যে সকল ক্ষণজন্মা ব্যক্তিদের আগমনে মানুষ পেয়েছে যথার্থ মর্যাদা শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তাদের মধ্যে একজন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমন একটি নাম যা বাঙালির ইতিহাসে চিরদিন অমর হয়ে থাকবে। আজকে স্বাধীন সার্বভৌম যে বাংলাদেশের আমরা অধিবাসী, সে গৌরবময় দেশটি বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের সীমাহীন সাধনার এক অনন্য অবদান। ১৯৪৯ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হলে তিনি যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালে সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ী হলে নতুন প্রাদেশিক সরকার গঠিত হয়। তিনি ১৯৫৬ সালে প্রাদেশিক বাণিজ্য মন্ত্রী হিসেবে মন্ত্রীসভায় অন্তর্ভুক্ত হন। কিন্তু বিদেশে ১৯৫৮ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু হলে শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে তিনি ছয়দফা দাবির উত্থাপন করে বাঙালির অধিকার আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যান।
ছয়দফা হল ঃ ১. পাকিস্তান হবে ফেডারেল রাষ্ট্র, ২. দেশ রক্ষা ও পররাষ্ট্র ছাড়া সকল বিষয় প্রদেশের হাতে থাকবে, ৩. পাকিস্তানের দুটি অংশে দুটি স্বতন্ত্র মুদ্রা ব্যবস্থা ও স্টেট ব্যাংক থাকবে, ৪. যাবতীয় খাজনা ও ট্যাক্স ধার্য্য ও আদায়ের ক্ষমতা থাকবে প্রদেশের, ৫. বৈদেশিক বাণিজ্য ও প্রাদেশিক বিষয় থাকবে প্রদেশের হাতে এবং ৬. পূর্ব পাকিস্তানে প্যারামিলিটারি গঠন করা হবে। ১৯৬৯ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামি হিসেবে জড়িত করা হয়। কিন্তু গণআন্দোলনের চাপে মামলা প্রত্যাহার করা হয়। ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের অধিকারী হন। কিন্তু জুলফিকার আলী ভুট্টোর অনমনীয় মনোভাবের জন্য সংকট তীব্র হয়ে উঠে। ১৯৭১ সালে ১ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলে বাংলাদেশের জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বঙ্গবন্ধু সাত মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ভাষণ দিয়ে ঘোষণা করেন এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। দেশে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। ২৫ মার্চ কালো রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালায়। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দি করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর ৩০ লক্ষ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয় বাংলার স্বাধীনতা। পরে শেখ মুজিবুর রহমান কারাগার থেকে মুক্তিপেয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি লন্ডন-কোলকাতা হয়ে দেশে ফিরে রাষ্ট্রের পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
সদ্য স্বাধীন দেশকে গড়ে তোলার জন্য তিনি নিরলস সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কিছু বিপথগামী সেনা সদস্য শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা বিদেশে অবস্থান করায় প্রাণে বেঁচে যান। নয় বছরের শিশু রাসেল পর্যন্ত এই হত্যাযজ্ঞ হতে রেহাই পায় নাই। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ পৃথিবীতে অমর হয়ে থাকবে। নয় মাসে একটি দেশ স্বাধীন হওয়া পৃথিবীর ইতিহাসে নেই। বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে এই বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। তিনি জীবিত থাকলে সোনার বাংলা সোনায় ভরপুর হয়ে যেত। সৌভাগ্য আমাদের জননেত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়চেতা মনোভাবের কারণে সা¤্রাজ্যবাদীদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে। সকল ষড়যন্ত্রকে পাশ কাটিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দিয়ে এবং বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীদেরকে ফাঁসি দিয়ে ইতিহাসের কলঙ্কময় হত্যা থেকে এই হতভাগ্য জাতিকে দায়মুক্ত করেছেন।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তাঁর মহান আদর্শ বাঙালি জাতির জীবনে চিরদিন অম্লান হয়ে থাকবে। বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ আজ সম্মানিত আসনে অধিষ্ঠিত। এ মহান গৌরবের কৃতিত্ব শেখ মুজিবুর রহমানের। তাঁর মর্যাদাকে জাতীয় জীবনে স্মরণীয় করে রাখতে হবে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক।