উত্তাল ১৮ মার্চ


 রক্তঝরা উত্তাল মার্চের ১৮তম দিন । ৭ মার্চের পর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে এই অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়েছিলো। আজকের এই দিনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসভবনে ঢল নামে সকল বয়সী মানুষের। ভোর থেকে শুরু হওয়া এই জন¯্রােত গভীর রাত পর্যন্ত ছিলো। গগন কাঁপানো শ্লোগান মুখর জাতির জনকের বাসভবন। শপথদীপ্ত ছাত্র-ছাত্রী, যুবক-যুবতী, শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, কর্মচারী, শ্রমিক, কৃষক, নার্স, ব্যবসায়ী, পেশাজীবীদের সংগঠনগুলো অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি অকুণ্ঠ আস্থা জ্ঞাপনপূর্বক নেতার আশীর্বাদ কামনা করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে সমাগত বিদেশী সাংবাদিকদের এসব মিছিলের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে আবেগ ভরা কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘বিদেশী বন্ধুরা দেখুন।  আমার দেশের মানুষ আজ প্রতিজ্ঞায় কি অটল, সংগ্রাম আর ত্যাগের মন্ত্রে কত উজ্জীবিত। কার সাধ্য এদের রুখে? আমার দেশ আজ জেগেছে, জনগণ আজ জেগেছে। জীবন দিতে শিখেছে। স্বাধীনতার জন্য জীবন দানের অগ্নিশপথে দীপ্ত জাগ্রত জনতার এ জীবন জোয়ারকে প্রচন্ড এ গণবিস্ফোরণকে স্তব্ধ করতে পারে এমন শক্তি মেশিনগানেরও আজ আর নেই।’ বাসভবনে আগত একের পর এক মিছিলের উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত ভাষণে প্রত্যয়দৃপ্তভাবে মুক্তি সংগ্রামের পতাকা আরও ঊর্ধ্বে তুলে ধরার আহ্বান জানিয়ে আপামর বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের সর্বাধিনায়ক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জলদ গম্ভীর স্বরে বলেন, ‘বাংলার মানুষ তোমরা ঘরে ঘরে সংগ্রামের দুর্গ গড়ে তোলো। আঘাত যদি আসে, প্রতিহত করো, পাল্টা আঘাত হানো। ৭ কোটি শোষিত-বঞ্চিত বাঙালির সার্বিক মুক্তি অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। চরম ত্যাগের বিনিময়ে হলেও আমরা লক্ষ্যে পৌঁছুবই। দরকার হলে রক্ত দিয়েই আমরা দাবি প্রতিষ্ঠা করব। তবু শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না। দাবি আদায় শান্তিপূর্ণভাবে হলে ভালো, নইলে সংগ্রামের দুর্গম পথ ধরেই আমরা লক্ষ্যস্থলে গিয়ে পৌঁছুব।’ নার্সিং স্কুলের ছাত্রীদের এক বিশাল মিছিল তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সামনে সমবেত হয় এবং শ্লোগান দিতে থাকে। তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই করতালি দিয়ে মিছিলটিকে স্বাগত জানিয়ে ‘জয় বাংলা’  শ্লোগান দিয়ে তাদের উদ্দেশে বলেন, ‘তোমরা স্বাধীনতা পাবে।’ এসময় কয়েকজন বিদেশী সাংবাদিকের একটি গ্রুপ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে আসেন। এদিকে, গত ২ মার্চ থেকে ৯ মার্চ পর্যন্ত সময়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় কি পরিস্থিতিতে বেসামরিক প্রশাসনের সাহায্যার্থে সামরিক বাহিনীকে ডাকা হয়েছিল তার তদন্তের জন্য। ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক প্রশাসক ৫ সদস্যবিশিষ্ট যে কমিটি গঠনের কথা ঘোষণা করেন সে সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু এক দীর্ঘ বিবৃতিতে বলেন, ‘এহেন তদন্ত কমিশন আমরা চাই নাই। আমরা চেয়েছিলাম সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও প্রকাশ্য তদন্ত।’ বিবৃতিতে তিনি আরও বলেন, ‘আমি দুঃখিত যে তদন্ত কমিশনের কথা ঘোষণা করা হয়েছে সেটি বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ হতে উত্থাপিত আমার দাবির পরিপূরক নয়। একটি সামরিক নির্দেশ বলে এই সামরিক কমিশন গঠন এবং সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছেই এর রিপোর্ট দাখিলের বিধান অত্যন্ত আপত্তিকর। কমিশনের বিবেচ্যসূচিই মূল ইস্যুর পূর্বাহ্যিক বিচার এবং আসল ইস্যুর তদন্ত না করার মতলব ফাঁস করে দিয়েছে। একমাত্র বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, মার্চ মাসের ২ তারিখ থেকে ৯ তারিখের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় যে পরিস্থিতিতে বেসামরিক প্রশাসনের সাহায্যার্থে সেনাবাহিনী তলব করা হয়েছিল তা নির্ধারণ করা। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বেসামরিক প্রশাসনের সাহায্যার্থে নয়, বরং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্যই সেনাবাহিনী তলব ও শক্তি প্রয়োগ করা হয়েছিল কিনা তা তদন্ত করতে হবে বিধায় মূল বিষয় সম্পর্কে শুনানির আগেই বিচার করে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব নির্যাতনমূলক কার্যকলাপে হাজার হাজার লোক হতাহত হয়েছে সে সম্পর্কেও তদন্ত করার এখতিয়ার তদন্ত কমিশনকে দেয়া হয়নি। আর তাই কতজন মারা গেছে, কী পরিস্থিতিতে নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করা হয়েছে সেটিও তদন্ত করে দেখা যাবে না। এহেন কমিশনের দ্বারা কোনো ফলপ্রসূ লক্ষ্য হাসিল হতে পারে না। বস্তুতঃ এটি মোটেই সত্যে উপনীত হওয়ার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একটি যথাযথ তদন্ত হবে না। হবে জনগণকে ধোঁকা দেয়ার একটি ফন্দি মাত্র। তাই, আমরা এ কমিশন মেনে নিতে পারি না। বাংলাদেশের জনগণ কোনো প্রকারেই এ ধরনের কমিশনের সঙ্গে কোনো সহযোগিতা করবে না। কেউ এ কমিশনে কোনো সদস্য মনোনীত করবেন না এবং কেউ এর অধীনে কাজ করবেন না।’ এছাড়া আজ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে কয়েক শতাধিক লোক মিছিল সহকারে এসে এ মর্মে অভিযোগ করেন যে, গত কয়েকদিন যাবৎ সেনাবাহিনীর সদস্যরা যশোর, খুলনা, রাজধানী ঢাকার মহাখালী এসব জায়গায় সাধারণ মানুষের ওপর জোরজুলুম করে মারধর করে টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নিয়েছে। বিনা উস্কানিতে সেনাবাহিনীর এহেন কার্যকলাপের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি পার্টির উপনেতা এবং দলের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম এক বিবৃতিতে বলেন, ‘কোনোরূপ উস্কানিমূলক আচরণ তা যে মহলই করুক না কেন, তা সহ্য করা হবে না এবং এর দায়-দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে উস্কানিদাতাদেরই বহন করতে হবে।’

SUMMARY

1841-1.png