যে ভাষণ ইতিহাসের দলিল- ঝর্না চৌধুরী


ইতিহাস কাঁদে বাঙালির হৃদয়ে। আর কাঁদে স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিচারণ করে। স্মৃতির মৃত্যু নেই। আমাদের মহান নেতা আমাদের পথ প্রদর্শক। সোনার বাংলার জন্মদাতা। কালজয়ী এক পুরুষ।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর থেকেই পশ্চিমারা এদেশের রাজত্ব কায়েম করে পূর্ব বাংলা আর পশ্চিম বাংলার মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির পায়তারা করে আসছিল। তারা উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করার ঘোষণার পর বাঙালি ক্ষোভে ফেঁটে পড়ে। তারা রাজপথে আন্দোলন করে ভাষার দাবী প্রতিষ্ঠা করে ১৯৫২ সনে। এ দাবী আদায় করতে গিয়ে বাঙালির রক্ত ঝড়ে,  অনেক আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে দাবী আদায় করে তারা আজ অমর হয়ে আছে।
১৯৬৬ সালে লাহোরে সর্বদলীয় বৈঠকে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা দাবি পেশ করেছিলেন। ১৯৬৯ এর গণঅভ্যূত্থান এবং ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠে। তখনি বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার আন্দোলনের বিষয়টি অনুধাবন করতে পারেন এবং ১৯৭১ সনে স্বাধীনতার আন্দোলন চূড়ান্ত ভাবে রূপ নেয়।
৬ মার্চ  ইয়াহিয়া বাঙালির উদ্দেশ্যে ভাষণে বাঙালিকে শিক্ষা দেয়ার ঘোষণায় বাঙালি বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তারা বঙ্গবন্ধুর দিকে চেয়ে থাকে। বঙ্গবন্ধু সেদিন বলেছিলেন, যা বলবো তা ৭ মার্চ ভাষণেই বলবো। ৭ মার্চ সারা বাংলায় উত্তেজনা, লাখো লাখো বাঙালি লাঠি সোটা নিয়ে রেসকোর্স ময়দান বর্তমানে সহোরাওয়ার্দী উদ্যানে জড় হতে থাকে। বাঙালি শ্লোগানে শ্লোগানে উদ্যান মুখরিত করে তুলেছিল।
বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেছিলেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। আর এ ভাষণেই বঙ্গবন্ধু যুদ্ধের সব দিক নির্দেশনার কথা বলেছিলেন। বাঙালি তাঁর এই ভাষণে দীক্ষিত হয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ ইতিহাসে অলংকিত হয়ে আছে। শুধু ইতিহাস কেন?  সারা বিশ্ব জুড়েই স্বীকার করেছে । বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষণ। কালজয়ী ভাষণে বাঙালির মনে স্বাধীনতার স্পৃহা জাগরিত হয়।
বিশ্ব জানে ৪৬ বৎসর পূর্বে মার্চ মাসের ২৫ তারিখ ঘুমন্ত বাঙালির উপর পাকবাহিনী যে গণহত্যা চালিয়ে ছিল তা বাঙালি কোন দিন ভুলবে না। এসব কিছুই ইতিহাসের স্বাক্ষী। পদ্মা মেঘনা যমুনা যেমন আমাদের, তেমনি ভাবে আমাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতা আমাদের নিজস্ব। আর স্বাধীনতার মহানায়ক আমাদের সোনার বাংলার অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সন্তান কখনো পিতা মাতার নাম ভুলে থাকতে পারে না। তেমনি ভাবে বাঙালি কোন দিন কোন কালেও ইতিহাস এবং বঙ্গবন্ধুর নাম ভুলবে না। যারা ভুলে থাকতে চায় বা চাচ্ছে তাদের চোখে এবং মনের কোনে কালো ধোঁয়া বাসা বেঁধেছে। তবে আমি পাঠক অন্ধকার অতীত ঘরের জানালা ভাংতে চাই। দেখতে চাই স্মৃতির ঘুম ঘরে থাকা জাতির পিতাকে। তাঁকে দেখতে পাই তাঁর অতীত ইতিহাসের অধ্যায়গুলিতে। ভাগ্য বিড়ম্বনার স্মৃতির আয়নায়। বঙ্গবন্ধু শুধু নিজেই কালজয়ী হয়ে আছেন তা কিন্তু নয়। তিনি একটি দেশের জন্মদাতা। সোনার বাংলা তাঁর অবদান। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বেই বাঙালি মনে শক্তি সাহস সঞ্চার করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশের স্বাধীনতা অর্জন করেছে। যা বাঙালির জন্য এক বিরাট প্রাপ্তি।
বিশ্বের কোন শীর্ষ স্থানীয় নেতা এ দেশে এসে যখন সাভার স্মৃতি সৌধ এবং শিখা অনির্বাণে গিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তখন বাঙালি জাতির অশ্রুসিক্ত নয়ন বলে দেয় সেই ৪৬ বৎসর পূর্বের ভয়াল দিন গুলির চরম বেদনার আকুতি। আর আত্মঅহংকারবোধ জাগে হৃদয়ে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল,  ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্রমুক্ত একটি সুন্দর সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে। কিন্তু বাঙালি সর্বদাই ভাগ্য বিড়ম্বনার শিকার হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। পথ চলার শেষ নেই। এদেশের কবি সাহিত্যিক শিল্পীরা গানে কবিতায় সোনার বাংলার সৌন্দর্য্যকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছেন।
তারা জানতেন একদিন বাঙালি স্বাধীনতা আদায় করে দেশকে শত্রুমুক্ত করে সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলবে। তাই তো কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বহু পূর্বে জাতীয় সংগীত রচনা করে গেছেন আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।
তবে স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ করতে গিয়ে আমরা নিজেরা অকর্ম কুকর্ম করে দেশকে অস্থিতিশীল করে নিজেদের  ফায়দা আসিল করতেই ব্যস্ত। বাঙালির হৃদয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস  আজ অবধি কেঁদে উঠে। ৪৬ বৎসর অতিক্রান্ত হলেও এমন জঘন্য হত্যা কান্ড কেউ কোন দিন প্রত্যক্ষ করেনি। তবে বাঙালি করেছে। বাঙালির লক্ষ আশা,  লক্ষ ভালবাসা, লক্ষ স্বপ্নের অপমৃত্যুর মধ্যে দিয়ে এসেছে মহান স্বাধীনতা। আমাদের স্বাধীনতা আমাদের অহংকার। লাল সবুজ পতাকা আমাদের পরিচিতি।
আমাদের প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির মাঝ খানে বিরাট ফাঁরাক। প্রাপ্তির চেয়ে হারানোর তালিকা অনেক বড়। আর এ তালিকায় যারা আছে তারা ৪৬ বৎসর পূর্বের অবাক শক্তি।
আমাদের ইতিহাসে আছে গণহত্যা নির্যাতন নীপিড়ন। বড় বড় স্থাপনা ধ্বংস, নারীর লজ্জ্বা হরণের করুণ চিত্র। হাহাকার রক্তে নদীর জন্ম। এসব ইতিহাস আমাদের। যারা দেশের স্বাধীনতা এনেছে তাঁরা অবশ্যই ইতিহাসে মহান। আর যারা বিরোধীতা করেছে তারা ইতিহাসে জঘন্য পশু। তাদেরকে ক্ষমা করা যায় না।

SUMMARY

1840-1.jpg