায় ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। ঐ বছরই উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করার ঘোষণার প্রতিবাদ জানান, ১১ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার হন। ১৯৪৮ সালে ২৩ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। তিনি জেলে থাকা অবস্থায় দলের, যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫২ সালে ২৬ জানুয়ারি খাজা নাজিম উদ্দিন আবার ঘোষণা করেন-উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। শেখ মুজিব জেলখানায় প্রতিবাদে অনশন শুরু করেন। এই ধারাবাহিকতার ১৯৫৩ সালের ৯ জুলাই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিলে তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের যাত্রা শুরু হয় নতুন উদ্যমে। আসে ১৯৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন। ২৩৭ আসনের ২২৩ টিতে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ী হয়। নির্বাচিত হন শেখ মুজিবও। ২৯ মে কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভা বাতিল করে দেয়। শেখ মুজিব আবার গ্রেফতার হন। 
পাকিস্তানের রাজনীতিতে শেখ মুজিব সংগ্রামী এবং বাঙালির মুক্তিকামী ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেন। আসে ১৯৫৮ সাল। সামরিক শাসন জারি করেন আইয়ুব খান। গ্রেফতার হন শেখ মুজিব। প্রায় চার বছর জেলে বন্দী থাকেন। ১৯৬২ সালে ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দল সমূহের জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। শেখ মুজিব বাঙালির মুক্তি সদন ৬ দফা দাবি পেশ করেন। শুরু করেন গণসংযোগ। এ পর্যায়েও তিনি বার বার গ্রেফতার হন। বাঙালির এই মুক্তিসনদ ঘোষণার পর তার ওপর জেল জুলুম বৃদ্ধি পায়। বার বার গ্রেফতার হতে থাকেন। এ পর্যায়েই পাক শাসক গোষ্ঠি ১৯৬৮ সালের ৩ জানুয়ারি শেখ মুজিবকে এক নম্বর আসামী করে ৩৫ জন সেনা ও সিএসপি অফিসারের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রুজু করে। পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগে গ্রেফতারকৃতদের মুক্তির দাবিতে শুরু হয় আন্দোলন। এ আন্দোলন গণ আন্দোলনে পরিণত হয়। চাপে মুখে সরকার ১৯৬৯ এর ২২ ফেব্রুয়ারি মামলা প্রত্যাহার করে। ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে ছাত্র জনতার বিশাল সমাবেশে শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি রাওয়াল পি-িতে আইয়ুব খানের গোলটেবিল বৈঠকে যোগদেন বঙ্গবন্ধু। ৬ দফা ও ছাত্রদের ১১ দফা মেনে নেওয়ার আহ্বান জানান। স্বায়ত্ত্বশাসন মেনে নিতে চাপ দেন। দাবি অগ্রাহ্য হলে তিনি ফিরে আসেন। 
এই পরিস্থিতিতে দৃশ্যে আসেন ইয়াহিয়া খান। জারি করেন সামরিক শাসন। আসে ১৯৭০ এর নির্বাচন। ৭ ডিসেম্বর নির্বাচনে নিরংকুশ বিজয় লাভর পরও ক্ষমতা হস্থান্তরে টালবাহানা শুরু হয়। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সের জনসমুদ্রে ঘোষণা করেন-এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতা সংগ্রাম। তাঁর এই আহ্বান এবং আজীবন সংগ্রামের পথ ধরেই ১৯৭১ সালে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে আসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধু লাভ করেন জাতির জনকের আসন। সফল হয় তাঁর স্বপ্ন। তাই দেশে-বিদেশে আজ বঙ্গবন্ধু দূরদর্শি নেতার মর্যাদায় স্বীকৃত।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক সিলেটের ডাক।

SUMMARY

1863-1.png