১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্র কাননে নবাব সিরাজ উদ্দৌল্লার পতনের সূচনা থেকেই বাঙালির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এবং স্বাধীকারের সংগ্রাম শুরু হয়ে ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট প্রথম পর্যায়ে পূর্ণতা যায়। দ্বিতীয় পর্যায়ে পূর্ণতা পায় ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমিতে এবং প্রেক্ষাপটে যে সকল কর্মসূচী “দিক নির্দেশক” হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে ১৯৬৬ সালের আওয়ামী লীগ ঘোষিত ছয় দফা কর্মসূচী তম্মধ্যে অন্যতম। উল্লেখ্য যে, শেরে বাংলা ফজলুল হকের প্রথম লাহোর প্রস্তাব ঘোষনার সাত বছরের মধ্যে অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট স্বাধীন সার্বভৌম পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয় এবং শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ২য় লাহোর ছয় দফা প্রস্তাব ঘোষনার পাঁচ বছরের মধ্যে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের আলোকে তাই ছয় দফা কর্মসূচীকে শোষিত ও নিপীড়িত বাঙালির জন্য ম্যাগনা কার্টা রুপে অভিহিত করা হয়। রাজনৈতিক ইতিহাসে লাহোর প্রস্তাবদ্বয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। ছয় দফা কর্মসূচী উপস্থাপনের পর আওয়ামী লীগ যে প্রচার কার্য চালায় তা চুলছেড়া বিশ্লেষণ করলে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় সমূহ স্পষ্ট হয়ে উঠে।
প্রথমত: ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করে পাকিস্তানকে একটি সত্যিকার যুক্তরাষ্ট্র রূপে গঠন করতে হবে। ইহাতে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার থাকবে সার্বজনীন প্রাপ্ত বয়স্কদের সরাসরি ভোটে সকল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং আইন সভা সমূহের সার্বভৌমত্ব থাকবে। দ্বিতীয়ত: পূর্ব পাকিস্তানকে একটি স্বতন্ত্র অঞ্চল তথা অংগরাজ্য হিসাবে গণ্য করতে হবে কেবল মাত্র প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয় ব্যতীত অন্যান্য বিষয়াদি পরিচালনার নিরংকুশ ক্ষমতা এই অংগ রাজ্যের সরকারের হাতে অর্পন করতে হবে। তৃতীয়ত: পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যে, অর্থনৈতিক বৈষ্যম্যের পাহাড়-গড়ে উঠেছে তা দূরীকরণের লক্ষ্যে দুই অঞ্চলের জন্য-“দুই অর্থনীতি” গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে মুদ্রা ব্যবস্থার উপর কড়াকরি আরোপ করতে হবে যাতে পূর্ব পাকিস্তানের হতে পশ্চিম পাকিস্তানে মুদ্রা পাচার না হতে পারে। চতুর্থত: ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তান সম্পূর্ণ অরক্ষিত ছিল। কাজেই প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে হবে। এর প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসাবে নৌবাহিনীর সদর দপ্তর করাচী হতে চট্রগ্রামে স্থাপন করতে হবে এবং আধা-সামরিক বাহিনী গড়ে তোলার ক্ষমতা প্রদান করতে হবে। পঞ্চমত: সকল প্রকার ট্যাক্স, খাজনা ও কর ধার্য এবং আদায়ের ক্ষমতা প্রাদেশিক বা আঞ্চলিক সরকারের হাতে থাকবে। তবে কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয় নির্বাহের জন্য আদায়কৃত একটা অংশ কেন্দ্রীয় সরকার পাবে। ষষ্ঠত: বৈদেশিক মুদ্রার ওপর প্রদেশ বা অংগরাজ্যগুলোর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে। বৈদেশিক বাণিজ্য ও সাহায্য সম্পর্কে প্রদেশ বা অংগরাজ্যের সরকারগুলো আলাপ-আলোচনা ও চুক্তি করতে পারবে।
