বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের প্রেরণা-আবদুল হামিদ মানিক


বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা আলাপ আলোচনায় অর্জিত হয়নি। এ জন্য সশস্ত্র যুদ্ধ করতে হয়েছে। অস্ত্র হাতে শত্রুর মোকাবেলা করতে গিয়ে প্রাণ দিতে হয়েছে ত্রিশ লক্ষ বাঙালির। একদিকে তৎকালীন বিশ্বের নামকরা সেনাবাহিনী, অপর দিকে মাস তিনেকের ট্রেনিং নেয়া বীর মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন ময়দানে। মরণপণ এ লড়াইয়ের ময়দানে প্রেরণার অনন্য উৎস ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ। ভাষণের প্রতিটি শব্দ ও বাক্য ন’ মাস ব্যাপী মুক্তিযোদ্ধাদের এবং স্বাধীনতাকামী প্রতিটি বাঙালিকে জুগিয়েছে সাহস। প্রমাণিত হয়েছে বাক্যের শক্তি বুলেটের চেয়েও বেশি হতে পারে। সেই ভাষণ আজও ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে।
বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ আজ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি লাভ করেছে। জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো ভাষণটি বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছে। বাঙালির গৌরব তাতে স্বতন্ত্র মাত্রায় উজ্জ্বলতা লাভ করলো। সংস্থাটির দ্বিবার্ষিক সম্মেলন ছিল ৩০ অক্টোবর ২০১৭। অনুষ্ঠিত হয় প্যারিসে। ১৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা বিশেষজ্ঞ কমিটি দু’বছর ধরে যাচাই বাছাই করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়। এটি অবশ্যই একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। মেমোরি অব দ্যা ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে এভাবে বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তিদের সঙ্গে একটি ভাষণ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ঠাই করে নিয়েছে। এটি অবশ্যই আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। আব্রাহাম লিংকন, মার্টিন লুথার কিং, হো চি মিন, আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট, ক্রমওয়েল, জর্জ ওয়াশিংটন, মাওসেতুং, চার্চিল প্রমুখের ভাষণ যেমন বিশ্ব ঐতিহ্য, স্বাধীন বাংলার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর ভাষণও আজ সেই মর্যাদায় অভিষিক্ত। ভাষণটি বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
বাগ্মীতা বা চিত্তাকর্ষক বক্তৃতার দক্ষতা সকলের থাকেনা। অনেকে ভালো লিখতে পারেন কিন্তু জনসমাবেশে দাঁড়িয়ে কথা বলতে বিব্রত হয়ে পড়েন। পান্ডিত্য এবং বাকবৈদগ্ধও সব সময় একত্রিত হয় না। বক্তৃতার দক্ষতা বিশেষ একটি গুণ বা শিল্প। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাগ্মীতার মতো বিরল গুণের অধিকারী ছিলেন। ছিলেন প্রথম শ্রেণির সংগঠক। কথার প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও রাজনৈতিক দক্ষতার ফলেই তিনি বিপদসংকুল পথ পাড়ি দিয়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম জাতির জনকের মর্যাদায় আজ আসীন।
বঙ্গবন্ধু সেই বৃটিশ আমলেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন। ছাত্রজীবন থেকেই শুরু। হাতে খড়ি হয় অবিভক্ত ভারতের রাজনৈতিক বিশেষ ব্যক্তিত্ব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কাছে। আর তখন থেকেই ছোট বড় সমাবেশে তাকে বক্তৃতা দিতে হয়। তার ছিল প্রখর অনুভূতি এবং পরিবেশ পরিস্থিতি অনুধাবনের বিশেষ ক্ষমতা। কণ্ঠও ছিল ওজস্বী। লেখার ভাষা আর বক্তৃতার ভাষা এক নয়। বক্তৃতার শ্রোতা থাকেন সাক্ষর নিরক্ষর। তাই ভাষায় থাকতে হয় সহজ সরলতা। যাতে সকলেই তা সহজে বুঝে। এমন চিত্তাকর্ষক ভাষা ও শব্দ চয়নে বঙ্গবন্ধু শ্রোতাদের হৃদয় জয় করে নিতে পারতেন। তার এই বাগ্মীতার ঐতিহাসিক ও উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত ১৯৭১ এর ৭ মার্চের ভাষণ, যা অনেকের মুখস্থ হয়ে আছে। এর আগেও পরেও বঙ্গবন্ধু যে সব ভাষণ দিয়েছেন, রাজনীতির অঙ্গনে তাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং হৃদয়গ্রাহী হিসেবে প্রশংসিত।
বঙ্গবন্ধু স্বতন্ত্র আবাসভূমির আন্দোলন, ১৯৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনকালে স্থানে স্থানে সফর করেছেন। সংগঠক হিসেবে, দলীয় নেতা হিসেবে মিশেছেন সকল স্তরের লোকের সঙ্গে। সভা সমাবেশে বক্তৃতা দিয়েছেন। বিশেষ করে ১৯৬৬ সালে ছয় দফা ঘোষণার পর তার বক্তৃতায় সতর্কতা ও শব্দ চয়নে বিশেষ পারদর্শিতা লক্ষ্য করা যায়। সে ছিল এক দ্বিমুখী সংকটকাল। বাঙালির অধিকার আদায়ে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা এবং একই সঙ্গে পাকিস্তানে রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগ থেকে আত্মরক্ষার জন্য তাকে সব সময় সতর্ক থাকতে হয়েছে। এর পরও সারাদেশে তিনি সফর করেছেন। একেক দিনে চার পাঁচটি সমাবেশেও তাকে বক্তৃতা দিতে হয়েছে। তিনি সতর্কই ছিলেন। তবু ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানী শাসকচক্র সাজায় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। গণ-আন্দোলনের মুখে সে মামলা তুলে নিতে হয়। বঙ্গবন্ধুসহ অভিযুক্তরা মুক্ত হন। আসে ১৯৭০ এর নির্বাচন। ততদিনে বঙ্গবন্ধু বাঙালির প্রাণপ্রিয় একক নেতার আসন গ্রহণ করে নিয়েছেন। তাঁর বক্তৃতায়ও এসেছে বেশি প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা। তাঁর প্রতিটি আহবানে জনগণ সাড়া দেয়, আন্দোলিত হয়। বাঙালির একক নেতা হিসেবে এমন জনপ্রিয়তা আর কেউ পাননি।
