ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু- ফয়েজ আহমদ বাবর


শেখ মুজিব ও বাংলাদেশ একে অপরের অবিচ্ছেদ্য অংশ। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটিকে কল্পনা করা যায় না। বঙ্গবন্ধু ছিলেন স্বাধীনতার প্রতীক ও জাতীয় বীর। তিনি ছিলেন খাঁটি দেশপ্রেমিক। তিনি বাংলার মাটি ও মানুষের জন্য অকাতরে নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন। বাংলার জনগণের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন। রাজনীতিতে আদর্শ ও মূল্যবোধের চর্চায় এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু। অন্য রাজনীতিবিদদের তিনি রোল মডেল। তাই ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু একটি হিরণ¥য় নাম।
ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবন সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে যেমন জানতে হবে তেমনি তার জীবনী থেকে বর্তমান যুগের রাজনীতিবিদদের অনেক কিছু শেখার আছে। তিনি আজীবন নিয়মতান্ত্রিক ও অহিংস আন্দোলনে বিশ্বাসী ছিলেন। ৭ মার্চের ভাষণে তার প্রতিপক্ষকেও ভাই বলে সম্বোধন করেছেন। তিনি কখনো কাউকে অমর্যাদা, অসম্মান করেননি। তিনি রাজনৈতিকভাবেই সবকিছু মোকাবেলা করেছেন। এসবের মাঝে বেড়ে ওঠা মানুষের মধ্যে যে চিন্তা-ভাবনা, চেতনা, কর্ম এক বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মধ্যে জাগরণ সৃষ্টি করে; জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষকে এক কাতারে নিয়ে সার্থক প্রতিনিধিরূপে আবির্ভূত হন এমন মানুষ ইতিহাস সৃষ্টি করেন, ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করেন। আবার ইতিহাসের প্রয়োজনে কোনো কোনো মানুষের আবির্ভাব ঘটে। মুজিবের জন্ম ইতিহাসের প্রয়োজন হয়েছিল?
১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মবার্ষিকী। বাঙালি জাতির সৌভাগ্য যে, মুজিবের মতো এক মহান নেতা জন্মগ্রহণ করেছিলেন এ বাংলার সবুজ-শ্যামল মাটিতে। তিনি জন্মগ্রহণ করেন তৎকালীন ফরিদপুর জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। তার পিতার নাম শেখ লুৎফর রহমান ও মাতার নাম সায়েরা খাতুন। শেখ মুজিব পিতা-মাতার তৃতীয় সন্তান ছিলেন। বাল্যকালে তার ডাকনাম ছিল খোকা। কেউ কি কোনো দিন ভেবেছিল শেখ পরিবারে জন্ম নেয়া খোকা নামের এ ছেলেটি বাঙালি জাতির লড়াই সংগ্রাম, স্বাধীনতায় নির্যাতিত-নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর ত্রাণকর্তা, মুক্তির দিশারি হবেন? গভীর দেশপ্রেম, রাজনৈতিক দক্ষতা, প্রজ্ঞা, সীমাহীন আত্মত্যাগ, সর্বোপরি জনগণের প্রতি তার অতুলনীয় মমত্ববোধ, ভালোবাসার কারণে ক্রমান্বয়ে তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা। তার সংগ্রামময় বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন তাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে বাংলার জনমানুষের মহান নেতার আসনে। বাঙালি স্বাধীনতা অর্জনে তার সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষা, জেল-জুলুম, নির্যাতন- কারাবন্দি ইতিহাসে তাকে জাতির পিতার অভিধায় অভিষিক্ত করেছে। আজ সারা বিশ্বে তার বড় পরিচয় বাঙালি জাতির পিতা।
বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা, সংগ্রামের মধ্য দিয়ে একটি জাতির পরিচয় পাওয়া যায়। বাঙালি জাতি বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ ধরে পরাধীন শাসনে আবদ্ধ থেকে শোষণ-নির্যাতন-অত্যাচারে নিষ্পেষিত হয়েছে। তাই নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠাকল্পে সংগ্রাম করে আসছে যুগ যুগ ধরে। আমরা যদি অতীত ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাই তাহলে দেখতে পাব, আদিম যুগে বহিরাগত আর্যরা এ দেশে জোরপূর্বক বসতি স্থাপন করে। তখন দেশের জনগোষ্ঠী তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। সে প্রতিবাদ সংগ্রামী চেতনায় যুগে যুগে বহিরাগত শক্তি বা বিজাতীয় শাসক-শোষকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের দুর্গ গড়ে তুলতে এ দেশের সংগ্রামী জনতাকে বার বার উদ্বুদ্ধ করেছে। তাই বলা যায়, আর্য, হূন, পাঠান, মোগল, ইংরেজ পরিশেষে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বাঙালির আত্মচেতনা সব সময় সক্রিয় ছিল।
