৭ মার্চের পটভূমি : একটি ভাষণ-একটি দেশ


বেলাল আহমদ চৌধুরী 
বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা সম্পর্কে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ এর ১২ই নভেম্বরের  দক্ষিণ বাংলায় প্রলয়ংকারী প্রাকৃতিক দুর্যোগের অজুহাত তুলে নির্বাচন পিছিয়ে দিতে সাহস করেন নি। অবশেষে পূর্ব ঘোষনা অনুযায়ী ১৯৭০ সালের ৭ ও ১৭ ডিসেম্বর যথা নিয়মে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং দূর্গত এলাকার জাতীয় ও প্রদেশিক পরিষদের ৩০ টি আসনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি।
পূর্ব বাংলার মানুষের বিক্ষুব্ধ চেতানাকে নিজের মধ্যে ধারণ ও লালন করে এই অশুভ শক্তির মোকাবেলা জন্য যিনি প্রস্তুত হলেন, তিনি আমাদের অসীম ও সাহসী দুর্জয় ব্যাক্তিত্বের অধিকারী প্রিয় নেতা শেখ মুজিব। শেখ মুজিবের এমন একটি ব্যাক্তিত্ব যার মধ্যে বাঙ্গালি মুক্তির বাণী সংহত রূপ পরিগ্রহ করেছে।
জনগণ নির্বাচনের মাধ্যমে সেদিন তাদের সুচিন্তিত রায় জানিয়েছে। জাতীয় পরিষদে আওয়ামীলীগ দু’টো আসন ছাড়া সবগুলো আসনেই বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করে। আওয়ামীলীগ যে দু’টো আসনে জয়লাভ করতে পারেনি সে দু’টো আসনের একটি পিডিপি প্রধান নুরুল আমিন এবং অপরটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী রাজা ত্রিদিব রায় জয়লাভ করেন। জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে চূড়ান্ত ভাবে সম্পূন্ন হলে নির্বাচনের যে ফলাফল পাওয়া যায় তাতে জাতীয় পরিষদে ৩১৩ টি আসনের মধ্যে আওয়ামীলীগ ১৬৭,  জুলফিকার আলী ভুট্টু (পিপিপি পার্টি) ৮৮, কাইয়ুম খান মুসলিম লীগ ০৯, কাউন্সিল মুসলিম লীগ ০৭, জমিয়তে উল-উলেমা-ই-ইসলাম ( হাজারী গ্রুপ) ০৭, মারকাজি জমিয়ত উল-উলেমা-ই-ইসলাম (থানভি গ্রুপ) ০৭, জামায়াতে ইসলাম ০৪,  ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির মক্সো পন্থী ন্যাপ (ওয়ালী গ্রুপ) ০৭, পিডিপি ০১, নির্দলীয় ১৪, ও কনভেশন মুসলিম লীগ ০২ টি আসন লাভ করে। অতঃপর ১৯৭০ সালের ১৭ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের  প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায় যে মোট ৩১০ টি আসনের মধ্যে আওয়ামীলীগ ২৯৮ পিডিপি ০২ ন্যাপ (ওয়ালী পন্থী) ০১, নেজামে ইসলাম ০১, জামাতে ইসলাম ০১, ও নির্দলীয় প্রার্থীরা ০৭টি আসনে জয়লাভ করেন। নির্বাচনে আওয়ামীলীগ যে ঐতিহাসিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে তার তুলনা বিশ্বের নির্বাচনের ইতিহাসে বিরল।
নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের নেতা হিসাবে আর্বিভূত হন। আওয়ামীলীগের এই নিরঙ্কুশ বিজয়ের পশ্চাতে যার একক প্রভাব ইন্দ্রজালিক প্রেরণার সৃষ্টি করেছিল তিনি হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। এই বিজয়ের পর থেকেই বাংলার জনগণ “বঙ্গবন্ধু” উপাধিতে তাকে ভুষিত করেন। বঙ্গবন্ধু এই নির্বাচনকে ৬ দফা ও ১১ দফার মাধ্যমে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্বশাসন আদায়ের গণভোট বলে ঘোষণা করেছিলেন।