২ মার্চ। এই দিনে ঢাকা পুরোদমে উত্তাল। হরতাল, মিছিল এবং কারফিউর নগরীতে পরিণত হয়েছিলো এই দিনটি। ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ এ দিনটিতে সবার দৃষ্টি ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের দিকে। তাই, বিভিন্ন অলিগলি পথ থেকে শুরু হওয়া সকল মিছিলের গন্তব্য ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়মুখী। ইতিহাস বলে, স্মরণকালে এমন ছাত্র সমাবেশ দেখেনি কেউ। নিউমার্কেটের মোড় থেকে নীলক্ষেতের সড়ক দিয়ে পাবলিক লাইব্রেরী পর্যন্ত ছিলো মানুষের মুখরতা, জনসমুদ্র। যত সময় গড়াচ্ছিলো, ততই বাড়তে থাকে মানুষের ¯্রােত। বলা যায়, অন্যরকম এক ঐতিহাসিক দিন। এই দিনই বটতলায় পতপত করে ওড়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। ছাত্রলীগের নেতৃত্বাধীন ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ এই পতাকা উড়িয়েছিলো।
সমাবেশ শেষে এক বিশাল মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। মিছিলে সবার হাতে হাতে উঁচানো ছিলো রড ও লাঠি। সেই মিছিলটি ঢাকার অধিকাংশ সড়ক প্রদক্ষিণ করে। ঐদিন সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার প্রেস কনফারেন্সে বারবার ‘বাংলাদেশ’ নামটি উচ্চারণ করেন।
এদিকে, একই দিন বায়তুল মোকাররমে পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগ প্রধান আতাউর রহমান খান এক প্রতিবাদ সমাবেশ আয়োজন করেন বাংলা লীগের ব্যানারে। সে সমাবেশে উল্লেখযোগ্য যারা বক্তৃতা দেন তার মধ্যে ছিলেন শাহ আজিজুর রহমান, ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী এবং মিসেস আমেনা বেগম।
অপরদিকে, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ’র নেতৃত্বাধীন ন্যাপ পল্টন ময়দানে সমাবেশ করে। সেই সমাবেশে বক্তৃতা দেন সাইফুদ্দিন মানিক, মতিয়া চৌধুরী, মহিউদ্দিন আহমেদ, নুরুল ইসলামসহ অনেকে।
ঢাকা শহরে ছিলো হরতাল। স্কুল-কলেজ, কল-কারখানা সব ছিলো জনশূন্য, কোনো অফিসে কাজ হয়নি। হাট বাজারে ছিলো না মানুষ। প্রতিবাদ সমাবেশের দিকেই ছিলো সবার গন্তব্য। সারাদিন একটি ট্রাকে করে আওয়ামী লীগের সদস্যরা সবাইকে শান্তি বজায় রাখার আহবান জানান। বারবার স্মরণ করিয়ে দেয় এটাই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ। স্টেডিয়াম ও তার আশেপাশের এলাকায়, নির্দিষ্ট করে বললে, জিন্নাহ এভিনিউ (যা এখন বঙ্গবন্ধু এভিনিউ), বায়তুল মোকাররম ও নওয়াবপুরে অবাঙালীদের কিছু দোকান ভাংচুর ও লুটপাট হয়। সমস্ত শহরে সরকারের পেটোয়া বাহিনী হরতাল ঠেকাতে মাঠে নামে। তাদের হাতে পঞ্চাশ জনের মতো গুলিবিদ্ধ হন। যাদেরকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এদের বেশীরভাগই তেজগাঁও এলাকার বাসিন্দা ছিলেন। তেজগাঁও পলিটেকনিক স্কুলের ছাত্র্ আজিজ মোর্শেদ ও মামুনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে আনার পর আজিজ মারা যান। এ গুলিবিদ্ধের ঘটনায় আরো উত্তপ্ত হয়ে পড়ে ঢাকা শহর। পরিস্থিতি সামাল দিতে সামরিক আইন প্রশাসকের তরফে ঐদিন কারফিউ জারি করা হয়। প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টা থেকে পরদিন সকাল ৭টা পর্যন্ত এই কারফিউ পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে বলে ঘোষণা করা হয়।
সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলন করেন শেখ মুজিবুর রহমান। সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে নিরস্ত্রদের উপর গুলি বর্ষণের ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানানো হয়। পরদিন ৩ মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত সারাদেশে অর্ধদিবস (ভোর ৬টা থেকে বেলা ২টা) হরতালের ডাক দেন শেখ মুজিবুর রহমান। পরদিন ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে বৈঠক শেষে পল্টনে এক সমাবেশের ঘোষণা দেন তিনি।