‘খোকা’ থেকে বঙ্গবন্ধু


ঝর্ণা মনি :

১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি। অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ পরিদর্শনে যান। তাদের আগমনে এক সংবর্ধনার আয়োজন করে কৃষক প্রজা পার্টি ও মুসলিম লীগ। মিশন স্কুল পরিদর্শন শেষে প্রধানমন্ত্রী শের-ই-বাংলা ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যখন বাংলোতে ফিরে যাচ্ছিলেন তখন রোগা পাতলা একটি বালক তাদের পথ আগলে দাঁড়ালেন। হতভম্ব সব ছাত্র ও শিক্ষক। প্রধান শিক্ষক বারবার ধমক দিচ্ছেন, কিন্তু জেদি, একরোখা, লিকলিকে ছেলেটি নাছোড়বান্দা। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে দাবি আদায় না করে রাস্তা ছাড়বেন না বলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বাংলার বাঘ খ্যাত প্রধানমন্ত্রীও অবাক। এতটুকুন ছেলে, অথচ কি অসম সাহসী, যে কি না শের-ই-বাংলার পথ আগলে দাঁড়ায়! তবুও কণ্ঠে মাধুর্য এনে বললেন, ‘কি চাও তুমি?’ লিকলিকে বালকের সপ্রতিভ উত্তর, ‘আমাদের স্কুলের একমাত্র ছাত্রাবাসের ছাদ নষ্ট। পানি পড়ে টপটপ করে। ছাত্রদের বিছানাপত্র নষ্ট হয়ে যায়। এ কাজে প্রয়োজন মাত্র ১২০০ টাকা। এটা সারাবার ব্যবস্থা না করে দিলে আমি পথ ছাড়ব না।’ অসম্ভব সাহসী, বিনয়ী আর পরোপকারী ছাত্রটির কথায় মুগ্ধ প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে সরকারি ত্রাণ তহবিল থেকে ১২০০ টাকা মঞ্জুর করে দেন।
তিনি টুঙ্গিপাড়ার খোকা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মধুমতি, বাইগার নদীতে সাঁতার কেটে কেটেছে যার দুরন্ত শৈশব। সময়ের পরিক্রমায় এই খোকাই একদিন হয়ে ওঠেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্ম নেয়া খোকার, বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছে অদম্য ত্যাগ, অকুতোভয় নেতৃত্ব আর গভীর দেশপ্রেম। বাবা শেখ লুৎফর রহমান এবং মা সায়েরা খাতুন। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর দায়িত্ব নেয়ার মতো মহান গুণ হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন শৈশবেই। মুষ্টি ভিক্ষার চাল উঠিয়ে গরিব ছেলেদের বই এবং পরীক্ষার খরচ বহন করা, বস্ত্রহীন পথচারী শিশুকে নিজের নতুন জামা পরাতেন। রাজনৈতিক দীক্ষা নেন স্কুল জীবনেই। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময়ের কথা অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি নিজেই তুলে ধরেছেন, ‘দিন রাত রিলিফের কাজ করে কুল পাই না। লেখাপড়া মোটেই করি না। কলকতা যাব, পরীক্ষাও নিকটবর্তী। আব্বা একদিন আমাকে ডেকে বললেন, ‘বাবা রাজনীতি কর, আপত্তি করব না, পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করছ, এতো সুখের কথা। তবে লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হতে পারবা না।’
স্বাধীনতার জন্য বাংলার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছেন বঙ্গবন্ধু। প্রতিটি বাঙালির কাছে পৌঁছে দিয়েছেন পরাধীনতার শিকল ভাঙার মন্ত্র। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৮-এর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয়দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানসহ প্রতিটি স্বাধিকার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন সবার প্রিয় ‘মুজিব ভাই’। আর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পাবার পরদিন ২৩ ফেব্রæয়ারি ১৯৬৯ সালে ঢাকার রেসকোর্স (সোহরাওয়ার্দী) ময়দানে এক বিশাল জনসভায় ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমদ তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভ‚ষিত করেন। সেদিন থেকেই তিনি বাঙালির প্রাণের নেতা ‘বঙ্গবন্ধু’।
বাংলাদেশের নামকরণ হয় বঙ্গবন্ধুর মাধ্যমেই। পাকিস্তানিরা বাংলার নাম রাখতে চেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান। এই ঘৃণ্য চক্রান্তের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ করেন শেখ মুজিব। ১৯৫৫ সালের ২৫ আগস্ট পাকিস্তানের গণপরিষদে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, স্পিকার, ওরা (পাকিস্তানিরা) পূর্ব বাংলার নাম পরির্বতন করে পাকিস্তান রাখতে চায়। বাংলা আমাদের অহঙ্কার। এই নামের ইতিহাস আছে। গণপরিষদে বঙ্গবন্ধুর এই প্রতিবাদকে আগ্রহের সঙ্গে গ্রহণ করে। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকীর আলোচনা সভায় শেখ মুজিব বলেন, এদেশের মানচিত্র থেকে, বাংলা কথাটি চিরতরে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। তারা যদি সফল হয় তাহলে শুধু বঙ্গোপসাগর ছাড়া আর কোথাও এই নামটির চিহ্ন পাওয়া যাবে না। আমি বাংলার মানুষের পক্ষ থেকে ঘোষণা করছি, আজ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের নাম পরির্বতন করে বাংলাদেশ রাখা হোক। বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনে তার সীমাহীন ত্যাগ তিতিক্ষা, নির্যাতন, কারাবরণের কারণে তাকে জাতির পিতার অভিধায় অভিষিক্ত করে বাঙালি।
অসীম সাহসিকতার জন্য ব্রিটিশ রাজকবি টেড হিউজ বঙ্গবন্ধুকে অভিহিত করেছেন ‘টাইগার অব বেঙ্গল’ হিসেবে। বিখ্যাত দার্শনিক আঁন্দ্রে মার্লো বঙ্গবন্ধুকে তুলনা করেছেন বাঘের বাচ্চার সঙ্গে। ২৬ মার্চ ২০০৪ সালে বিবিসি বাংলা সার্ভিসের জরিপে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যার ৫৫ বছরের জীবনে ১২ বছরের অধিক কেটেছে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে, জীবনের অর্ধেক কেটেছে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নে আর পুরো জীবন গেছে স্বাধীনতা নির্মাণে।

SUMMARY

186-1.jpg