তাই ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ১৭৫৭ সালে ঐতিহাসিক পলাশী প্রান্তরে মীরজাফরের সীমাহীন বিশ্বাসঘাতকতায় বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলা প্রায় ২০০ বছর ইংরেজের অধীনে প্রদেশে পরিণত হয়। তখন থেকে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম চলছিল তার লক্ষ্য ছিল বিজাতীয় শাসক-শোষকের হাত থেকে বাংলাকে রক্ষা করে দেশীয়দের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করা। তাই ধর্মীয় চেতনার ভিত্তিতে বিনা রক্তপাতে ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পশ্চিত পাকিস্তান তাদের ১৫০০ মাইলের ব্যবধানে ধর্মের নামে আমাদের ২৪ বছর শাসন-শোষণ করে। বাঙালি জাতি হয় নিষ্পেষিত। এ শোষণের হাত থেকে বাংলাকে রক্ষার জন্য পলাশী ট্র্যাজেডির নায়ক সিরাজের অবয়বে সাহসী প্রতীকের মতো এগিয়ে আসেন এ দেশের মাটি ও মানুষের সঙ্গে যার নিবিড় সম্পর্ক গণমানুষের মহান নেতা চির অকুতোভয় শেখ মুজিব। বাঙালির সামনে শেখ মুজিব আবির্ভূত হন তাদের ত্রাণকর্তা হিসেবে। বঙ্গবন্ধু তার অসামান্য সাংগঠনিক দক্ষতার দ্বারা স্বাধীনতার লক্ষ্যে বিভিন্ন আন্দোলনের জন্ম দেন। এজন্য তাকে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা, জেল-জুলুম-নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। এমনকি তাকে ফাঁসির মঞ্চেও যেতে হয়েছে। তবুও তিনি নীতির প্রশ্নে আপস করেননি। স্বাধীনতার পথ থেকে বিচ্যুত হননি। আন্দোলনকামী এ মানুষটি যৌবনের অধিকাংশ সময় কাটালেন কারাগারে। ১৯৫২ থেকে '৭১ পর্যন্ত বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে তার সুযোগ্য নেতৃত্বে তিনি বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে নিয়ে যান। বাঙালির কাক্সিক্ষত স্বাধীনতাকে যে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিল তার প্রবাদপুরুষ ছিলেন শেখ মুজিব। তিনি স্বাধীনতার প্রশ্নে সমগ্র জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করেন; যার ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিপাগল জনতা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে আনে। বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্থান পায়। বঙ্গবন্ধু সে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা। আমরা সে রাষ্ট্রের গর্বিত নাগরিক।
বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন একটি সুখী-সমৃদ্ধ, শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে। নিষ্পেষিত শোষিত বাংলাকে সোনার বাংলায় পরিণত করতে। তার সুযোগ্য নেতৃত্বে বাঙালি জাতি পেয়েছে একটি পতাকা, নির্দিষ্ট ভূখন্ড, মানচিত্র, সংবিধান এবং স্বাধীন সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। '৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে তার অবদানকে খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় তার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও বাঙালি জাতিসত্তার ইতিহাস থেকে শত চেষ্টায় ইতিহাস বিকৃত করে তাকে ছোট করা যাবে না। ইতিহাসে তার স্থান নির্ধারিত হয়ে গেছে। তিনি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে একটি ঘুমন্ত জাতিকে জাগাতে পেরেছেন। তার অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতার দ্বারা একটি প্রচন্ড গণআন্দোলনের জন্ম দিয়েছিলেন। দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ে বিশ্বাসী বিরাট ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ না হলে তা সম্ভব হতো না। এজন্য প্রয়োজন অসামান্য ধৈর্য ও সাহসিকতা। মুজিবের তা ছিল বলেই সাফল্য অর্জন করে হয়েছেন মৃত্যুঞ্জয়ী।