বঙ্গবন্ধুর এই জনপ্রিয়তার ফলেই বাঙালি ১৯৭০-এর নির্বাচনে তাঁর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়। পাকিস্তান জাতীয় সংসদে লাভ করে সংখ্যাগরিষ্ঠতা। ইয়াহিয়া খান সংসদের অধিবেশন আহবান করেন। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠি বুঝতে পারে যে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বাঙালির হাতে চলে যাচ্ছে। শুরু করে ষড়যন্ত্র। ইয়াহিয়া-ভুট্টো মিলিত হন। সংসদের অধিবেশন স্থগিত করেন ইয়াহিয়া খান। ডিসেম্বরে নির্বাচনের পর ফেব্রুয়ারি মাসে অধিবেশন হওয়ার কথা ছিল। স্থগিত ঘোষণার পর জনগণ রাস্তায় নেমে আসে। বঙ্গবন্ধুকে নতুন নির্দেশ দিতে আহবান জানায়। মধ্যখানে ইয়াহিয়া-ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠকেরও প্রহসন করেন। ফল হয়নি। আসে সেই ঐতিহাসিক ৭ মার্চ ১৯৭১।
বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণই ছিল প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা-এবং শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধের আহ্বান। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়েই জাতি লাভ করেছে স্বাধীনতা।
১৯৭১ সালে যোগাযোগব্যবস্থা আজকের মতো ছিল না। এরপরও ঐদিন দেশের নানা প্রান্তের মানুষ ছুটে যায় নির্ধারিত স্থান রেসকোর্স ময়দানে, যা বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নামে পরিচিত। বঙ্গবন্ধু আসবেন। বক্তৃতা দিবেন। মুক্তিকামী, স্বাধিকার আদায়ে নিবেদিতপ্রাণ জনগণকে দেবেন পথের দিশা। এই প্রত্যাশায় লোকারণ্য হয়ে ওঠে মাঠ। বঙ্গবন্ধু জানতেন, মানুষ আর আপোস চায়না। চায় স্বাধীনতা। কিন্তু স্পষ্টভাবে নেতা যদি এ ঘোষণা দেন, তাহলে সেটি হয়ে যাবে রাষ্ট্রদ্রোহিতা। এর পরিণাম তাৎক্ষণিকভাবেই হবে মারাত্মক। এই উভয় সংকটে বঙ্গবন্ধু এলেন মাঠে। ধীর পায়ে উঠলেন মঞ্চে। লক্ষ লক্ষ মানুষ উন্মুখ। সারা দেশ অধীর অপেক্ষায়। কবি নির্মলেন্দু গুণ বঙ্গবন্ধুর এই সময় ও ছবি নিয়ে চমৎকার কবিতাও লিখেছেন। বঙ্গবন্ধু ধীর ও গম্ভীর কণ্ঠে শুরু করলেন-বক্তৃতা। মাত্র ১৯ মিনিটের সেই বক্তৃতাতেই একটি জাতির ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেল। সে ছিল বিস্ময়কর এক কণ্ঠ। প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা, আবেগ, সাহস, দৃঢ়তা ও শব্দ চয়নে উৎকৃষ্ট এক ভাষণ। উত্তাল জনসমুদ্রে এক যুগসন্ধিক্ষণে দেওয়া সেই ভাষণ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বক্তৃতার তালিকায় স্থান পেয়েছে। কঠিন সংকটে এত ভারসাম্যপূর্ণ বক্তৃতা সত্যই বিরল। কে ভুলতে পারে সেই সব প্রেরণাসঞ্চারী বাক্য : আজ-দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ, বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তাঁর অধিকার চায়। কী অন্যায় করেছিলাম? নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে, আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল এসেমব্লি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করবো এবং এদেশকে আমরা গড়ে তুলবো। এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, ২৩ বছরের করুণ ইতিহাস, বাংলার অত্যাচারের বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস, ২৩ বছরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস, বাংলার ইতিহাস এ দেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।’ অথবা ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ।’ এই বক্তৃতার প্রতিটি কথাই এমনি হৃদয়জয়ী। তাঁর ঐ বজ্রকণ্ঠের শেষ বাক্য ছিল ঃ এবাবের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
বক্তৃতা শেষ হতেই জয় বাংলা শ্লোগানে কেঁপে উঠেছিল সমগ্র ঢাকা। এই ঘোষণা এবং শ্লোগানের জোরেই ন’মাস যুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে আজ বাংলা স্বাধীন। এই ভাষণের প্রেরণাই জাতিকে নিয়ে আসে স্বাধীনতার উজ্জ্বল উঠানে।
ঐতিহাসিক সেই ভাষণের প্রেরণা আজও এ দেশের মানুষকে উদ্দীপ্ত করে। কালজয়ী কথামালা তরুণ প্রজন্মের উদ্দীপনার উৎস। যারা বঙ্গবন্ধুকে দেখেনি, দেখেনি মুক্তিযুদ্ধ, তারাও সেই সময়ের বাস্তবতা অনুভব করে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়। তাই এ ভাষণ আগামীতেও থাকবে অম্লান।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক সিলেটের ডাক।

SUMMARY

1860-4.jpg