ছয় দফা কর্মসূচী উপস্থাপনের সাথে সাথেই বাঙালির মধ্যে এক নব জাগরণের সঞ্চার হয়। ছয় দফা কর্মসূচীর মাঝে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশানের তথা সুশাসনের রূপরেখা খুঁজে পেয়ে ছিল। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৬৫-এর সময়ের মধ্যে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যে, অর্থনৈতিক বৈষ্যম্যের পাহাড়-গড়ে উঠেছিল তা বাঙালির মনে তীব্র অসন্তোষের জন্ম দিয়ে ছিল। উন্নয়নের সিংহ ভাগ কার্যক্রম পশ্চিম পাকিস্তানে বাস্তবায়ন করা হয়েছিল। প্রশাসনিক এবং সামরিক ক্ষেত্রে বাংগালিরা ছিল দারুন ভাবে অবহেলিত। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রেও বাঙালিরা তাদের ন্যায্য অধিকার পাচ্ছিলনা। প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান ছিল সম্পূর্ণ অরক্ষিত। সর্বোপরি পশ্চিম পাকিস্তানী কায়েমী চক্রের শোষন, নির্যাতন, চক্রান্ত এবং সুশাসনের প্রতি চরম অনীহা বাঙালির মনে দারুন ক্ষোভের সঞ্চার ঘটিয়েছিল। ঠিক এ রূপ পটভূমি ও প্রেক্ষিতেই আওয়ামী লীগের ছয় দফা কর্মসূচী ঘোষিত হয়। ন্যায্য অধিকার, অর্থনৈতিক মুক্তি, রাজনৈতিক মুক্তি তথা সুশাসন থেকে বঞ্চিত বাঙালি ছয় দফা কর্মসূচীকে তাই তাদের স্বাধীকারের দাবী এবং একটি স্বতন্ত্র্যসত্ত্বা হিসাবে বাচার দাবী রূপে গ্রহণ করে। ছয় দফা কর্মসূচী মিডিয়ায় প্রকাশিত হওয়ার পর আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনেও ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। আমেরিকার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন রাষ্ট্রবিজ্ঞান এর অধ্যাপক ডঃ রওনক জাহান পাকিস্তানের জাতীয় সংহতির ব্যর্থতা সংক্রান্ত বিষয়ের উপর চধশরংঃধহ ঋধরষঁৎব রহ হধঃরড়হধষ রহঃবৎসরমৎধঃরড়হ নামে একটি লিখেন। এই বইয়ে তিনি উল্লেখ করেন ছয় দফা দাবী মানার অর্থে হচ্ছে পাকিস্তানের রাষ্ট্র কাঠামোর ভিতরে আরেকটি স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবী মেনে দেয়া। তাঁর এই বই প্রকাশ হওয়ার প্রায় পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায় এবং তিনিও আšতর্জাতিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে ছয় দফা কর্মসূচী একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে এবং উপমহাদেশের রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাস সংক্রান্ত অন্যান্য বই সমূহ -এর সাথে পাকিস্তানের জাতীয় সংহতি ও সংবিধানের ব্যর্থতার কারণসহ ছয় দফার বিষয়টিও অত্যান্ত গুরুত্বের সাথে বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসে সংযুক্ত করা হয়েছে।
আইয়ুব সরকার অস্ত্রের ভাষায় এবং চরম নেতিবাচক দৃষ্টিভংগিতে ছয় দফা কর্মসূচীকে ব্যর্থ করার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করে। শেখ মুজিব সহ আরো অনেক নেতা ও কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। দায়ের করা হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। এ সবের প্রতিবাদে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান যেন জ্বলে উঠে। ছয় দফার সমর্থনে ছাত্র সমাজ ১১ দফা কর্মসূচী নিয়ে এগিয়ে আসে। আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে এক প্রচন্ড গণআন্দোলন গড়ে তোলা হয় এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৬৯এর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আইয়ুব খানের পতন ঘটে। বঙ্গবন্ধু উপাধি পাওয়ার মধ্য দিয়ে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃতাধীন আওয়ামী লীগ ছয় দফার