সারা বিশ্বে আজ তার বড় পরিচয় জাতির পিতা হিসেবে। '৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একদল বিপথগামী জুনিয়র সামরিক অফিসার কর্তৃক পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ তিনি শাহাদাতবরণ করেন। তার জন্মদিন পালিত হবে শিশু দিবস হিসেবে। বঙ্গবন্ধু শিশুদের অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতেন। তারই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৭ মার্চকে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রতি বছর এ দিবসটি পালিত হয় এটি একটি মহৎ উদ্যোগ এতে কোনো সন্দেহ নেই। শিশুদের নিয়ে ভাবনা তাদের জন্য কিছু করা। তাদের জাতির ইতিহাসের সঙ্গে পরিচয় করে দেয়। বিশেষ করে বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে পরিচয় করে দেয়। দেশ ও জাতির বৃহত্তম স্বার্থে তা প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধুর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন নিয়ে অনেক কবি-সাহিত্যিক গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ ইত্যাদি রচনা করেছেন। তার জীবনীকে শিশুদের কাছে তুলে ধরতে হবে। ২০০৯ সালের ১৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস পালন উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সভায় বলেন, বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম শিশু-কিশোরদের সুনাগরিক ও সাহসী হয়ে গড়ে উঠতে হবে। তাদের জন্য চাই প্রচুর যথোপযোগী বই। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কিভাবে জাতির পিতা হয়ে উঠলেন, কিভাবে এ দেশের মানুষকে জাগিয়ে তুলেছিলেন এবং সাড়ে ৭ কোটি মানুষের জন্য স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনলেন তার ত্যাগ আর সংগ্রাম এসব বিষয়ে শিশু পাঠ্যবই আমাদের প্রকাশ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন। কারণ নতুন প্রজন্মকে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানতে হবে। একই সঙ্গে বাঙালি জাতির স্বাধীনতার ইতিহাসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ শিশু আজ বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত। অপুষ্টির কারণে বিভিন্ন রোগব্যাধিতে তারা ভুগছে। প্রাথমিক শিক্ষা লাভ থেকে সমাজের একটি অংশ আজ বঞ্চিত। তাদের জন্য শিক্ষার সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত গরিব পিতা-মাতাকে মাঠে-ময়দানে, খেতে-খামারে সাহায্যের জন্য অনেকে পড়াশোনা করতে পারছে না। শিশু শ্রম নিষিদ্ধ হলেও দেশের বিভিন্ন কল কারখানায় শিশুরা আজ কাজ করছে শুধু দারিদ্র্যের কারণে। বর্তমানে শিশুরা বিভিন্ন শোষণ-বঞ্চনার শিকার। শিশু ধর্ষণ এখনো বন্ধ হয়নি। শিশু পাচার-ধর্ষণ রোধ করতে হবে। তাদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষার পাশাপাশি বিনোদনের সুব্যবস্থা করলে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের যথেষ্ট সহায়ক হবে। তাদের সামনে মহৎ ব্যক্তি খ্যাতনামা বীরদের আদর্শ তুলে ধরা উচিত। এভাবে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে তাদের চরিত্র গড়ে তোলার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যাতে তারা ভবিষ্যৎ যোগ্য নাগরিক হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারে। তাই 'বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস' পালন তখনই সার্থক হবে যখন শিশুদের জন্য একটি সুন্দর উপযুক্ত সমাজব্যবস্থ্য আমরা গড়ে তুলতে পারব।
বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবন সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে যেমন জানতে হবে তেমনি তার জীবনী থেকে বর্তমান যুগের রাজনীতিবিদদের অনেক কিছু শেখার আছে। তিনি আজীবন নিয়মতান্ত্রিক ও অহিংস আন্দোলনে বিশ্বাসী ছিলেন। ৭ মার্চের ভাষণে তার প্রতিপক্ষকেও ভাই বলে সম্বোধন করেছেন। তিনি কখনো কাউকে অমর্যাদা, অসম্মান করেননি। তিনি রাজনৈতিকভাবেই সবকিছু মোকাবেলা করেছেন।
নিয়মতান্ত্রিক ও অহিংস আন্দোলনই হচ্ছে তার সারা জীবনের রাজনীতির ভাষা। বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে আমরা স্বাধীন দেশ পেতাম না। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা নিজেদের পরিচয় দিতে পারতাম না। সারা বিশ্বে স্বাধীন সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তিনি পরিচয় অর্জন করেছেন। বাঙালি জাতি তার কাছে ঋণী। আজ তার ৯৭তম শুভ জন্মদিনে শ্রদ্ধা জানাই।
লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক।

SUMMARY

1843-1.png