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে যে প্রমত্ততা ঘটছে তা সারা বিশ্ববাসী দেখেছে। ০১লা মার্চ ১৯৭১ সাল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বেতারে পঠিত এক বিবৃতিতে ঘোষণা করলেন যে, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনিদিষ্ট কালের জন্য স্থগিত থাকবে। তিনি উল্লেখ করেন পাকিস্তানের দুই অংশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে যে ,রাজনৈতিক বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে তার অবসান না হওয়া পর্যন্ত অধিবেশন মূলতবী থাকবে। তিনি পরিস্থিতির উন্নতি হলে পরিষদ ডাকবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন।
একটি বড় ধরনের সাজানো অজুহাতের সুযোগে জাতীয় পরিষদের বৈঠক আসন্নকালে ০১লা মার্চ  এই বৈঠক স্থগিত ঘোষণা করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক বিশ্বাসঘাতকতার বীজ বপন করেন। প্রেসিডেন্ট এই ঘোষণার বিরুদ্ধে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ভোটের ক্ষমতাই জনগণের ক্ষমতা। সেই ক্ষমতাই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতা। ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিলে বঙ্গবন্ধু এর প্রতিবাদে পূর্ববাংলায় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। বঙ্গবন্ধু নির্দেশ মত পূর্ববাংলার প্রশাসন চলে। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে ১৯৭১ সালের ০৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঢাকার রেসকোর্স ময়দান বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসমুদ্রে জাতির উদ্দেশ্যে স্বাধীনতার দিক নির্দেশনাপূর্ণ ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধরু  ০৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ পৃথিবীর মানবদরদী রাজনীতিবিদের ভাষণের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রাচীন গ্রীসের ডিমোস্থেনেস (খ:পৃ ৩৮৪-৩৯২) ছিলেন বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক বক্তা। এডমন্ড বার্ক (১৭২৯-১৭৯৭) এর ভাষণ বিশ্বের রাজনীতির ইতিহাসে বিরল সম্পদ। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন ১৮৬৩ সালে ১৯শে নভেম্বর গেটিসবার্ক যুদ্ধে শহীদের সমাধি ভুমিতে দাঁড়িয়ে মাত্র ০৩ মিনিটের ভাষণ দেন। তার এই চুম্বক ভাষণ বিজলীর মত বিশ্বের সেরা রাজনৈতিক ভাষণ হিসাবে অবিস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। ও যধাব ধ উৎবধস (আই হেভ এ ড্রিম) মার্টিন লুথার কিং ঐতিহাসিক ভাষণের মাঝে বঙ্গবন্ধু কন্ঠের স্বরধ্বনির অপূর্ব মিল পাওয়া যায়। কিউবার সংগ্রামী নেতা ফিডেল ক্যাস্ট্রো, চেগুয়েভারা, সুভাষ চন্দ্রবসু প্রমূখ জাতীয়তবাদী নেতার বিভিন্ন পর্যায়ে প্রদত্ত ভাষণের মাঝে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের অপূর্ব মিল পাওয়া যায়।
৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ পৃথিবীর প্রখ্যাত মানবদরদী রাজনীতিবিদের ভাষণের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ২৩ বছরের ইতিহাস বাংলার মানুষের আর্তনাদের  ইতিহাস, রক্তদানের করুণ ইতিহাস, নির্যাতিত মানুষের কান্নার ইতিহাস। ১৯৫২ সালে আমরা রক্ত দিয়েছি, ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও গদীতে বসতে পারিনি। ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারি করে আয়ূব খান দশবছর আমাদের গোলাম করে রাখেন। ১৯৬৬- এর ৬ দফা প্রস্তাব ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুথান ও আগরতলা ষড়যন্ত্রের কথা ওঠে ভাষণে। তিনি সবেগে আবেগ আপ্লুতভাবে উচ্চারণ করলেন আপনি দেশের প্রেসিডেন্ট ঢাকায় আসুন দেখুন আমার গরীব জনসাধারনকে কি ভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমার মায়ের কোল কি ভাবে খালি করা হয়েছে। আমার সঙ্গে আলোচনা না করে সমস্ত দোষ আমারও বাংলার মানুষের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন। দোষ করলো ভুট্টো কিন্তু গুলি করা হলো আমার বাংলার মানুষকে। আমরা গুলি খাই, দোষ আমাদের, আমরা বুলেট খাই, দোষ আমাদের। ইয়াহিয়া খান অধিবেশন ডেকেছেন কিন্তু আমার দাবী, সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে, সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে  ফিরিয়ে নিতে হবে, হত্যার তদন্ত করতে হবে, এ দাবী মানার আগে পরিষদে বসার কোন প্রশ্নই আসেনা। জনগণ আমাকে সে অধিকার দেয়নি। রক্তের দাগ এখনো শুকায়নি। শহীদের রক্ত মাড়িয়ে ২৫ তারিখ পরিষদে  যোগ দিতে যাব না। তিনি বলেছিলেন যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। ওদেরকে ভাতে মারতে হবে, পানিতে মারতে হবে।  ভাষণের শব্দগুলো কাব্যের রূপ নিয়েছে। ৭ মার্চের বক্তৃতা এক ঐশ্বরিক শক্তির প্রভাবজাত বক্তৃতা। 
৭ মার্চের ভাষণ সর্ম্পকে আ.স.ম আরিফিন সিদ্দিক (বর্তমান ভাইস চ্যান্সেলর) বঙ্গবন্ধুর প্রজ্ঞা ও বাগ্মীতা সম্পর্কে লিখেছেন- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ যোগাযোগ বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক প্রয়োগের এক বিস্মকর ঘটনা। যোগাযোগ বিষয়ে অমানবিক নিয়ম কানুনের এক আশ্চর্য প্রতিফলন ঘটেছে। বঙ্গবন্ধুর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক ভাষণে প্রতি মিনিটে গড়ে ৫৮ থেকে ৬০টি শব্দ উচ্চারণ করে মাত্র ১৯ মিনিটে কালজয়ী ভাষণটি শেষ করেছেন। সম্প্রচারতত্বে প্রতি মিনিটে ৬০ শব্দের উচ্চারণ একটি আর্দশ হিসাব এক হাজার একশত সাতটি শব্দের ভাষণে কোন বিরক্তিকর পুনরাবৃত্তি ছিল না। বঙ্গবন্ধু একজন শক্তিশালী বক্তা। বক্তৃতা দেয়ার সময় তিনি সব কিছুই ব্যবহার করেছেন। যথার্থ শব্দ, প্রজ্ঞা  এবং বজ্রধ্বনি। 
৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু সুপরিপক্ক রাজনীতিবিদদের ন্যায় এমনভাবে ঘোষণা করলেন যে,শাসক পক্ষ বুঝতে পারলো যে, এ ঘোষণার সংগ্রামের ঘোষণা- যুদ্ধের নয়। অন্যপক্ষে জনগণ ঠিকই বুঝেছিলেন যে, এই ঘোষণায় যুদ্ধেরই আবেদন জানানো হয়েছে। তিনি বলেছেন যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। মনে রাখবেন, রক্ত যখন দিয়েছি আরও দেব তবু এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের বক্তৃতা  এমন যথাযথ, সংযত, শানিত, এবং প্রাণস্পশী  ছিল যা বিশ্বের ইতিহাসে কালজয়ী হয়ে থাকবে। ৫২ বছরের ছোট্ট জীবনটায় ৩২ বছর সংগ্রাম করেছেন এবং ২২ বার জেল খেটেছেন। বঙ্গবন্ধু অবিনশ্বর কীর্তি  রেখে গেছেন। সেই জন্য তিনি অবিস্মরনীয় হয়ে থাকবেন বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের হৃদয় মন্দিরে। তো, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন :
“এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ/ মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।”   
লেখক : কলামিস্ট।

SUMMARY

1827-1.png