ভিত্তিতেই সুশাসন প্রতিষ্ঠার নিশ্চয়তা প্রদান সাপেক্ষে জনগণনের ম্যান্ডেট দাবী করে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ এ দাবী ইতিবাচক ভাবে গ্রহণ করে ও বিপুল ভোটে আওয়ামী লীগকে জয় যুক্ত করে। ১৯৭০ সনে তদানিন্তন পাকিস্তানে প্রথম এবং শেষ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের ৩১৩টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন অলংকৃত করে। নির্বাচনে বিজয়ী দল হিসাবে আওয়ামী লীগের নেতা হিসাবে শেখ মুজিবুর রহমান স্বাভাবিকভাবেই অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রী হওয়ার কথা। কিন্তু ভুট্টচক্র আওয়ামী লীগের তথা শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট বিধীমোতাবেক ক্ষমতা অর্পন না করে বরং পশ্চিম পাকিস্তানীরা শুরু করে আরেক চক্রান্তের খেলা-যার অবশ্যাম্ভাবী পরিনতিতে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সূচনা এবং অন্যায়ভাবে নিরীহ এ দেশবাসীর উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয় ইয়াহিয়া ভুট্টচক্র। অবশেষে ৩০ লক্ষ শহিদের এবং দু’লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়।
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর এর পূর্বে বাংলার মাটিতে জন্ম গ্রহণ করেছে এমন বাঙালি সšতান কখনো বাংলার রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান হয় নাই। এই ক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম হচ্ছে বঙ্গবুন্ধ শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক প্রজ্ঞাই তাঁকে বাঙালির ইতিহাসে প্রধান ব্যক্তিত্বের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বাঙালি জাতি এবং বাঙালি জাতির সার্বভৌম রাষ্ট্রই বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির জনক উপাধি দিয়েছে। তাঁর রাজনৈতিক অবদানই বাংলাদেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে একজন শেরে বাংলা এবং আরেক জন জাতির জনক। এই দুই জন মহান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বই লাহোর রাজনৈতিক প্রস্তাবদ্বয়ের মাধ্যমে উপমহাদেশে স্বাধীন ও সার্বভৌম দুইটি রাষ্ট্রের প্রধান উপস্থাপক হিসেবে রাজনৈতিক ইতিহাসে স্থান লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। যে জাতি ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে না, সে জাতি সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারে না। রাজনৈতিক ইতিহাসে যার যে প্রাপ্য তা সঠিকভাবে প্রদান করা অবশ্যই কর্তব্য। ছয় দফার ভিত্তিতে তথা জাতির জনকের স্বপ্নের আলোকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক উন্নয়নে রাজনৈতিক সহনশীলতার বিকাশ লাভ করা ও প্রতিহিংসা পরিহার করা অপরিহার্য। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন-ক্ষুধা, দারিদ্র ও সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বার্থে রাষ্ট্রের প্রশাসন যন্ত্রের সকল স্তরে স্বচ্ছতা (ঞৎধহংঢ়ধৎবহপু), জবাবদিহিতা (অপপড়হঃধনরষরঃু) ও দায়িত্বশীলতা (জবংঢ়ড়হংরনরষরঃরবং) সুনিশ্চিতকরণের মাধ্যমে সুশাসনের বিষয়টি গতিশীল করা অপরিহার্য। জাতির জনকের ছয় দফায় উপস্থাপনকৃত রাজনৈতিক দর্শনের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়নের বিষয়টি নিশ্চিত করণের মাধ্যমে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নতির সম্ভাব্য সকল প্র¯ত্ততি রাজনৈতিক নেতৃত্বের গ্রহণ করা আবশ্যক।
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, কার্ড-সিলেট।