১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হওয়ার পরও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে পাকিস্তানের ক্ষমতা না দিয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টো ও জেনারেল ইয়াহিয়া খান টালবাহানা করতে থাকে। এরই ধারায় ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধু ও বাঙালিদের হেয় করে বক্তব্য দেন। এতে বাঙালিরা প্রতিবাদের উত্তেজনায় ফেটে পড়ে। জয়দেবপুরে তেমনি এক পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী গুলি ছুঁড়লে অনেকে নিহত হয়। তখন আন্দোলন আরও তীব্র হয়ে ওঠে। এ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে ৩রা মার্চ পল্টনে অনুষ্ঠিত জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। অসহযোগ আন্দোলনের কারণে পূর্ব পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ অচল হয়ে পড়ে, তখন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই সকল কার্যক্রম পরিচালিত হতে থাকে।
বাংলার নিরিহ মানুষের উপর চলতে থাকে অবিরাম নির্মম অত্যাচার। বাঙালি জাতিকে ধ্বংসের নেশায় মেতে ওঠে বহুবিধ ষড়যন্ত্রে। স্বৈরাচারী শাসকরা পাকিস্তানে গোড়া হতেই বৈষম্য সৃষ্টি করে আসছিল। রাজনৈতিক, সামরিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও বৈষম্য ক্রমাগত বাড়তে থাকে। ফলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সম্পর্কের মধ্যে ব্যবধান হয়ে দাঁড়ায় বিরাট। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের অব্যবহিত পর থেকেই পূর্ব বাংলা রাজনৈতিক বৈষম্যের শিকার হতে শুরু করে। পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠী নানাভাবে বাঙালি জাতিকে বঞ্চিত রাখার টালবাহানা করে আসছিল। তারা এ নিরিহ জাতির উপর নির্দয়ের মত নির্মম হত্যাকান্ড শুরু করে। এসবের হাত হতে রেহাই পাওয়ার জন্য বাঙালিরা লড়াই করে আসছিল বহুকাল থেকেই। কিন্তু পোড়া কপাল শোষণের হাত হতে মুক্তি পাচ্ছিল না। একের পর এক শোষকের কাছে শোষিত হতে হতে চলছিল এই পথচলা। কিন্তু এবার বাঙালিরা আর বসে থাকবে না। এবার তীব্র প্রতিবাদ জানাতে রাজপথে নামতে রাজি নির্যাতিত, নিরিহ, শোষিত ও বঞ্চিত বাঙালি জাতি। পাকিস্তানিদের দুঃশাসন থেকে মুক্তিলাভ করতে আপোসহীন এক সংগ্রামের জন্য তৈরি হতে থাকে বাংলার দামাল ছেলেরা, কৃষক, মজুর, জেলে, তাঁতিসহ সকল শ্রেণি পেশার মানুষেরা।
এদিকে বাঙালি জাতির জনক, বাংলার অবিসংবাদিত নেতা পাকিস্তানের আতঙ্ক। রাজপথ কাঁপানো বীর সাহসী, বাংলার মুকুটহীন স¤্রাট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব নির্ধারিত ৭ই মার্চ ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক বিশাল জনসভায় একটি ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। উক্ত ভাষণে স্বাধীনতার প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়। বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালিদের মধ্যে চেতনা জাগিয়ে তুলেন। তিনি ১৯৫২-৫৪-৬৬-৬৯ ও ৭০ সালের নির্বাচনও তুলে ধরেন বাংলার বিদ্রোহী জনসমুদ্রে। বাঙালিদের স্বাধিকার আদায়ে তিনি সচেষ্ট এবং আপোসহীন করে গড়ে তুলতে বলেন, ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল প্রত্যেক ঘরে ঘুরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে, বাঙালির মনে তীব্র তেজ সৃষ্টি হয়। তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথাগুলি মন দিয়ে শুনছিল। স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হয় বাংলার নির্যাতিত জনতার বুকে। তারাও ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচারের অবসান করতে। বাংলার মানুষ সেদিন প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। শান্তশিষ্ঠভাবে জাতির জনকের মূল্যবান দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্য শুনছিল তারা। তিনি তখন জনসমুদ্রের উদ্দেশে বলেন, ‘এবং তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো, ইনশাল্লাহ।’
বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই ঐতিহাসিক ভাষণে রয়েছে স্বাধীনতার সংগ্রামে উজ্জীবিত হওয়ার ডাক। এরই সূত্র ধরে বাঙালি জাতি তীব্র আন্দোলনে নেমে পড়ে। এ ভাষণটি করে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা যোগায়। ৭ই মার্চ এর পর বাঙালিরা ঐক্যবদ্ধ হয় এদেশকে রক্ষা করার জন্য। আনন্দের বিষয় হলো, অবশেষে অনেক অত্যাচার, নির্যাতনের অবসান ঘটিয়ে বাংলার মানুষ স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হয়। আমরা কখনও ভুলতে পারবো না এক সাগর রক্তদানের কথা। আমরা আজ মুক্ত, স্বাধীন এটা মাথা উঁচু করে বলতে পারি।
আরও আনন্দের বিষয় হলো- ২০১৭ সালের অক্টোবরের শেষে ইউনেস্কো ৭ মার্চের ভাষণকে ‘ডকুমেন্টারী হেরিটেজ’ (বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য) হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশ দীর্ঘজীবি হোক। জয় বাংলা। বঙ্গবন্ধুর আত্মার শান্তি কামনা করি।
লেখক : কলামিস্ট