অগ্নি ঝরা মার্চের আজ একাদশতম দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে উত্তাল ছিল এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত। জাতি তখন প্রতিবাদে-প্রতিরোধে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। স্বাধীনতার আন্দোলন ক্রমেই উত্তাল থেকে উত্তালতর হতে থাকে। শান্তিপূর্ণভাবে অসহযোগ আন্দোলন সফল হওয়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর দেশবাসীর আস্থা বেড়ে যায়। পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ, নিপীড়ন-বঞ্চনার বিরুদ্ধে অগ্নিবিদ্রোহের চূড়ান্ত রণপ্রস্তুতি চলছিল। একাত্তরের এই সময়টায় বাঙালী জাতির মুখ্য চিন্তা ও লক্ষ্য তখন একটাই ছিল- ‘স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ’। তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান অনেক আগেই পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। একমাত্র সেনা ছাউনি ছাড়া কোথাও পাকিস্তানীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। পুরো দেশ, দেশের মানুষ চলছিল একমাত্র এক ব্যক্তির নির্দেশে, তিনি হলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ও সামরিক জান্তার রক্তচক্ষু ও আদেশ উপেক্ষা করেই সব দোকানপাট, অফিস-আদালত, কল-কারখানা, কোর্ট-কাছারি বন্ধ রাখা হয়। একাত্তরের এই দিনে ন্যাপ (ওয়ালী) বাংলাদেশ শাখার সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, পাঞ্জাব আওয়ামী লীগ সভাপতি এম খুরশীদ, কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রধান মমতাজ দৌলতানার বিশেষ দূত পীর সাইফুদ্দিন ও ঢাকায় নিযুক্ত জাতিসংঘের সহকারী আবাসিক প্রতিনিধি উলফ বাংলাদেশের অনানুষ্ঠানিক রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁর ধানমন্ডির বাসভবনে পৃথক বৈঠকে মিলিত হন। এদিকে, রাতে সামরিক কর্তৃপক্ষ সামরিক আদেশ জারি করেন। সামরিক নির্দেশে কেউ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকারী সম্পত্তির ক্ষতিসাধন করলে অথবা সশস্ত্র সেনাবাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণ বা সেনাবাহিনীর গতিবিধিতে অন্তরায় সৃষ্টি করলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি দেয়া হয়। কিন্তু সামরিক আদেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে সেনাবাহিনীর রসদ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে মুক্তিপাগল সংগ্রামী জনতা। সিলেটে রেশন নেয়ার সময় সেনাবাহিনীর একটি কনভয়কে বাধা দেয়া হয়। যশোর ও অন্যান্য এলাকায়ও এ ধরনের ঘটনা ঘটে। টাঙ্গাইলে বিন্দুবাসিনী হাই স্কুল ময়দানে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় ন্যাপপ্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বঙ্গবন্ধু ঘোষিত স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ঘোষণা করে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান ৭ কোটি বাঙালীর নেতা। তাই, নেতার নির্দেশ পালন করুন। লক্ষ্য অর্জনের জন্য সবাই একসঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম করুন। এ মুহূর্তে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনরকম বিভেদ থাকা উচিত নয়। একাত্তরের এই দিনে পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচী থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে পাঠানো এক বার্তায় বলেন, দেশের ভবিষ্যত আজ অনিশ্চিত। এ ব্যাপারে আমাদের উভয়ের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। ধ্বংস এড়ানোর জন্য মানুষের সাধ্যায়ত্ত সবকিছুই আমাদের করতে হবে। দেশকে রক্ষা করতে হবে যেকোন মূল্যের বিনিময়ে। স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের চারজন নেতা অন্য এক যৌথ বিবৃতিতে সরকার প্রদত্ত যাবতীয় খেতাব ও পদক বর্জনের জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। এ বিবৃতিতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর চলাচলে কোন সহযোগিতা না করার জন্যও দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানানো হয়। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর জন্য খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করা থেকে বিরত থাকার জন্যও জনগণের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। এই দিনে ছাত্র ইউনিয়ন দেশবাসীকে সংগঠিত করতে একটি লিফলেট ছাড়ে। সেখানে তারা পাক হানাদারদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হবার আহ্বান জানায়। এভাবে একেকটি দিন যেতে থাকে আর বাড়তে থাকে উত্তেজনা। সংঘবদ্ধ হতে থাকে বাঙালী। বাড়তে থাকে বাঙালীর মনের জোর।